ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

মেহেরপুরে আশঙ্কাজনক হারে ছড়িয়ে পড়েছে কুষ্ঠ

প্রকাশিত: ০৪:১৭, ৮ জুন ২০১৭

মেহেরপুরে আশঙ্কাজনক হারে ছড়িয়ে পড়েছে কুষ্ঠ

সংবাদদাতা, মেহেরপুর, ৭ জুন ॥ গাংনী উপজেলার তেঁতুলবাড়ীয়া, দেবীপুর, করমদীসহ কয়েকটি গ্রামে কুষ্ঠ জীবাণুর সংক্রমণ ছড়িয়ে পড়েছে। আক্রান্ত হয়েছে শতাধিক নারী-পুরুষ ও শিশু। আক্রান্তদের শরীরে বড় বড় দাগের সৃষ্টি হয়েছে। আতঙ্কিত হয়ে পড়েছে এলাকাবাসী। জেনে না জেনে চিকিৎসার অভাবে মারা যাচ্ছে অনেকে। গাংনী উপজেলার তেঁতুলবাড়ীয়া গ্রামের মোশারফ হোসেন (৬০)। আজ থেকে ১০ বছর আগে পায়ে ও কোমরে ছোট দাগ দেখা দেয়। গাংনী স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে নিয়ে গেলে তার কুষ্ঠ রোগ শনাক্ত করা হয় এবং ঢাকায় চিকিৎসা করার জন্য পরামর্শ দেয়া হয়। কিন্তু আর্থিক অভাব-অনটনের কারণে দেখানো সম্ভব না হলেও গাংনী স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে নিয়মিত সেবা নেয়ার জন্য যান তিনি ও তার ছেলে। কিন্তু বারবার স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে গিয়েও কোন প্রতিকার পাননি তিনি। সময়মতো ডাক্তার না থাকায় ওষুধ না নিয়ে খালি হাতে ফিরে আসতে হয়েছে তাকে। ধীরে ধীরে এ দাগ বাড়তে থাকে এবং একপর্যায়ে তার পায়ে ক্ষতের সৃষ্টি হয়। ১০ বছর ধরে শরীরে কুষ্ঠের সংক্রমণ আর বয়সের ভারে শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করেন তিনি। দীর্ঘদিন একইসঙ্গে বসবাস করায় তার এ রোগ পরিবারে অন্যান্য সদস্যদের মাঝে ছড়িয়ে পড়ে। মোশারফ হোসেনের স্ত্রী জামেলা খাতুন (৫০)। তিনিও জানতেন না তার ও তার মেয়ে রাশেদা খাতুনের শরীরেও বাসা বেঁধেছে কুষ্ঠ রোগ। কুষ্ঠ রোগে আক্রান্ত হয়ে তার স্বামী মারা যাওয়ায় আতঙ্কিত হয়ে মৃত্যুর কিছু দিন পর পরে হাত ও পায়ে দাগ দেখে চিকিৎসকের কাছে ছুটে যান জামেলা খাতুন। নানা পরীক্ষা নিরীক্ষার পর ধরা পড়ে কুষ্ঠ রোগের জীবাণু। পরে একে একে মোশারফ হোসেনের ছেলে ছমিরুল হোসেন, তার স্ত্রী মুসলিমা খাতুন, পরিবারের অন্যান্য সদস্য নাসিমা খাতুন (৩৫), রাশেদা খাতুন (৫৫), মজুর উদ্দিন (৭০), ইমরুল ইসলাম (৩০), টগরী খাতুন (৩২), তারিন খাতুন (০৭), শায়লা খাতুন (৩৫), রুমেলা খাতুনসহ (৫০) তার পরিবারের ১৬ সদস্য আক্রান্ত হয়েছে এ রোগে। তাদের এ পরিবারের সদস্যদের মতো গাংনী উপজেলার কল্যাণপুর, করমদি, হিন্দা, মুজিবনগর উপজেলার সোনাপুর, শীবপুর, আনন্দবাসসহ ১০টি গ্রামের মানুষের মাঝে আশঙ্কাজনক হারে বাড়ছে এ রোগ। সিভিল সার্জন অফিসের তথ্য অনুযায়ী জানা যায়, সরকারী হিসেব মতে, মেহেরপুর জেলায় ২০১০ সালে কুষ্ঠ রোগির সংখ্যা ছিল চার। ২০১১ সালে ছয়, ২০১২ সালে পাঁচ, ২০১৩ সালে সাত, ২০১৪ সালে আট, ২০১৫ সালে ৩৫ এবং ২০১৬ সালে বেড়ে ৪০ রোগীর সংক্রামণ পাওয়া যায়। এলাকার অনেক ছাত্রছাত্রী জানান, গ্রামের মানুষদের কুষ্ঠ রোগে আক্রান্ত হওয়া দেখে আমরাও আতঙ্কিত হয়ে আছি, কখন না আমাদেরও হয়ে যায়। দি লেপ্রসি মিশন ইন্টারন্যাশনালের ব্যবস্থাপক মাসুমা পারভীন জানান, মাইক্রোব্যাকটেরিয়াম লেপ্রি ব্যাকটেরিয়া কুষ্ঠ রোগের কারণ। এ রোগটি খুব ধীরগতিতে বিস্তার লাভ করে। কুষ্ঠ মৃদু সংক্রামক রোগ। শতকরা ১০০ রোগীর মধ্যে ২০ ভাগ সংক্রামক। পক্ষান্তরে ৮০ রোগী অসংক্রামক। কুষ্ঠ রোগ বাতাসের মাধ্যমে ছড়ায়। চিকিৎসাধীন নয় এমন সংক্রামক কুষ্ঠ রোগীর হাঁচি ও কাশির মাধ্যমে নিঃসৃত কুষ্ঠ জীবাণু বাতাসে ছড়িয়ে পড়ে এবং শ্বাসগ্রহণের মাধ্যমে তা সুস্থ ও স্বাভাবিক মানুষের শরীরে প্রবেশ করে। যদি প্রত্যন্ত অঞ্চলে স্বাস্থ্যকর্মী দিয়ে জেলার সকল গ্রামে কুষ্ঠ রোগী শনাক্ত করা সম্ভব হতো তাহলে রোগীদের চিকিৎসার কাজটি সহজ হতো। সেচ্ছাসেবক কর্মী টম ব্র্যাডলি জানান, সাধারণত কুষ্ঠ রোগের জীবাণু শরীরে প্রবেশের তিন থেকে পাঁচ বছরের মধ্যে এর লক্ষণ দেখা দেয়। কোন কোন ক্ষেত্রে ১৫ থেকে ২০ বছর পরও এ রোগের লক্ষণ প্রকাশ পেতে পারে। তিনি আরও বলেন, কুষ্ঠ রোগের জীবাণু শরীরের চামড়া এবং স্নায়ুকে আক্রান্ত করে। যার কারণে কুষ্ঠ রোগের বহির্প্রকাশ সাধারণত চামড়ায় দেখা যায়। সিভিল সার্জন ডাঃ জি কে এম শামসুজ্জোমান জানান, কুষ্ঠ রোগটি হঠাৎ ধরা পড়েছে। সাধারণত ছয় মাসের মধ্যে যাদের শরীরে একটি থেকে পাঁচটি দাগ রয়েছে সেটিকে এমডিটি পিবি এবং এক বছরের মধ্যে যাদের শরীরে ছয়টি বা তারও বেশি দাগ, দানা বা গুটি রয়েছে তাদের এমবি হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। তিনি আরও বলেন, অনেক রোগীই এ রোগটিকে পুরোপুরি নির্ণয় করতে পারে না যে কারণে তারা অনেক সময় ভুল চিকিৎসা নিয়ে থাকে এতে ওই রোগী আরও বেশি অসুস্থ হয়ে পড়ে।
×