ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

বিশ্বের অনেক দেশের তুলনায় করহার বাংলাদেশে কম

প্রকাশিত: ০৩:৫৮, ৭ জুন ২০১৭

বিশ্বের অনেক দেশের তুলনায় করহার বাংলাদেশে কম

রহিম শেখ ॥ বিশ্বের অনেক দেশের তুলনায় তামাকে কর বাংলাদেশে এখনও অনেক কম। তাই ধূমপানবিরোধী নানা প্রচার-আয়োজনের পরও তামাকের ব্যবহার কমছে না। অপেক্ষাকৃত কম দাম ও সহজলভ্যতার কারণে বরং তরুণদের মধ্যে ধূমপানের প্রবণতা বাড়ছে। তাই বেশি কর আরোপ করে সিগারেটসহ তামাকপণ্যের দাম বাড়িয়ে ক্ষতিকর এ পণ্যের ব্যবহার নিরুৎসাহিত করার পরামর্শ সংশ্লিষ্টদের। অন্যদিকে বিশ্বে সবচেয়ে কম দামে সিগারেট পাওয়া যায় এমন তিনটি দেশের মধ্যে একটি হচ্ছে বাংলাদেশ। এরপরই অবস্থান করছে নেপাল ও মিয়ানমার। তামাক পণ্যে সুনির্দিষ্ট করারোপ করলে সরকার তামাক পণ্য থেকে বছরে সাড়ে ছয় হাজার কোটি টাকার অতিরিক্ত রাজস্ব পাবে বলে দাবি করেছে তামাকবিরোধী কয়েকটি সংগঠন। জানা গেছে, পৃথিবীর সবচেয়ে বেশি তামাক সেবনকারী দেশগুলোর একটি বাংলাদেশ। দেশের চার কোটি ৬০ লাখেরও (প্রাপ্তবয়স্ক জনগোষ্ঠীর ৪৩ শতাংশ) বেশি মানুষ সিগারেট, বিড়ি, ধোঁয়াবিহীন তামাক বা অন্যান্য তামাকপণ্যে অভ্যস্ত। এর চেয়েও বড় আতঙ্কের বিষয় হলো, তরুণ সমাজ ধূমপানের দিকে আকৃষ্ট হচ্ছে বেশি। তামাকবিরোধী সংগঠন প্রজ্ঞার তথ্য অনুযায়ী, দেশে কিশোর-কিশোরীদের মধ্যে তামাকে আসক্তি উদ্বেগজনক পর্যায়ে পৌঁছাচ্ছে। বাংলাদেশে ১৩ থেকে ১৫ বছর বয়সীদের প্রায় ৭ শতাংশই ধূমপান করে। তামাকের ব্যবহার কমানোর লক্ষ্যে গৃহীত ব্লুমবার্গ ইনিশিয়েটিভের পাঁচটি ফোকাস কান্ট্রির অন্যতম বাংলাদেশ। উন্নয়নশীল দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশই প্রথম ২০০৩ সালে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার ফ্রেমওয়ার্ক কনভেনশন অন টোবাকো কন্ট্রোল (এফসিটিসি) স্বাক্ষর করে। এ সনদের ৬ অনুচ্ছেদে স্বাক্ষরকারী দেশগুলোর সরকারকে তামাকের ব্যবহার কমাতে কর বাড়ানোর কথা বলা হয়েছে। তামাকের ব্যবহার কমাতে বাংলাদেশ প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার এফসিটিসিও পুরোপুরি বাস্তবায়নের লক্ষ্যে সরকার কাজ করবে এমন প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা (এসডিজি) বাস্তবায়ন নিয়ে ঢাকায় অনুষ্ঠিত দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার স্পীকারদের সম্মেলনে ২০৪০ সালের মধ্যে বাংলাদেশকে তামাকমুক্ত করার ঘোষণাও দিয়েছেন তিনি। তামাকবিরোধী সংগঠনগুলোর তথ্য মতে, অনেক দেশের তুলনায় তামাকে কর বাংলাদেশে এখনও কম। তাই ধূমপানবিরোধী নানা প্রচার-আয়োজনের পরও তামাকের ব্যবহার কমছে না। অপেক্ষাকৃত কম দাম ও সহজলভ্যতার কারণে বরং তরুণদের মধ্যে ধূমপানের প্রবণতা বাড়ছে। তাই বেশি কর আরোপ করে সিগারেটসহ তামাকপণ্যের দাম বাড়িয়ে ক্ষতিকর এ পণ্যের ব্যবহার নিরুৎসাহিত করার পরামর্শ তাদের। ঢাকা আহসানিয়া মিশনের স্বাস্থ্য খাতের প্রধান ইকবাল মাসুদ বলেন, এফসিটিসিতে তামাক নিয়ন্ত্রণে যে পদক্ষেপগুলোর কথা বলা হয়েছে তার মধ্যে করারোপের ব্যবস্থাটি খুব কমই কাজে লাগানো হয়েছে। তাই জীবন রক্ষা ও রাজস্ব আয় বাড়ানোর দীর্ঘমেয়াদী কৌশলের অংশ হিসেবে তামাকে কর বাড়ানোর যথেষ্ট সুযোগ রয়েছে। তামাকবিরোধী সংগঠন প্রজ্ঞা আগামী অর্থবছরে বিভিন্ন তামাকপণ্যের ওপর কর বাড়ানোর সুপারিশ করে বলেছে, প্রতি ১০ শলাকার নিম্নস্তরের সিগারেটের প্যাকেটে ২৫.৯৫, উচ্চস্তরের সিগারেটে ৪৯.৬০ ও প্রিমিয়াম স্তরের সিগারেটে ৮২ ধারা কর আরোপ করতে হবে। এর বাইরে সব তামাকপণ্যের খুচরা মূল্যে ১৫ শতাংশ ভ্যাট বহাল থাকবে। একই সঙ্গে নিম্নস্তরে ১০ সিগারেটের প্যাকেটের খুচরা মূল্য ২৩ টাকা থেকে বাড়িয়ে ৪০, উচ্চস্তরের প্যাকেট মূল্য ৪০ ও প্রিমিয়াম স্তরের মূল্য ১২০ টাকা করতে হবে। এতে সরকার সিগারেট থেকে পাঁচ হাজার ২০০ কোটি টাকা বাড়তি রাজস্ব পাবে। একইভাবে বিড়ির দাম বাড়ালে সেখানেও অতিরিক্ত এক হাজার ৩০ কোটি টাকা রাজস্ব আসবে। অন্যান্য তামাক পণ্যের খুচরা মূল্য বাড়িয়েও আরও রাজস্ব আয় করতে পারে সরকার। সব মিলিয়ে অতিরিক্ত রাজস্ব আয় ছয় হাজার ৫০০ কোটি টাকা দাঁড়াবে। সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা জানান, বেশি দামের সিগারেটে সরকার রাজস্ব পায় বেশি। করহার অনেক কম হওয়ায় বাংলাদেশীদের মধ্যে ধূমপানের প্রবণতা বেশি। আরও কর বাড়িয়ে এটিকে নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব উল্লেখ করে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, বাংলাদেশে তামাকের ওপর যে কর রয়েছে, তার প্রায় দ্বিগুণ কর ভারত আরোপ করেছে। শ্রীলঙ্কায়ও সিগারেটের ওপর করহার বাংলাদেশের চেয়ে অনেক বেশি। তামাকবিরোধী সংগঠন প্রগতির জন্য জ্ঞানের (প্রজ্ঞা) এক গবেষণায় দেখা গেছে, ২০০৬ থেকে ২০১৩ সাল, এ ৬ বছরে ব্রাজিল সিগারেটের কর বাড়িয়েছে প্রায় ১১৬ শতাংশ। ফলে এ সময়ে দেশটিতে সিগারেটের ব্যবহার কমেছে ৩২ শতাংশ। অপরদিকে রাজস্ব বেড়েছে ৪৮ শতাংশ। মেক্সিকোতে ২০০৯ থেকে ২০১১ সাল, দুই বছরে ২০ শলাকার সিগারেটের ওপর কর বেড়েশে ৭ শতাংশ। এতে বিক্রি কমেছে ৩০ শতাংশ। সরকার রাজস্ব পেয়েছে ৩৮ শতাংশ বেশি। দক্ষিণ আফ্রিকায় গত ১০ বছরে সিগারেটের কর বেড়েছে ৩২ থেকে ৫২ শতাংশ পর্যন্ত। এতে সিগারেট বিক্রি কমেছে ৩০ শতাংশ। সে দেশের সরকার ৮০০ শতাংশ বেশি রাজস্ব পেয়েছে। ২০০৫ থেকে ২০১১ সালে তুরস্কে সিগারেটের কর বাড়ায় দাম বেড়েছে ১৯৫ শতাংশ পর্যন্ত। এতে বিক্রি কমেছে ১৫ শতাংশ। রাজস্ব আয় বেড়েছে ১২৪ শতাংশ। জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) কর্মকর্তাদের দেয়া তথ্য মতে, বর্তমানে তামাক খাত থেকে ভ্যাট ও সম্পূরক শুল্ক বাবদ বছরে প্রায় ১৩ হাজার কোটি টাকার রাজস্ব পাওয়া যাচ্ছে। এর ৯৮ শতাংশই আসে সিগারেট খাত থেকে। বাকি ২ শতাংশের মধ্যে বিড়ি থেকে দেড় শতাংশ এবং জর্দা, গুলসহ ধোঁয়াবিহীন তামাক থেকে আসে দশমিক ৫ শতাংশ। জাতীয় তামাক নিয়ন্ত্রণ সেলের সমন্বয়ক মোহাম্মদ রুহুল কুদ্দুস জানান, তামাকপণ্যের ওপর ১ শতাংশ স্বাস্থ্য উন্নয়ন সারচার্জ বাবদ গত অর্থবছরে ২৫০ কোটি টাকা আয় হয়েছে। সে হিসাবে ওই অর্থবছরে দেশে ২৫ হাজার কোটি টাকার তামাকপণ্য বিক্রি হয়েছে। চলতি অর্থবছর এই খাত থেকে প্রায় তিন শ’ কোটি টাকা আয় হবে বলে ধারণা করেন তিনি।
×