ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ২৩ এপ্রিল ২০২৪, ১০ বৈশাখ ১৪৩১

শত একর জমি জবরদখল

প্রকাশিত: ০৪:০২, ৭ জুন ২০১৭

শত একর জমি জবরদখল

স্টাফ রিপোর্টার, ময়মনসিংহ ॥ ফুলবাড়িয়া উপজেলার এনায়েতপুর ইউনিয়নের দুলমা মৌজার প্রায় ১০০ একর জমি জবরদখল করে দেয়াল নির্মাণের অভিযোগ পাওয়া গেছে। প্রায় এক বছর ধরে এই জবরদখলের ঘটনা ঘটে। এর মধ্যে জামালপুরে কর্মরত স্থানীয় সরকার প্রকৌশল বিভাগ (এলজিইডি)-তে কর্মরত এক নির্বাহী প্রকৌশলীর পৈত্রিক ও ক্রয় সূত্রের ১৭ একর জমিসহ সরকারী বনের, এসডিএস নামের এনজিও সংস্থার ও স্থানীয় নানা শ্রেণী-পেশার মানুষের জমি রয়েছে। অভিযোগ রয়েছে, ভুয়া ও জাল দলিলে মালিকানা দাবি করে গু-া-মাস্তান দিয়ে জমি জবরদখলের পর স্থানীয় থানা পুলিশ পাহারায় দেয়াল নির্মাণ করা হয়। এ সময় জুমুল ও উচ্ছেদের শিকার হয়েছে সরকারী কর্মকর্তার কেয়ারটেকারসহ অন্তত ২৫ পরিবার। বাধা ও প্রতিবাদ করায় ষড়যন্ত্রমূলক মামলায় জেল ও নির্যাতনের শিকার হয়েছে অনেকে। ভুক্তভোগীদের অভিযোগ, ময়মনসিংহের সাবেক পুলিশ সুপার বর্তমানে নারায়ণগঞ্জে পুলিশ সুপার হিসেবে কর্মরত মঈনুল হক ও তার আত্মীয় পরিচয়দানকারী কবিরুল আলম এই জায়গা জবরদখল করে ‘আভা কৃষি খামার’-এর সাইনবোর্ড ঝুলিয়ে দিয়েছেন। জবরদখলের এই ঘটনায় সরকারদলীয় স্থানীয় সংসদ সদস্য এ্যাডভোকেট মোসলেম উদ্দিন ও স্থানীয় ইউপি চেয়ারম্যান কবীর হোসেন তালুকদারের সায় ছিল বলে প্রচার রয়েছে এলাকায়। এই ঘটনায় ফুলবাড়িয়া থানা পুলিশ কোন মামলা নেয়নি। পরে ময়মনসিংহ আদালতে কবিরুল আলম ও মালেকা বেগমকে বিবাদী করে মামলা দায়ের করেন উচ্ছেদের শিকার নির্বাহী প্রকৌশলী নজরুল ইসলাম। মামলাটি এখন বিচারাধীন। এদিকে এলজিইডির নির্বাহী প্রকৌশলী নজরুল ইসলামের এক আবেদনের প্রেক্ষিতে অতিরিক্ত পুলিশ মহাপরিদর্শক (প্রশাসন ও অপারেশন) মোখলেছুর রহমান ময়মনসিংহের পুলিশ সুপারকে ঘটনাটি গুরুত্বের সঙ্গে দেখে দায়ীদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণের নির্দেশ দিয়েছেন। এ ব্যাপারে জানতে চাইলে কবিরুল আলম যা খুশি লিখে দেন বলে ফোন কেটে দেন। জবরদখলের ঘটনায় এলাকায় চাপা ক্ষোভ ও অসন্তোষ বিরাজ করছে। স্থানীয় দুলমা গ্রামের হোমিও চিকিৎসক এমআরএ শফিকের ১৯ শতাংশ জমিতে বসতভিটাসহ ফসলি জমি, ফলমূলের বাগান ও বাপ-দাদার পুরনো কবরস্থান ছিল। এই জমি বিক্রি করতে রাজি না হওয়ায় কবিরুল আলমের ভাড়া করা গু-া-মাস্তানরা শফিক ও তার পরিবারকে বসতভিটা থেকে জোরপূর্বক বের করে টিনের চাল ও আসবাবপত্র দেয়ালের বাইরে ফেলে দেয়। ঘটনা জানিয়ে ময়মনসিংহ রেঞ্জের ডিআইজি চৌধুরী আবদুল্লাহ আল মামুনের কাছে নালিশ করেছিলেন শফিক। প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য ফোন করে শফিককে পাঠানো হয় ময়মনসিংহের সাবেক পুলিশ সুপার মঈনুল হকের কাছে। অভিযোগ, পুলিশ সুপার শফিককে গালমন্দ করে হুমকি দিয়ে বের করে দেন। এর পরদিন শফিককে সন্ত্রাস দমন আইনের এক পুরনো মামলায় গ্রেফতার করা হয়। ৩ মাস জেল খাটার পর জামিনে ছাড়া পায় শফিক। মাথা গোঁজার ঠাঁই না থাকায় শফিক স্ত্রী-সন্তান নিয়ে এখন থাকছেন পরের বাড়িতে! এই ঘটনার তদন্তপূর্বক দৃষ্টান্তমূলক বিচার দাবি করেছেন তিনি। একই গ্রামের আতর আলীর ছেলে মোতালেব ৬৩ শতাংশ জমি বিক্রি করতে রাজি না হওয়ায় তার পুত্র আলীমকে পুলিশ ধরে নিয়ে যায় এবং স্থানীয় সাপমারা বাজারে প্রকাশ্য বেদমভাবে মারপিট করে। আলীমকে ভর্তি করা হয় ময়মনসিংহ মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে। পরে জমি বিক্রি করে দিতে বাধ্য হয় মোতালেব। এলাকা ছেড়ে মোতালেব এখন ভালুকার চামাদি গ্রামে থাকছেন। একই কায়দায় মারধরসহ হুমকি দিয়ে জোরপূর্বক উচ্ছেদ করা হয় মৃত শামছুল হকের ছেলে আশরাফুল, চাঁন মাহমুদের ছেলে আবদুল গফুর, ইয়াদ আলীর ছেলে বিল্লাল হোসেন, মৃত ইয়াকুব আলীর ছেলে হাবিবুর রহমানসহ অন্তত ২৫ পরিবারকে। আবদুল গফুরের অভিযোগ, তার ২১ শতাংশ জমি জোরপূর্বক জবরদখলের পর দলিল রেজিস্ট্রি করে দিতে বাধ্য করা হলেও এখনও পাননি জমির টাকা। স্থানীয় ভ্যানচালক আশরাফুলের ২ ভাই ও ২ বোনের দখলে ছিল ৪২ শতাংশ জমি। ভয়ভীতি দেখিয়ে বিক্রি করতে বাধ্য করা হয়। ২০ লাখ টাকার জমির দাম নির্ধারণ করে দেয়া হয়েছে মাত্র ৬ লাখ টাকা! দেয়াল নির্মাণের সময় গফুরের ছেলে মনিরুজ্জামানের ২১ শতাংশ জমি ভেতরে পড়ে যায়। দলিলপত্র না করেই দখলে নেয়া হয় এই জমি। থানা পুলিশ ও গু-া-মাস্তান পাহারায় দেয়াল নির্মাণ করায় বাধা দেয়ার সাহস পায়নি মনিরুজ্জামান। নির্বাহী প্রকৌশলী নজরুল ইসলামের ভাই আবু বকর সিদ্দিক জানান, ভালুকার বাউন্ডারি শহীদ, স্থানীয় ইউপি চেয়ারম্যানের ভাই কাইয়ুম, জমির দালাল জলিল মেম্বর, দুলু মিয়া, শফিক, নজরুল, শামছুল হক ও মঞ্জুসহ ভাড়া করা মাস্তান এবং ফুলবাড়িয়া থানা পুলিশের পাহারায় দিনে ও রাতে জেনারেটর জ্বালিয়ে দেয়াল নির্মাণ করা হয়। স্থানীয় বিট কর্মকর্তা অভিযোগ করে জানান, কাহালগাঁও মৌজায় তাদের ৫৭ ও ৪১ দাগে বনের জমি জবরদখল করা হয়েছে। দেয়াল নির্মাণের সময় বাধা দেয়া হয়েছে। ভেঙ্গে দেয়া হয়েছে একাধিকবার। তারপরও বনের জমি রক্ষা করা যায়নি। জবরদখলের ঘটনায় বন বিভাগের পক্ষ থেকেও মামলা করা হয়েছে বলে জানান তিনি। স্থানীয়দের দাবি ময়মনসিংহের সাবেক পুলিশ সুপার মঈনুল হক ও ফুলবাড়িয়া থানার সাবেক ওসি রিফাত জবরদখলের সঙ্গে জড়িত বলে অভিযোগ করেও কোন প্রতিকার মেলেনি। পুলিশ সুপার মঈনুল হককে এলাকায় দেখা না গেলেও ফুলবাড়িয়া থানা পুলিশের উপস্থিতি ও জবরদখলকারীদের পক্ষে পুলিশের প্রকাশ্য সহায়তা প্রমাণ করে পুলিশ সুপারের সঙ্গে জড়িত-অভিযোগ এলাকাবাসীর। এসব ঘটনায় ময়মনসিংহ রেঞ্জের ডিআইজি চৌধুরী আবদুল্লাহ আল মামুন জানান, সুনির্দিষ্ট অভিযোগ পেলে পুলিশ কিংবা প্রভাবশালী যে কোন মহলই দখলে জড়িত থাকুক না কেন, ব্যবস্থা নেয়া হবে।
×