ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

ইতিহাসে কিংবদন্তি জিদান

প্রকাশিত: ০৫:০৭, ৭ জুন ২০১৭

ইতিহাসে কিংবদন্তি জিদান

জীবন্ত কিংবদন্তি। খেলোয়াড় হিসেবে জিনেদিন জিদান ছিলেন সর্বকালের সেরাদেরই একজন। এবার প্রমাণ করলেন কোচ হিসেবেও তিনি ইতিহাস সেরা। রিয়াল মাদ্রিদের কোচ হিসেবে প্রথম মৌসুমেই বাজিমাত করেছেন জিদান। গত মৌসুমে প্রধান কোচ দায়িত্ব নেয়ার ছয় মাসের মধ্যেই রিয়াল মাদ্রিদকে জিতিয়েছিলেন উয়েফা চ্যাম্পিয়ন্স লীগ। এ মৌসুমে নিজের সেই কীর্তিকেও ছাপিয়ে গেলেন ফরাসি কোচ। দীর্ঘ পাঁচ বছর পর গত মাসেই রিয়াল মাদ্রিদকে উপহার দেন লীগ শিরোপা। শনিবার জুভেন্টাসকে হারিয়ে উয়েফা চ্যাম্পিয়ন্স লীগের শিরোপাও জেতালেন জিনেদিন জিদান। নিজের প্রজন্মের সেরা ফুটবলারই বলা হয় তাকে। ১৯৯৮ সালে ফ্রান্সের হয়ে বিশ্বকাপ জিতেছেন। ২০০৬ সালে টাইব্রেকার-ভাগ্যে বিশ্বকাপের দ্বিতীয় শিরোপাটা জিততে পারেননি। জিনেদিন জিদান ফুটবল-প্রতিভা, ক্রীড়াশৈলী বিবেচনায় খেলোয়াড় হিসেবে শ্রেষ্ঠত্বের আসনে বসেছেন অনেক আগেই। কিন্তু রিয়াল মাদ্রিদের মতো দলের কোচের গুরুদায়িত্ব কাঁধে নেয়ার মাত্র ১৭ মাসের মধ্যেই যে তিনি কোচ হিসেবে ‘অমরত্বের’ তালিকায় নাম লেখাবেন, সেটি বোধ হয় ভাবতে পারেননি ফরাসী কিংবদন্তি নিজেও। ২০১৬ সালের ৯ জানুয়ারি থেকে ২০১৭ সালের ৩ জুন, এই সময়ের মধ্যেই দুটি চ্যাম্পিয়ন্স লীগ, একটি করে স্প্যানিশ লা লীগা, উয়েফা সুপার কাপ এবং ফিফা ক্লাব বিশ্বকাপের শিরোপা জয়ের স্বাদ পান জিনেদিন জিদান। এর ফলে রিয়াল মাদ্রিদের ফরাসী কোচও ঢুকে গেছেন এলিট কোচদের লিস্টে। উয়েফা চ্যাম্পিয়ন্স লীগের ফাইনালে কার্ডিফে জুভেন্টাসের মুখোমুখি হয়েছিল রিয়াল মাদ্রিদ। সেই ম্যাচে রোনাল্ডোর গোলে এগিয়ে যাওয়ার পর মারিও মানজুকিচের দুর্দান্ত এক গোলে চাপে পড়ে গিয়েছিল রিয়াল। ১-১ গোলে প্রথমার্ধ শেষ হওয়ার পর দ্বিতীয়ার্ধেই পুরো বদলে যাওয়া দল তারা। বিরতির সময় কী বলেছিলেন জিদান? সংবাদ সম্মেলনে এমন প্রশ্নের উত্তরে জিদান কেবল হাসেন, ‘তেমন কিছুই না। প্রথমার্ধে দল যা খেলেছে, সেটাই চালিয়ে যেতে বলেছিলাম। অবশ্য খেলাটা খেলতে বলেছিলাম দুই পাশে জায়গা করে নিয়ে। পাশাপাশি বলেছিলাম, বল পেলে খেলোয়াড়রা যেন সেভাবেই খেলে, যেভাবে তারা খেলতে চায়, কিংবা খেলতে পারে।’ ২০১৫ সালে কার্লো আনচেলত্তির অধীনে শিরোপাহীন এক মৌসুম কাটায় রিয়াল। এরপরই দায়িত্ব দেয়া হয় রাফায়েল বেনিতেজকে। কিন্তু ছয় মাসের মধ্যেই দুটি শিরোপা দৌড় থেকে ছিটকে পরে ‘লস ব্ল্যাঙ্কোস’রা। জানুয়ারি মাসে হঠাৎ করেই রিয়াল সভাপতি ফ্লোরেন্তিনো পেরেজ একটা জুয়া খেললেন। কোচের দায়িত্ব তুলে দিলেন ‘অনভিজ্ঞ’ জিদানের কাঁধে। সিদ্ধান্তটার সমালোচনা হয়েছে অনেক। সমালোচকরা খুব সম্ভবত জিদানের খেলোয়াড়ি প্রজ্ঞা আর ক্লাবের প্রতি তাঁর ভালবাসার ব্যাপারটা ভুলে গিয়েছিল। এর পরের ঘটনাবলী তো শুধুই ইতিহাসই। ২০০২ সালে বেয়ার লেভারকুসেনের বিপক্ষে চ্যাম্পিয়নস লীগ ফাইনালে তাঁর গোলেই জিতেছিল রিয়াল মাদ্রিদ। ১৫ বছরের মাথায় কোচ হিসেবে চ্যাম্পিয়নস লীগের শিরোপা জিতে আরিগো সাচ্চির পর প্রথম কোচ হিসেবে টানা দুইবার ইউরোপ-সেরা দলের কোচ জিদান। যে কৃতিত্ব স্যার এ্যালেক্স ফার্গুসন, জোশে মরিনহো কিংবা পেপ গার্ডিওলাদের নেই, সেই কৃতিত্ব জিদান নিজের করে নিলেন রিয়ালের ‘বি’ টিমের সহকারী কোচের অভিজ্ঞতাকে পুঁজি করেই! ভাগ্যের বরপুত্র বোধ হয় জিদানদেরই বলে। জিদান অবশ্য এত কিছু হাতে পেয়েও অসম্ভব বিনয়ী, ‘ফার্গুসন, মরিনহো, গার্ডিওলা, যে কোচদের নাম নেয়া হচ্ছে, তাঁরা সকলেই দুর্দান্ত কোচ। আমি তাদের চেয়ে সেরা এটা বলার সাহস আমার নেই। আমি দুর্দান্ত একটা দল পেয়েছি। এটাই আমার সাফল্যের মূল।’ জিদানের অধীনেই এ মৌসুমে পাঁচ বছর পর লা লীগার শিরোপা জিতেছে রিয়াল। চ্যাম্পিয়নস লীগ জিতে ১৯৫৮ সালের পর প্রথমবারের মতো একই সঙ্গে লীগ ও ইউরোপ-সেরার আসনে রিয়াল। অনন্য এই সাফল্যের নেপথ্য কারিগর জিদানের সবচেয়ে বড় গুণ হলো কোচ হিসেবে গোটা দলের শ্রদ্ধা ও সম্মান আদায় করে নেয়া। যা খুব ভাল করেই পারেন ৪৪ বছর বয়সী জিদান। ইতিহাস সৃষ্টির শিরোপা জয়ে আনন্দে-উদ্বেলিত রিয়ালের এই ফরাসী কোচ বার্নাব্যুতেই থেকে যাওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। এ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘আমি এই এখানে অনেক বছর খেলেছি। এই ক্লাব আমার প্রাণ।’ যদিও ক’দিন আগেই জানিয়েছিলেন, আগামী মৌসুমে থাকবেন কিনা এই বিষয়ে নিশ্চিত নন তিনি। তবে চ্যাম্পিয়ন্স লীগ জয়ের পর বার্নাব্যুতেই চাকরি চালিয়ে যাওয়ার পরিকল্পনার কথা নিশ্চিত করেছেন তিনি। অতি দ্রুতই আগামী মৌসুম নিয়ে কাজও শুরু করবেন জিদান। তার মতে, ‘অবশ্যই আমি থাকছি। এখন আমাদের আগামী মৌসুম নিয়ে চিন্তা করতে হবে। আমি আমার পুরো জীবন এখানেই কাটাব কিনা তা আমি নিশ্চত নই। কিন্তু আমি খুব আনন্দিত এবং অসাধারণ কিছু খেলোয়াড়ের সঙ্গে কাজ করার সুযোগ দেয়ার জন্য আমি এই ক্লাবের কাছে কৃতজ্ঞ। আমার চুক্তির আরও এক বছর বাকি।’ এ সময় জিদান আরও বলেন, ‘অবশ্যই তারা ইতিহাস সৃষ্টি করেছে। কেউই এটা করতে পারেনি। কিন্তু আমরা পেরেছি। সকল মাদ্রিদ সমর্থক, খেলোয়াড়, আমার এবং সকলের জন্য এই দিনটা ঐতিহাসিক। পরের বছর এটা আরও কঠিন হবে। আমাদের অনেক পরিশ্রম করতে হবে শিরোপা জেতার জন্য। তবে আমরা বলতে পারি, আমরা খুবই ভাল একটা দল। লা লীগা এবং চ্যাম্পিয়ন্স লীগের শিরোপা আমাদের প্রাপ্য ছিল।’ মৌসুমে সফলতার প্রধান কারণ হিসেবে খেলোয়াড়দের কঠোর পরিশ্রমকে উল্লেখ করে জিদান বলেন, ‘এখানে অনেক মেধাবী খেলোয়াড় আছে। তাদের কঠোর পরিশ্রমেই এই সফলতা। একজন কোচ হিসেবে আমি তাদের জন্য গর্ববোধ করি।’ অসামাণ্য এই কীর্তিতে কোচ জিদানের প্রশংসায় পঞ্চমুখ রিয়াল মাদ্রিদের প্রেসিডেন্ট ফ্লোরেন্তিনো পেরেজও। রিয়ালের সদ্য সাবেক দুই কোচ জোশে মরিনহো এবং কার্লো আনচেলত্তির কাজের ধরনও পছন্দ করতেন পেরেজ। তার মতে, ‘তুমি, তোমার সহকারী কোচ এবং এই দলটি মিলে অসাধারণ ফুটবল উপহার দেয়ার মধ্য দিয়ে ইতিহাস গড়েছ। রিয়াল মাদ্রিদ মৌসুমের প্রতিটা ম্যাচেই গোল করার অবিশ্বাস্য কীর্তি গড়েছে। এর মধ্য দিয়ে আমাদের ক্লাবের দর্শনটাই প্রমাণিত হয়েছে। লীগ শিরোপা জেতাটা ছিল আমাদের জন্য অসাধারণ ব্যাপার। এটা অর্জন করতে আমাদের শেষ ম্যাচ পর্যন্ত লড়াই করতে হয়েছে। আমাদের প্রতিপক্ষকে ধন্যবাদ। তারা আমাদের কাজটা কঠিন করে তুলেছিল। এই দলটি আমাদের সবকিছুই দিয়েছে, যা আমরা দীর্ঘ দিন ধরে চেয়ে আসছি।’
×