ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

নির্বাচন কমিশনে রাষ্ট্রদূত ও তাদের সহযোগীদের আনাগোনা -স্বদেশ রায়

প্রকাশিত: ০৪:৩৯, ৮ জুন ২০১৭

নির্বাচন কমিশনে রাষ্ট্রদূত ও তাদের সহযোগীদের আনাগোনা -স্বদেশ রায়

২০১৯-এর নির্বাচন সামনে রেখে আবার কিছু তৎপরতা লক্ষ্য করা যাচ্ছে। এই তৎপরতাগুলোকে অপতৎপরতা বলতে পারলে সত্য প্রকাশ হতো। তার পরেও ধরে নেই তৎপরতা। নিজেদের ভদ্রতা থেকে দূরে না যাওয়া ভাল। ইতোমধ্যে নির্বাচন কমিশনারদের সঙ্গে বৈঠক করেছেন ভারতীয় রাষ্ট্রদূত, ইউরোপীয় ইউনিয়ন রাষ্ট্রদূত ও মার্কিন রাষ্ট্রদূত। আবার এর পাশাপাশি দেশীয় এক শ্রেণীর এনজিও ইলেকশন ওয়ার্কিং গ্রুপ নামে আবার মাথাচাড়া দিয়েছে। ইলেকশন ওয়ার্কিং গ্রুপের এনজিওগুলো সবই বিদেশী টাকায় চলে। এদের অতীতের কর্মকা- নিয়ে অনেক রিপোর্ট করেছি, অনেক লিখেছি এই কলামে। তাই এদের সম্পর্কে বিস্তারিত কিছু লেখার নেই। নির্বাচন কমিশন ও রাজনৈতিক দল বিশেষ করে প্রগ্রেসিভ রাজনৈতিক দলগুলোর উচিত হবে এদের পাত্তা না দেয়া। জামায়াত-বিএনপি এদের পাত্তা দেবে। কারণ এরা অধিকাংশ জামায়াত-বিএনপি সমর্থক এনজিও। এখন অবশ্য অনেকে ভোল পালটে আছে, অনেকে অনেক লোভী আওয়ামী লীগারকে তাদের ভেতরে ঢুকিয়ে নিয়ে কাজ করছে। তবে নির্বাচনের সময় এরা সবই এক হয়ে যাবে। অতীতে এও দেখা গেছে, বিশেষ করে ২০০১-এর নির্বাচনে এই ইলেকশন ওয়ার্কিং গ্রুপের কোন কোন সদস্য সংগঠনের পরিচয়পত্র নিয়ে জামায়াত-বিএনপি কর্মীরা নির্বাচন কেন্দ্রে ঢুকে জাল ভোটসহ নানা ধরনের অনিয়ম করতে সাহায্য করেছে। তাই বাংলাদেশে ধীরে ধীরে একটি সুস্থ নির্বাচনী ব্যবস্থা গড়ে তুলতে হলে এই ধরনের ইলেকশন ওয়ার্কিং গ্রুপকে যে কোন ধরনের সহায়তা এখন থেকেই বন্ধ করতে হবে নির্বাচন কমিশনকে। নির্বাচন কমিশন যদি একবার এদের পাত্তা দেয় তাহলে এরা অনেক ক্ষতি করে ফেলবে নির্বাচন ব্যবস্থার। সরকারকেও এদের বিষয়ে এখন থেকে কঠোর অবস্থান নিতে হবে। বিশেষ করে যাদের সঙ্গে জামায়াত কানেকশন আছে, জঙ্গী কানেকশন আছে তাদের নিবন্ধন অচিরেই বাতিল করতে হবে। অন্যদিকে নির্বাচন কমিশনকে স্বাধীন দেশের নির্বাচন কমিশন হতে হবে। নির্বাচন কমিশনকে খোঁজ নিতে হবে, ইন্ডিয়া, আমেরিকা, ইউরোপীয় ইউনিয়নের দেশগুলোতে সঠিক নির্বাচন হচ্ছে কি-না। এ বিষয়ে সে দেশে নিযুক্ত বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত তাদের নির্বাচন কমিশনের সঙ্গে কতবার দেখা করার সুযোগ পান। আদৌ সুযোগ পান কি? তা যদি না পান, তাহলে আমাদের এত দায় কেন, বাংলাদেশে নিযুক্ত বিদেশী রাষ্ট্রদূতদের সঙ্গে এত দেখা করার। তাদের এত উপদেশ শোনা? তারা কে? তারা কি আমাদের ভাইসরয়? আমরা কি তাদের কলোনি? ভারতীয় রাষ্ট্রদূত আমাদের নির্বাচন কমিশনের সঙ্গে দেখা করে বলেছেন, নির্বাচনে প্রয়োজন হলে তারা আমাদের কারিগরি সাহায্য দেবে। এ কথা কেন নির্বাচন কমিশনারকে বলতে হবে? বাংলাদেশ সরকার ও সাংবিধানিক বডি নির্বাচন কমিশন বসে যদি মনে করে নির্বাচনের জন্য কারিগরি দিক আরও উন্নত করার প্রয়োজন, সেখানে বাংলাদেশের সরকারকে নির্বাচন কমিশন বলবে, তার এত কোটি টাকা বাজেট দরকার এবং এই সমস্ত সামগ্রী তৈরি বা আমদানি করে দেয়া দরকার। তৈরি করতে পারলে দেশ নিজে করবে, সরকার সেটা করাবে। আর যদি আমদানি করতে হয়, তাহলে ভারত থেকে আমদানি করবে না সুইডেন থেকে আমদানি করবে তা বাংলাদেশ সরকার সিদ্ধান্ত নেবে। ভারত যদি কোন ফান্ড এখানে একটি বৃহৎ গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র হিসেবে কন্ট্রিবিউট করতে চায় তা সে দেশের সরকার যথাযথভাবে বাংলাদেশের সরকারকে বলবে। তাদের রাষ্ট্রদূত এভাবে নির্বাচন কমিশনারের সঙ্গে দেখা করে প্রেসকে বলবে এটা কি শোভন? বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত কি ভারতের কোন নির্বাচনের আগে এ সুযোগ সে দেশে পায়? ইউরোপীয় ইউনিয়ন রাষ্ট্রদূত আমাদের নির্বাচন কমিশনারদের অনেক জ্ঞান দিয়ে এসেছেন। তাদের কাছে জানতে ইচ্ছে করে-ব্রেক্সিটের ওই গণভোটের আগে ক’বার ব্রিটেনের নির্বাচন কমিশনের সঙ্গে দেখা করেছিলেন তারা? তাছাড়া ইউরোপীয় প্রেসের কাছে একবারের জন্যও কী বলেছিলেন যে, ব্রেক্সিট নির্বাচনের প্রচার সঠিক হচ্ছে না। কারণ, সে সমস্ত দল ওই গণভোটে ব্রেক্সিটের পক্ষে তারা ধর্ম এবং বর্ণবাদকে ব্যবহার করছে। কোন গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের নির্বাচনে ধর্ম ও বর্ণবাদকে ব্যবহার হতে পারে না। তারা কি ওই নির্বাচনের পর বলেছেন, ব্রেক্সিট গণভোটের ফল অবৈধ কারণ ওই নির্বাচনে সব থেকে বড় অস্ত্র ছিল ধর্মের নামে ঘৃণা ছড়ানো ও বর্ণবাদের যথেচ্ছ ব্যবহার। কই ইউরোপের কোন পত্রপত্রিকায় ব্রিটেনে নিযুক্ত ইউরোপের অন্য দেশের কোন রাষ্ট্রদূতকে এমন কোন বক্তব্য দিতে শুনিনি। তবে কি ব্রিটেন যেহেতু আটলান্টিকের ওপারে তাই ওখানে নির্বাচনে সবকিছু বৈধ? নির্বাচন যেভাবেই হোক না কেন তা একেবারে পুত পবিত্র। মার্কিন রাষ্ট্রদূত মিসেস বার্নিকাট আরও এক ধাপ এগিয়ে গেছেন, তিনি একেবারে ব্রিটিশ আমলে নিয়োজিত ব্রিটিশ ভাইসরয়ের মতোই বলেছেন, নির্বাচন কমিশনকে তিনি বলে এসেছেন ৫ জানুয়ারি ও ১৫ ফেব্রুয়ারির মতো নির্বাচন যেন না হয়। বাংলাদেশে ৫ জানুয়ারির ও ১৫ ফেব্রুয়ারির নির্বাচনের ভেতর অনেক পার্থক্য আছে। সে পার্থক্য মিসেস বার্নিকাট একটি উদাহরণ থেকেই বুঝবেন, ৫ জানুয়ারির নির্বাচনের পরে সরকার সাংবিধানিকভাবে সুস্থ অবস্থায় রাষ্ট্র পরিচালনা করে যাচ্ছে আর ১৫ ফেব্রুয়ারির পরে এক মাসের মধ্যে ওই সরকারকে গণঅভ্যুত্থানের ফলে পদত্যাগ করতে হয় রাতের অন্ধকারে। তার পরেও আমাদের দেশের এক জাতীয় সুশীলদের তথাকথিত নিরপেক্ষতা অনুকরণ করে মিসেস বার্নিকাট ৫ জানুয়ারি ও ১৫ ফেব্রুয়ারিকে এক করে ফেলেছেন। মিসেস বার্নিকাটকে প্রশ্ন করা যায়, তাদের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের আগে বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূতকে কি সে দেশে এ কথা বলার সুযোগ দেয়া হয়েছিল, যে আমেরিকায় যাতে ফ্লোরিডার বুশ মার্কা নির্বাচনের মতো আর কোন নির্বাচন না হয় তার নিশ্চয়তার কথা তিনি নির্বাচন পরিচালন সংস্থাকে বলেছেন। তাছাড়া তার দেশের নির্বাচনে যেভাবে মুসলিম ধর্ম বিদ্বেষ ছড়ানো হলো এ কি গণতন্ত্রের পর্যায়ে পড়ে? ওই ধরনের প্রচারের মধ্য দিয়ে যে নির্বাচন হয় তা কি সত্যিই গণতান্ত্রিক নির্বাচন? তবে শুধু তাদের দোষ নয়, তারা এ সুযোগ পাচ্ছে আমাদের এক ধরনের হীনম্মন্যতার কারণে। আর এই হীনম্মন্যতা শুধু যে নির্বাচন কমিশনে কাজ করছে তা নয়, সরকারে, সমাজে, মিডিয়ায় সব খানেই। কারণে-অকারণে আমাদের মন্ত্রীরা নিজেদের কাজ ফেলে বিদেশী একজন রাষ্ট্রদূতকে দেখা দিতে পারলে যেন ধন্য হয়ে যান। এ ক্ষেত্রে একমাত্র ব্যতিক্রম প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তিনিই একমাত্র তার ব্যক্তিত্ব ও অবস্থান এ ক্ষেত্রে ধরে রাখেন। মার্কিন রাষ্ট্রদূত ড্যান মজেনা বছরের পর বছর চেষ্টা করেও তার সাক্ষাত পাননি। সাক্ষাত কেন পাননি তা মনে হয় ৫ জুলাইয়ের জনকণ্ঠের রিপোর্টে মার্কিন স্টেট ডিপার্টমেন্টের সেক্রেটারিকে দেয়া জুডিশিয়ারি কমিশনের চেয়ারম্যান চার্লস গ্রেসলির চিঠি যারা পড়ছেন তারা বুঝতে পেরেছেন। ড. ইউনূসের কাছ থেকে টাকা নিয়ে হিলারি নিজে এবং মরিয়াটি ও মজেনাকে দিয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও তার পুত্র সজীব ওয়াজেদ জয়ের ওপর চাপ প্রয়োগ করেন- যাতে ড. ইউনূসের দুর্নীতির তদন্ত না হয়। এর থেকেই বোঝা যায় তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোতে কোন ধরনের কাজে নিয়োজিত থাকে এসব রাষ্ট্রদূত। কিন্তু সাহস করে শক্ত হলেই এদের চরিত্র প্রকাশ পায়। বাংলাদেশের এ যাবতকালের ইতিহাসে শেখ হাসিনা ওয়ার্ল্ড ব্যাংক ও হিলারির চাপের বিরুদ্ধে শক্ত অবস্থান নিয়েছিলেন। ওয়ার্ল্ড ব্যাংকের প্রধান পরবর্তীকালে বাংলাদেশ সফর করে প্রকারান্তরে তার প্রতিষ্ঠানের ভুল স্বীকার করে গেছেন। অন্যদিকে হিলারি তার এ ধরনের ক্ষমতা অপপ্রয়োগের ফলে শুধু যে নির্বাচনে পরাজিত হয়েছেন তা নয়, এখন তদন্তের মুখোমুখি। বাংলাদেশের সুশীল সমাজের একাংশের কখনই শেখ হাসিনার মতো এ ব্যক্তিত্ব হবে না কারণ তারা বিদেশীদের অর্থ দ্বারা লালিত। তবে এ দেশের সাধারণ মানুষ, রাজনীতিক ও সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানের প্রধান ও সাংবাদিকদের অন্তত শেখ হাসিনার ব্যক্তিত্বকে অনুকরণ করা উচিত। বর্তমানের প্রধান নির্বাচন কমিশনার একজন মুক্তিযোদ্ধা ও সৎ কর্মকর্তা। তার ব্যক্তিত্ব নিয়ে কারও প্রশ্ন তোলা উচিত নয়। একজন মুক্তিযোদ্ধার কাছে দেশ সব সময়ই আশা করে, স্বাধীনতার চেতনায় যে সংবিধান সেটাই তিনি উর্ধে তুলে ধরবেন। আমাদের সংবিধানে স্পষ্ট বলা আছে নির্বাচন কমিশনের কী কাজ, কীভাবে তিনি নির্বাচন করবেন। তিনি যেহেতু মুক্তিযোদ্ধা, ছাত্র জীবনে বাঙালীর অধিকারের পক্ষে ছিলেন, তাই স্বাভাবিকই তার কাছে আশা করবে জাতি, তিনি তার ব্যক্তিত্বের মাধ্যমে জাতীয় সম্মান অক্ষুণœœ ও জাতিকে ষড়যন্ত্রের হাত থেকে মুক্ত রাখবেন। সংবিধান তাকে যে দায়িত্ব দিয়েছে সে দায়িত্ব পালন করার যথেষ্ট যোগ্যতা তার আছে। বিদেশী রাষ্ট্রদূতদের কাছ থেকে বুদ্ধি নেয়ার তার কোন দরকার নেই। বরং তিনি যতই এদের ও এদের এ দেশীয় দালাল নির্বাচনের নামে ব্যবসা করা ব্যক্তিবর্গ বা তথাকথিত আরও কিছু এনজিও আছে এদের থেকে দূরে থাকবেন- ততই বাংলাদেশ একটি ভাল নির্বাচন অনুষ্ঠান করতে পারবে। দেশ মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় পরিচালিত হওয়ার সুযোগ পাবে। পশ্চিমারা তাদের ব্যবসার স্বার্থে নির্বাচনের আগে তাদের অনুগতদের ক্ষমতায় বসানোর জন্য কী করে তা আমরা ২০০১ সালে দেখেছি। তেল কোম্পানির পক্ষে দালালি করতে সাবেক প্রেসিডেন্ট জিমি কার্টারও বাংলাদেশে এসেছিলেন। তাই দেশের মানুষ ও দেশের সম্পদের স্বার্থে এদের দূরে রাখা ছাড়া বিকল্প নেই। বাংলাদেশ তার নিজস্ব সক্ষমতা দিয়েই সামনে এগিয়ে যেতে পারবে, তার প্রতিটি গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানকে প্রতিষ্ঠিত করতে পারবে। বরং নিজস্ব মর্যাদা ক্ষুণœœ করে বিদেশীদের আধিপত্য বিস্তারের সুযোগ দিলে তারা প্রকারান্তরে এ দেশকে ক্ষতিগ্রস্তই করবে। তাছাড়া এ মুহূর্তে পশ্চিমাদের প্রতি অনেক বেশি সচেতন হতে হবে বাংলাদেশের প্রতিটি সচেতন দায়িত্ববান ব্যক্তিকে। ১৫ কোটি মুসলিমের এই দেশটিকে জঙ্গীর দেশে পরিণত করতে পারলে তারা পাকিস্তান, আফগানিস্তান ও মধ্যপ্রাচ্য থেকে যে মজা লুটছে পশ্চিমারা বাংলাদেশ থেকেও একই মজা লুটতে পারবে। তারা সেই সুযোগের অপেক্ষায় আছে। আমাদের গণতন্ত্র কতটুকু প্রাতিষ্ঠানিক রূপ পাক তা তাদের মোটেই এজেন্ডা নয়। এ সবই তাদের কৌশল মাত্র। [email protected]
×