ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ১৬ এপ্রিল ২০২৪, ৩ বৈশাখ ১৪৩১

বাজেটের ঘাটতি পূরণে বিদেশী ঋণের ওপর নির্ভরশীলতা বাড়ছে

প্রকাশিত: ০৫:৩০, ৭ জুন ২০১৭

বাজেটের ঘাটতি পূরণে বিদেশী ঋণের ওপর নির্ভরশীলতা বাড়ছে

আনোয়ার রোজেন ॥ বাজেটের ঘাটতি অর্থ সংস্থানে ক্রমাগত হারে বিদেশী ঋণের ওপর নির্ভরশীলতা বাড়াচ্ছে সরকার। ঘাটতি পূরণে বিদেশী সাহায্যের ওপর নির্ভরশীলতা পাঁচ বছরে বেড়েছে দ্বিগুণেরও বেশি। ২০১৩-১৪ অর্থবছরের মূল বাজেটে ঘাটতি পূরণে বিদেশী ঋণ ধরা হয়েছিল ২১ হাজার ৬৮ কোটি টাকা, আগামী ২০১৭-১৮ অর্থবছরে এর পরিমাণ হবে ৫১ হাজার ৯২৪ কোটি টাকা। তবে বাস্তবতা হলো, মূল বাজেটে বিদেশী ঋণের যে লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়, তার পুরোপুরি বাস্তবায়ন সম্ভব হয় না। গত পাঁচ অর্থবছরের বাজেট বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, অর্থবছর শেষে বিদেশী ঋণের লক্ষ্যমাত্রার মোটামুটি অর্ধেক অর্জন সম্ভব হয়। যদিও এ সময়ে বিদেশী ঋণ ছাড়ের পরিমাণ সামগ্রিকভাবে বেড়েছে। এদিকে ঋণ নিয়ে বাজেট ঘাটতি মেটানোর বিষয়ে অর্থনীতিবিদদের মধ্যে মিশ্র প্রতিক্রিয়া রয়েছে। কেউ কেউ বলছেন, ঋণের কারণে সরকারের দায় বাড়ছে। এ কারণে বাজেটে সুদ পরিশোধকে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ ব্যয়ের খাত হিসেবে ধরা হচ্ছে। প্রতিবছরই বাড়ছে দেশী ও বিদেশী উৎস থেকে ঋণ গ্রহণের পরিমাণ। সেই ঋণের সুদ বাবদ বিপুল অঙ্কের টাকা খরচ করতে হচ্ছে সরকারকে। তাই উন্নয়ন কর্মসূচীতে প্রতিনিয়তই কমছে বাজেট ব্যয়। এ অবস্থায় বিদেশী ঋণের পরিবর্তে প্রবৃদ্ধি সহায়ক রাজস্ব ব্যবস্থাপনা নিশ্চিত করা, অভ্যন্তরীণ সম্পদের ব্যবহার ও দক্ষতা বাড়ানোর দিকে মনোযোগ দেয়া উচিত। সপ্তম-পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনাতেও বিদেশী ঋণের ব্যবহার কমিয়ে অভ্যন্তরীণ সম্পদের ব্যবহার বাড়ানোর কথা বলা হয়েছে। আবার কেউ বলছেন, আমাদের বাজেটের আকার উত্তরোত্তর বাড়ছে এবং বাস্তবতা হলো অভ্যন্তরীণ উৎস থেকে সেটার পুরোটা মেটানো সম্ভব নয়। তাই বাজেট বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে বিদেশী ঋণের ব্যবহার গুরুত্বপূর্ণ। বিদেশী ঋণ বাড়লে তেমন কোন অসুবিধা নেই। কারণ এই ঋণের বেশিরভাগই আসে রেয়াতি ঋণ হিসেবে। তাছাড়া এখন পর্যন্ত যে পরিমাণ বিদেশী ঋণ নেয়া হয়েছে, জিডিপির অনুপাতে তা খুবই সহনীয় মাত্রায় রয়েছে। তবে ঋণ যে পরিমাণই নেয়া হোক না, সেটাকে সঠিকভাবে ব্যবহারের দিকে নজর দিতে হবে। মাথাপিছু ঋণ ৩০ হাজার ৭৪০ টাকা বেসরকারী গবেষণা প্রতিষ্ঠান উন্নয়ন অন্বেষণের সাম্প্রতিক প্রতিবেদন মতে, বর্তমানে দেশী ও বিদেশী মিলে মোট ঋণের স্থিতি প্রায় ৪ লাখ ৯১ হাজার ৮৩১ কোটি টাকা, যা জিডিপির ২৭ দশমিক ৫৫ শতাংশ। এর মধ্যে দেশীয় ঋণ ২ লাখ ৮১ হাজার ৩৩১ কোটি এবং বিদেশী ঋণ ২ লাখ ১০ হাজার ৫০০ কোটি টাকা। মাথাপিছু সরকারী ঋণের পরিমাণ ৩০ হাজার ৭৪০ টাকা। সরকারী হিসাবে ২০১৪-১৫ অর্থবছরের মাথাপিছু এ ঋণের পরিমাণ ছিল ২৬ হাজার ১৫২ টাকা। অর্থাৎ গত দুই বছরে মাথাপিছু সরকারী ঋণের পরিমাণ বেড়েছে ৪ হাজার ৫৮৮ টাকা। তবে সার্বিকভাবে মাথাপিছু সরকারী ঋণের এ পরিমাণ মাথাপিছু আয়ের তুলনায় কম। সর্বশেষ প্রাক্কলন অনুযায়ী আমাদের মাথাপছিু আয় ১ লাখ ২৮ হাজার ১৬০ টাকা (১,৬০২ ডলার)। মাথাপিছু আয় ও ঋণের এ অনুপাত ভারত (মাথাপিছু আয় ১ লাখ ২৮ হাজার, ঋণ ৬৫ হাজার ৮১৫ টাকা), পাকিস্তানসহ (মাথাপিছু আয় ১ লাখ ২৫ হাজার ৬৮০ টাকা, ঋণ ৭৬ হাজার ১৮ টাকা) বিশ্বের অন্যান্য দেশের তুলনায় অনেক কম। বিদেশী ঋণের লক্ষ্যমাত্রা বাড়ল দ্বিগুণ অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত আগামী ২০১৭-১৮ অর্থবছরের জন্য যে ৪ লাখ ২৬৬ কোটি টাকার বাজেট দিয়েছেন, তার মধ্যে ঘাটতির পরিমাণ ১ লাখ ১২ হাজার ২৭৫ কোটি টাকা। অর্থাৎ বাজেটের এক-চতুর্থাংশের বেশি টাকা ঋণ নিয়ে মেটাতে হবে। এর মধ্যে বিদেশী ঋণ নেয়া হবে মোট ৫১ হাজার ৯২৪ কোটি টাকা, বাকিটা নেয়া হবে অভ্যন্তরীণ উৎস থেকে। চলতি ২০১৬-১৭ অর্থবছরে বিদেশী ঋণ ৩৬ হাজার ৩০৫ কোটি টাকা ধরেও সংশোধিত বাজেটে কমিয়ে করা হয়েছে ২৮ হাজার ৭৭১ কোটি টাকা। অর্থাৎ আগামী অর্থবছরে বিদেশী ঋণের লক্ষ্যমাত্রা প্রায় দ্বিগুণ বাড়ানো হলো। এটাকে বাজেট বাস্তবায়নের বড় চ্যালেঞ্জ উল্লেখ করে বিশ্বব্যাংকের ঢাকা কার্যালয়ের লিড ইকোনমিস্ট ড. জাহিদ হোসেন বলেন, বিদেশী সহায়তা প্রাপ্তির যে হিসাব দেখানো হয়েছে, সেটা উচ্চাভিলাষী। এতটা খরচ সরকার কখনও করতে পারেনি, এক অর্থবছরে এতটা বিদেশী ঋণও কখনও ছাড় হয়নি। এটা যে সরকার জানে না, তা নয়। তবে এটা কেন হলো, এর কোন ব্যাখ্যা আমার কাছে নেই। উল্লেখ্য, চলতি অর্থবছরের সংশোধিত বাজেটে নিট বিদেশী ঋণ (অনুদান ছাড়া) ধরা হয়েছে ২৪ হাজার ৭৭ কোটি টাকা। গত অথর্বছরে এ খাতে প্রাপ্তি ছিল ১৪ হাজার ৭৫৫ কোটি টাকা। মেগা প্রকল্প আর পাইপলাইনে জমে থাকা অর্থে আশা দেখছে সরকার বাজেটের ঘাটতি অর্থ সংস্থানে ক্রমাগত হারে বিদেশী ঋণের ওপর নির্ভরশীলতার কারণ হিসেবে মেগা প্রকল্পে বিদেশীদের অর্থায়ন এবং পাইপলাইনে পড়ে থাকা অর্থের কথা বলছে সরকার। গত ২০১৫-১৬ অর্থবছরে বিদেশী ঋণের মোট প্রতিশ্রুতি ছিল ৬৯৯ কোটি ৭৯ লাখ মার্কিন ডলার, এর মধ্যে ছাড় হয় ৩৪৪ কোটি ডলার (প্রায় ২৭ হাজার কোটি টাকা)। এটি দেশের একক অর্থবছরের ইতিহাসে সর্বোচ্চ। চলতি অর্থবছরে রূপপুর বিদ্যুত প্রকল্পের জন্য রাশিয়া রেকর্ড ১ হাজার ১৩৭ কোটি ডলার ঋণের প্রতিশ্রুতি দিয়েছে। অবকাঠামোসহ বিভিন্ন খাতে ভারত ও চীনের রয়েছে বিপুল বিনিয়োগের প্রতিশ্রুতি। সবমিলিয়ে বিদেশী ঋণের ছাড় বৃদ্ধির ব্যপারে সরকার আশাবাদী। এ প্রসঙ্গে অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগের (ইআরডি) ভারপ্রাপ্ত সচিব কাজী শফিকুল আজম বলেন, রূপপুরসহ ১০টি মেগা প্রকল্পের কাজ চলছে। আর পাইপলাইনে আছে ৩ হাজার ৫০০ কোটি ডলার বিদেশী ঋণ। এ থেকে ২০ শতাংশের বাস্তবায়ন হলেও অঙ্কটি দাঁড়ায় ৭০০ কোটি ডলার (প্রতি ডলার ৮০ টাকা দরে ৫৬ হাজার কোটি টাকা) এবং আগামী অর্থবছরে তা খুবই সম্ভব। এ প্রসঙ্গে সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) সম্মানীয় ফেলো ড. মোস্তাফিজুর রহমান জনকণ্ঠকে বলেন, বাজেট বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে বিদেশী ঋণের প্রতিশ্রুতি ও সে অনুযায়ী অর্থছাড়Ñ দুটিই গুরুত্বপূর্ণ। কারণ আমাদের বিদেশী ঋণের বেশিরভাগ সহজ শর্তের ঋণ, যার সুদের হার ১ শতাংশেরও কম। ঋণ পরিশোধে সময়ও বেশি পাওয়া যায়। বিদেশী সাহায্যপুষ্ট প্রকল্প দ্রুত বাস্তবায়ন করতে পারলে একদিকে যেমন বিদেশী ঋণের ছাড় বাড়বে, অন্যদিকে অভ্যন্তরীণ খাত থেকে সরকারের উচ্চ সুদে ঋণ গ্রহণও কমে আসবে। কিন্তু বিদেশী সাহায্য অর্জনের সার্বিক লক্ষ্যমাত্রার তুলনায় আমরা এখনও বেশ পিছিয়ে আছি। তবে চলতি অর্থবছর বিদেশী ঋণের যে দ্বিগুণ লক্ষ্যমাত্রা ঠিক করা হয়েছে, সেটিকে বাস্তবসম্মত বলে মনে করেন না এই অর্থনীতিবিদ। সপ্তম-পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনার প্রতিফলন নেই বাজেটে সপ্তম-পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনায় রাজস্ব ঘাটতি ও অর্থায়ন অংশে মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) শতাংশ হিসাবে বিদেশী ঋণের যে প্রাক্কলন করা হয়েছে, বাজেটে তার প্রতিফলন নেই। ২০১৫-১৬ থেকে ২০১৯-২০ এই পাঁচ অর্থবছরে জিডিপির শতাংশ হিসাবে বিদেশী ঋণের পরিমাণ কমিয়ে ১ শতাংশে আনার কথা বলা হয়েছে। এর অংশ হিসেবে ২০১৭-১৮ অর্থবছরে বিদেশী ঋণ জিডিপির ১ দশমিক ২ শতাংশ প্রাক্কলন করা হয়েছে। কিন্তু প্রস্তাবিত বাজেটে এটি ২ দশমিক ৩ শতাংশ, যা প্রাক্কলনের প্রায় দ্বিগুণ। এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (বিআইডিএস) সাবেক মহাপরিচালক ড. মোস্তফা কে মুজেরি জনকণ্ঠকে বলেন, আমাদের উন্নয়নের ধারাটা এমন হয়ে যাচ্ছে, যা আমাদের বিদেশী বিনিয়োগ নির্ভরশীলতা বাড়িয়ে তুলছে। সপ্তম-পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনায় আমরা উন্নয়নের যে গতিধারা প্রাক্কলন করেছি, সেই পথে আমরা পুরোপুরি চলতে পারছি না। পরিকল্পনা অনুযায়ী, আস্তে আস্তে বিদেশী সাহায্য নেয়ার পরিমাণ কমিয়ে আনা এবং অভ্যন্তরীণ সম্পদের ব্যবহার বাড়ানোর কথা। কিন্তু আমাদের অভ্যন্তরীণ বিনিয়োগ বাড়ছে না। বিশেষ করে বেসরকারী খাতে বিনিয়োগ স্থবিরতা লক্ষ্য করা যাচ্ছে। এটা একটা বড় দুর্বলতা। সরকারী খাতে ঋণের পরিমাণ অন্যান্য দেশের তুলনায় বাংলাদেশে অনেক কম। আমাদের ঋণ পরিশোধ করার সক্ষমতাও ভাল। কিন্তু পুঞ্জীভূত ঋণের বোঝা বাড়ছে, এটাও খেয়াল রাখতে হবে। উল্লেখ্য, আগামী ২০১৭-১৮ অর্থবছরে সুদ পরিশোধে ব্যয় ধরা হয়েছে ৪১ হাজার ৪৫৭ কোটি টাকা; যা মোট বাজেটের ১০ দশমিক ৪ শতাংশ। এর মধ্যে অভ্যন্তরীণ সুদ বাবদ ৩৯ হাজার ৫১১ কোটি টাকা ও বিদেশী ঋণের সুদ বাবদ ১ হাজার ৯৪৬ কোটি টাকা পরিশোধ করা হবে।
×