ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১

বিমানবন্দরে ইডিএস বসাতে পারেনি সিভিল এভিয়েশন

১৫ কোটি টাকা বাঁচাতে গিয়ে ॥ ১৯ বিলিয়ন ডলারের পণ্য রফতানি হুমকির মুখে

প্রকাশিত: ০৫:৩০, ৭ জুন ২০১৭

১৫ কোটি টাকা বাঁচাতে গিয়ে ॥ ১৯ বিলিয়ন ডলারের পণ্য রফতানি হুমকির মুখে

আজাদ সুলায়মান ॥ বার বার তাগিদ দেয়া সত্ত্বেও আমলাতান্ত্রিক জটিলতার দরুন বিমানবন্দরে ইডিএস বসাতে পারেনি সিভিল এভিয়েশন। ১৫ কোটি টাকা বাঁচাতে গিয়ে ইউরোপীয় ইউনিয়নভুক্ত দেশগুলোতে ১৯ বিলিয়ন ডলারের বেশি পণ্য রফতানি হুমকির মুখে পড়েছে। সিভিল এভিয়েশনকে স্ক্যানিং মেশিন ও যন্ত্রপাতি ক্রয় করার জন্য ৯০ কোটি টাকার বাজেট দিয়েছিল সরকার। কিন্তু প্রথম দফায় টেন্ডারে প্রাক্কলিত ব্যয় ১৫ কোটি টাকা বেড়ে যাওয়ায় ওই টেন্ডার বাতিল করা হয়। এতে ইউরোপীয় ইউনিয়নের শর্তানুযায়ী যথাসময়ে এক্সপ্লোসিভ ডিটেকশন সিস্টেম (ইডিএস) ক্রয় করা সম্ভব হয়নি। এই কারণ দেখিয়ে ইইউর টিম বাংলাদেশকে সরাসরি কার্গো রফতানির ক্ষেত্রে হাইরিক্স দেশের তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করে। সিভিল এভিয়েশনকে আনুষ্ঠানিকভাবে এ বিষয়টি অবহিত করেছেন ঢাকাস্থ ইউরোপীয় ইউনিয়নের (ইইউ) রাষ্ট্রদূত পিয়েরে মায়াদুন। যুক্তরাজ্য, অস্ট্রেলিয়া ও জার্মানি এক বছর আগেই ঢাকা থেকে সরাসরি পণ্য রফতানির ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি করেছিল। এবার গোটা ইউরোপে পণ্য রফতানির ওপরও খড়গ নেমে এল। তবে বিমানমন্ত্রী বলছেন ভিন্ন কথা। তিনি বলছেন, সাগর ও আকাশপথে কার্গো পরিবহনে বাংলাদেশ নিষিদ্ধ না হলেও উচ্চ ঝুঁকিতে থাকা দেশ হিসেবে বাংলাদেশের নাম ঘোষণা করেছে ইউরোপীয় ইউনিয়ন। কার্গো পরিবহনে বাংলাদেশ নিষিদ্ধ এমন কোন চিঠি আমার কাছে আসেনি। তবে অন্য কারও কাছে এসেছে কি না, তা আমার জানা নাই। রাশেদ খান মেনন জানান, আমরা যদি তিনটি শর্ত পুরোপুরি পূরণ করতে না পারি তাহলে ইভিএসের জন্য বাংলাদেশকে তৃতীয় কোন দেশে গিয়ে অতিরিক্ত শুল্ক পরিশোধ করতে হবে। তবে সে ক্ষেত্রে পণ্য পরিবহনে ব্যয় বাড়বে। খুব শীঘ্রই বাংলাদেশ এটি সংগ্রহ করবে। বিমানের পরিচালক আলী আহসান বাবু বলেছেন, নিষেধাজ্ঞা তো জারি আছে এক বছর আগে থেকেই। তখন ছিল আনঅফিসিয়াল। এবার হয়তো সেই ঘোষণাটাই দিয়েছে আনুষ্ঠানিকভাবে। তবে এখনও আমাদের কাছে এ সংক্রান্ত কোন চিঠি আনুষ্ঠানিকভাবে দেয়া হয়নি। ইউরোপীয় ইউনিয়ন বাংলাদেশের সঙ্গে পণ্যবাহী বিমান চলাচলে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেনি জানিয়ে বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটনমন্ত্রী রাশেদ খান মেনন বলেন, ইইউ বাংলাদেশকে হাইরিস্ক কান্ট্রি হিসেবে ঘোষণা করেছে। প্র্যাকটিক্যালি আমাদের ওপর কোন কার্গো ব্যান (নিষেধাজ্ঞা) আরোপ করা হয়নি। এটা হয়েছে যে, বাংলাদেশ এ্যাজ এ হোল কান্ট্রি হিসেবে ইইউ হাইরিস্ক কান্ট্রি হিসেবে ঘোষণা করেছে। কিন্তু এ ব্যাপারে কোন চিঠিপত্র অথবা কোন কমিউনিকেশন কখনই হয়নি। তারই পরিপ্রেক্ষিতে নিউজটা আসে। সেখানে সেকেন্ডলি স্ক্যানিংয়ের ব্যাপারে বিমানকে তারা চিঠি দিয়েছে যে সেকেন্ড ইন্সপেকশন হবে। এ্যাজপার ইইউ রেগুলেশন। রাশেদ খান মেনন বলেন, এটা কেবল এয়ার কার্গোর ক্ষেত্রে নয়, শিপিংয়ের ক্ষেত্রেও তাই। গতকাল সিভিল এভিয়েশন চেয়ারম্যানের সঙ্গে ইইউয়ের রাষ্ট্রদূত পিয়েরে মায়াদুনের মিটিং হয়েছে। সেখানে তারা বলেছেন, হাইরিস্ক কান্ট্রি হওয়ার ফলে তিনটা অলটারনেটিভ ব্যবস্থা করবে স্ক্যানিংয়ের ব্যাপারে। একটা হলো এক্সপ্লোসিভ ডিটেকশন সিস্টেম (ইডিএস) দ্বারা সকল কার্গো ও মেইল শতভাগ তল্লাশি করা, শতভাগ এক্সপ্লোসিভ টেস্ট ডিটেকশন (ইটিডি) অথবা শতভাগ এক্সপ্লোসিভ ডিটেকশন ডগ (ইডিডি)। মন্ত্রী বলেন, ‘আমরা যেটা জানাচ্ছি, আমরা অলরেডি ইডিএস মেশিন কিনেছি ও এটা শিপমেন্টের অপেক্ষায় আছে। ইন্সপেকশনের জন্য ১৯ জুন আমাদের টিম যাচ্ছে। আশা করছি, জুলাই বা আগস্টের প্রথম সপ্তাহে এসে যাবে। ইডিএস এলে আমরা কার্গোতে দিয়ে দেব। স্ক্যানিংয়ের ক্ষেত্রে আমাদের অসুবিধা নেই। দ্বিতীয়ত, ইটিডিতে যেটা বলেছে, এটা অনেক সময়সাপেক্ষ ব্যাপার। কারণ একেকটা ধরে ধরে করতে হয়। আমরা বলেছি, এটা করা সেভাবে সমীচীন হবে না। তৃতীয়, শতভাগ স্ক্যানিং। আমাদের স্ক্যানিং মেশিন আছে। র‌্যাব ও ইপিবিএন কাজ করছে। ইপিবিএন ডগস্কোয়াড কাজ করছে। দু’এক সপ্তাহের মধ্যে পরিপূর্ণ হবে। আমরা ডগস্কোয়াড দিয়ে স্ক্যানিং করাচ্ছি। তাদের তিনটি শর্তের মধ্যে একটি শীঘ্রই ফুলফিল করতে পারছি। আর একটা হয়তো আর দুই মাস সময় লাগবে। শর্তপূরণ না করলে কী হবেÑ এ বিষয়ে মন্ত্রী বলেন, ‘এই মাল যখন যাবে তখন থার্ড কান্ট্রিতে ইডিএস ইন্সপেকশন হবে। এ জন্য দশমিক ৪০ এ্যামাউন্ট চার্জ করবে। কেন হঠাৎ এমন সিদ্ধান্ত নিয়েছে ইইউ প্রশ্ন করা হলে, শুধু বাংলাদেশ নয় কুয়েত, সোমালিয়া, ইজিপ্ট, ইয়েমেনের ওপরও ইউরোপীয় ইউনিয়ন বিধিনিষেধ আরোপ করেছে। বিমানের কার্গো পরিবহনের ক্ষেত্রে নিষেধাজ্ঞা বিমানের ওপর নয়, দেশের ওপর আঘাত। এটা রাজনৈতিকভাবে সমাধান করতে হবে। আমাদের পক্ষ থেকে যেটুকু করার দরকার তা করছি। উল্লেখ্য, গত বছরের মার্চে যুক্তরাজ্য-অস্ট্রেলিয়া ও জার্মান ঢাকা থেকে বিমানের সরাসরি কার্গো ফ্লাইটের ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি করে। এবার ইইউ তাদের নিষেধাজ্ঞার কথা জানায়। পরবর্তী নির্দেশ না দেয়া পর্যন্ত এ নিষেধাজ্ঞা বহাল থাকবে। তবে অন্য দেশের মাধ্যমে রি-স্ক্যানিং করে ইউরোপীয় ইউনিয়নভুক্ত দেশগুলোতে কার্গো রফতানি অব্যাহত থাকবে। এর আগে অস্ট্রেলিয়া, যুক্তরাজ্য ও জার্মানিও অপর্যাপ্ত নিরাপত্তা ও জনবলের অভাবকে দায়ী করে। একই সঙ্গে তারা পণ্য স্ক্যানিংয়ে বিমান ও সিভিল এভিয়েশনের গাফিলতি ও অবহেলাকে দায়ী করেছিল। বাংলাদেশের রফতানির বৃহত্তম গন্তব্য হচ্ছে ইউরোপীয় ইউনিয়ন। এ অবস্থায় ইউরোপীয় ইউনিয়নের কার্গো ফ্লাইট বন্ধ করায় বিমানকে বড় ধরনের মাশুল গুনতে হবে। একই সঙ্গে দেশের অর্থনীতিতে বড় ধরনের ধস নেমে আসবে। এতে ঝুঁকির মুখে পড়বে তৈরি পোশাকসহ রফতানিমুখী বেশকিছু পণ্য। জানা যায়, সিভিল এভিয়েশন বাংলাদেশ থেকে বছরে যুক্তরাষ্ট্র, জার্মানি ও যুক্তরাজ্যসহ ইউরোপীয় ইউনিয়নে প্রায় ১৯ বিলিয়ন ডলারের পণ্য রফতানি হচ্ছে। যার বড় অংশ হচ্ছে তৈরি পোশাক। এর মধ্যে প্রথম হচ্ছে যুক্তরাষ্ট্র আর দ্বিতীয় স্থানে আছে ইইউ। পাশাপাশি এ সিদ্ধান্তে আন্তর্জাতিকভাবে বাংলাদেশের ভাবমূর্তিও নষ্ট হচ্ছে। কিন্তু এসব নিয়ে বিমান ও সিভিল এভিয়েশনের শীর্ষ কর্তাদের কোন মাথাব্যথা নেই। সিভিল এভিয়েশনের পরিচালক ফ্লাইট সেফটি এ্যান্ড রেগুলেশন উইং কমান্ডার চৌধুরী জিয়া উল কবির বলেন, সরাসরি কার্গো ফ্লাইট বন্ধ করা প্রসঙ্গে ইইউ সিভিল এভিয়েশনকে আনুষ্ঠানিকভাবে কোন চিঠি দেয়নি। তবে তারা বাংলাদেশকে ঝুঁকিপূর্ণ তালিকার দেশগুলোতে অন্তর্ভুক্তির কথা জানিয়েছে। অর্থাৎ ইইউ কমিশন ইমপিমেন্টেশন রেগুলেশন (ইইউ) ২০১৫/১৯৯৮ অনুযায়ী বাংলাদেশকে এ্যাটাচমেন্ট ৬-১-তে অন্তর্ভুক্ত করেছে। এই অন্তর্ভুক্তির ফলে ইউরোপীয় কমিশন ডিভিশন সি (২০১৫)৮০০৫-এর আলোকে বাংলাদেশ থেকে পাঠানো সব এয়ার কার্গো ও মেইল কনসাইনমেন্ট ‘হাই রিক্স কার্গো এ্যান্ড মেইল’ (এইচআরসিএম) হিসেবে বিবেচিত হবে। এতে বাংলাদেশ থেকে ইউরোপিয়ান ইউনিয়নভুক্ত যে কোন দেশে আনলোড, ট্রানজিট অথবা ট্রান্সফারের উদ্দেশে বহনকৃত সব এয়ার কার্গো ও মেইল কনসাইনমেন্ট ইইউ নিয়ম অনুযায়ী এক্সপ্লোসিভ ডিটেকশন সিস্টেম (ইডিএস) মেশিনে অথবা শতভাগ এক্স-রে স্ক্যানিং এবং শতভাগ এক্সপ্লোসিভ ট্রেস ডিটেনশন (ইটিডি) অথবা শতভাগ এক্স-রে স্ক্যানিং এবং শতভাগ এক্সপ্লোসিভ ডিটেনশন ডগস্কোয়াড (ইডিডি) মেশিনের মাধ্যমে তল্লাশি করে পাঠাতে হবে। তিনি বলেন, ইউরোপীয় ইউনিয়নের শর্তানুযায়ী আগামী দুই মাসের মধ্যে সিভিল এভিয়েশন কর্তৃপক্ষ বিমানের কার্গো কমপ্লেক্সে এক্সপ্লোসিভ ডিটেকশন সিস্টেম বসানোর কাজ সম্পন্ন করবে। ইতোমধ্যে এই সিস্টেমটির জন্য টেন্ডার আহ্বান করা হয়েছে। যে কোম্পানিকে কার্যাদেশ দেয়া হয়েছে তারা যুক্তরাষ্ট্র থেকে এই মেশিনটি ক্রয় করেছে। শীঘ্রই সিস্টেমটি দেশে এসে পৌঁছাবে। তিনি আশা করছেন, আগামী দুই মাসের মধ্যে দুটি ইডিএস মেশিন কার্গো কমপ্লেক্সে বসানো সম্ভব হবে। আরও দুই মাস আগে এই মেশিনটি বসানোর কাজ সম্পন্ন করা সম্ভব হতো। কিন্তু প্রথম দফায় যে টেন্ডার আহ্বান করা হয়েছিল তাতে বাজেটের চেয়ে ব্যয় বেড়ে যাওয়ায় প্রথম টেন্ডার বাতিল করা হয়। এতে দুই মাস পিছিয়ে পড়ে সিভিল এভিয়েশন। তবে তিনি বলেন, বর্তমানে সিভিল এভিয়েশনে ৬টি ডুয়েল ভিউ এক্স-রে স্ক্যানিং মেশিনসহ পর্যাপ্ত ইটিডি মেশিন রয়েছে। পাশাপাশি সম্প্রতি স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অধীন ডিএমপি, র‌্যাব, বিজিবির সহায়তায় স্বল্প পরিসরে এক্সপ্লোসিভ ডিটেনশন ডগ (ইডিডি) টিম মোতায়েন করা আছে। এছাড়াও বিমানবন্দর আর্মড পুলিশ ব্যাটালিয়নের অধীন নতুন একটি এক্সপ্লোসিভ ডিটেনশন ডগ (ডগস্কোয়াড) টিম গঠনের কার্যক্রম প্রক্রিয়াধীন আছে। কাজেই তিনি আশা করছেন, আগমী দুই মাসের মধ্যে ইডিএস মেশিন দুটি বসানো সম্পন্ন হলে ইউরোপীয় ইউনিয়নসহ যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, জার্মানসহ সব দেশ কার্গো রফতানির ওপর নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার করবে।
×