ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

শাহীন রেজা নূর

ভারত-পাকিস্তান-চীন কিছু প্রাসঙ্গিক কথা

প্রকাশিত: ০৩:৫৩, ৭ জুন ২০১৭

ভারত-পাকিস্তান-চীন কিছু প্রাসঙ্গিক কথা

রাজনৈতিক বিশ্লেষক ও পর্যবেক্ষক মহলের মতে চীন এখন পাকিস্তানে রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিকভাবে প্রভূত প্রভাব বিস্তার করতে সক্ষম হচ্ছে। পাকিস্তানের সামরিক বাহিনী এবং সেখানকার রাজনৈতিক শক্তির ওপর ভর করে কিংবা তাদের নানা ছলে বশ্যতা স্বীকার করিয়ে চীন রীতিমতো পাকিস্তানকে আধুনিককালের এক উপনিবেশে পরিণত করেছে। দু’শ’ বছর আগে ভারতের কিছু রাজ-রাজড়ার সহযোগিতা ও যোগসাজশে ব্রিটিশরা যেমনভাবে ভারতকে তাদের উপনিবেশ বানিয়েছিল, এ যুগে চীনও পাক সেনাবাহিনীর এবং সেখানকার রাজনীতির মূলধারাকে ব্যবহারপূর্বক দক্ষিণ এশিয়ায় নিজেদের স্বার্থসিদ্ধির ক্ষেত্র প্রস্তুত করেছে। উল্লেখ্য, পাকিস্তানের সেনাবাহিনী ও রাজনীতিতে প্রধানত পাঞ্জাবীদেরই আধিপত্য আর সেই পাঞ্জাবী আধিপত্যকে কাজে লাগিয়েই চীন এক্ষেত্রে সাফল্য অর্জন করতে সচেষ্ট। ২০১৭ সালে চীন-পাকিস্তান সম্পর্ক যে পর্যায়ে উপনীত হয়েছে তাতে ভারতকে নিজের নিরাপত্তা, অখ-তা ও সংহতির প্রশ্নে অনেক বেশি মনোযোগী হওয়ার প্রয়োজন দেখা দিয়েছে বলে সেখানকার সামরিক-বেসামরিক বিশেজ্ঞরা মনে করছেন। পাকিস্তানকে চীনের হয়ে দক্ষিণ এশীয় ভূরাজনীতির এক কুশলী খেলোয়াড় হিসেবে নামিয়ে চীন খানিক আত্মপ্রসাদ লাভ করছে বৈকি! এক্ষেত্রে ভারতের প্রতি পাকিস্তানের মনোভঙ্গি এবং নীতি-কৌশল যে ভারতের প্রতি চীনের মনোভঙ্গিরই পরোক্ষ প্রকাশ তা বুঝতে নিশ্চয়ই কারোর কষ্ট হওয়ার কথা নয়। দক্ষিণ এশিয়ায় চীনের যে নীলনক্সা রয়েছে তা বাস্তবায়নে পাকিস্তানকে এহেন কুশীলবে পরিণত করাটা চীনের জন্য জরুরী ছিল, আর তাতে তারা যে সক্ষমও হয়েছে এ ব্যাপারে নিশ্চয়ই কোন মতবিরোধ নেই। বিশেষ করে ভারতের সঙ্গে বিভিন্ন ইস্যু মোকাবেলার ক্ষেত্রে পাকিস্তানের মাধ্যমে চীনের নিজেদের মনোবাঞ্ছা পূরণের বিষয়গুলো যখন স্পষ্ট হয়ে ওঠে তখন তো এ বিষয়ে আর কোন সন্দেহই করা চলে না। এই একবিংশ শতাব্দীর চালচিত্র, চেহারা-অবয়র ইত্যাদি বিশ্লেষণ করে দেখা যায় যে, কোন একটি দেশের ক্ষমতাবান মুরব্বিরা যখন স্বেচ্ছায় তাদের নীতি-নির্ধারণী বিষয়টি নিয়ে শক্তিশালী প্রতিবেশীর সঙ্গে সওদা করে তখনই সে দেশটি এক ধরনের উপনিবেশে পরিণত নয়। বর্তমানে চীন-পাকিস্তান সম্পর্কের ক্ষেত্রে ব্যাপারটি কিন্তু এমনই দাঁড়িয়েছে। পাকিস্তানের পাঞ্জাবী প্রভাবিত সেনাবাহিনী ও পাঞ্জাবী শাসকগোষ্ঠী এক জোট হয়ে তাদের পররাষ্ট্রনীতি, রাজনৈতিক নীতি-কৌশল, অর্থনৈতিক উন্নয়নধারা ও নিজস্ব নিরাপত্তা স্বার্থকে অপরের (এক্ষেত্রে চীনের) স্বার্থের যুপকাষ্ঠে বলি বা জলাঞ্জলি দিয়ে বর্তমানে পাকিস্তানকে যে চীনা উপনিবেশে রূপান্তরিত করেছে এ সত্যটিই কিন্তু দিনকে দিন স্পষ্ট হয়ে উঠছে। পাকিস্তানের এই সেনা ও রাজনৈতিক শাসকরা চীনকে তাদের ‘কৌশলগত পৃষ্ঠপোষকের’ মর্যাদায় আসীন করে নিজেদের গোষ্ঠীস্বার্থ চরিতার্থ করতেই ব্যস্ত। ভারতীয় বিশ্লেষকদের মতে, কৌশলগতভাবে দুর্ভাগ্যজনক হলেও এ কথা সত্য যে, একদিকে পারমাণবিক শক্তিধর ইসলামী প্রজাতন্ত্র হিসেবে নিজেকে জাহির এবং অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে দ্রুতলয়ে উদীয়মান প্রতিবেশী ভারতের সঙ্গে কৌশলগত সমতা অর্জনের দাবিদার পাকিস্তান বিগত কয়েক দশকজুড়ে ভারতের প্রতিদ্বন্দ্বী শক্তিরূপে আত্মপ্রকাশের জন্য চীনের ভূরাজনৈতিক চাপের কাছে নতজানু হয়ে রয়েছে। আর এতে দশকের পর দশক এই অবস্থায় থাকার সুবাদে ২০১৭ সালে এসে নিজেকে চীনের উপনিবেশ হিসেবেই দেখতে পাচ্ছে এখন। যাহোক, কেনা জানে যে, সংখ্যাগরিষ্ঠ পাঞ্জাবীদের দাপট পাকিস্তানের সেনাবাহিনী আর রাজনীতিতে এতই বেশি যে, এদের দৌরাত্ম্য থেকে পাকিস্তানের অন্যান্য অঞ্চলের বাসিন্দাদের মুক্তি অনেকটাই সুদূরপরাহত ব্যাপার বৈ নয়! আর চীন ওই পাঞ্জাবী উর্ধতন সামরিক কর্মকর্তা ও রাজনৈতিক অঙ্গনের পাঞ্জাবী মোড়লদের সহায়তায় নিজ কার্যোদ্ধারে সক্ষম হয়েছে। নিশ্চয়ই এটিও পাকিস্তানের জন্য কম দুর্ভাগ্যজনক নয়। পাকিস্তানে সর্বদাই এ কথা ফলাও করে প্রচার করা হয় যে, চীন ও পাকিস্তানের মধ্যকার সম্পর্ক এতই উচ্চ যে, তা পর্বতের চূড়া ছাড়িয়ে গেছে, আর তা নাকি এতই গভীর যা সমুদ্রের তলদেশকেও হার মানায়! দুই দেশের মধ্যকার এই লৌহদৃঢ় সম্পর্কের কেচ্ছাকাহিনী তারস্বরে সেখানকার শাসকরা বলে বেড়ায় বটে; কিন্তু বাস্তবের চোখ দিয়ে তাকালেই এর অন্তঃসারশূন্যতা ধরা পড়ে। এ যে কতটা ফাঁকা বুলি তা আরও বোঝা যায় পাকিস্তানের রাজনীতি, অর্থনীতি ইত্যাদি বিষয়কে গভীরভাবে বিশ্লেষণ করলে। আসলে এসব বুলি আওড়ানো হয় দেশটির অন্যান্য প্রদেশের অশিক্ষিত, পশ্চাৎপদ ও দরিদ্র জনগোষ্ঠীকে ধোঁকা দেয়ার জন্য। একদিন যেমন ওই পাঞ্জাবী শাসকরা পূর্ব বাংলার বাঙালীদের নানা কথার ফুলঝুরি, মিথ্যাচারে আর গোঁজামিল দিয়ে বশ করতে চেয়েছিল, ঠিক একইভাবে তারা সিন্ধি, বালুচী, পশতুন বা অন্য জাতিগোষ্ঠীর সরলপ্রাণ মানুষগুলোকে ভুলিয়ে রেখেছে। কেউ কেউ অবস্থাদৃষ্টে মনে করেন যে, বর্তমানের পাকিস্তান বুঝিবা জিনজিয়াং প্রদেশের মতোই চীনের আরেকটি মুসলিম প্রদেশে পরিণত হয়েছে। অর্থাৎ চীনাদের কথামতোই সেখানকার শাসকরা ও ক্ষমতাবানরা ওঠে, বসে। চীনের এই ঔপনিবেশিক প্রভাব পাকিস্তানের ওপর কতটা সুদৃঢ় হতে পেরেছে তা জানতে হলে পাকিস্তানের পররাষ্ট্রনীতি প্রক্রিয়ায় চীনের প্রভাব কতটুকু, সেখানকার অর্থনৈতিক ভবিষ্যতের ওপর চীনের কর্তৃত্ব কতখানি এবং সর্বোপরি পাকিস্তানী সেনাকর্তৃত্বের কতখানি গভীরে তারা পৌঁছুতে পেরেছে এই বিষয়গুলো বোঝা দরকার। পাকিস্তানী সেনাবাহিনী কত ব্যাপক ও গভীরভাবে চীনের সামরিক সরঞ্জামাদির খদ্দেরে পরিণত হয়েছে তাও তলিয়ে দেখা দরকার। একাডেমিক ও কৌশলগত মহলে ব্যাপকভাবে এ কথা প্রচারিত যে, পাকিস্তানের সেনাবাহিনীই ভারত, আফগানিস্তান, এমনকি প্রধান প্রধান শক্তিধর দেশ যেমন : রাশিয়া, যুক্তরাষ্ট্র বিষয়ক পররাষ্ট্রনীতি পরিপূর্ণভাবে নিয়ন্ত্রণ করে থাকে। তবে ২০১৭ সালে এসে এই সত্যই এখন প্রতিষ্ঠিত যে, এসব দেশের ব্যাপারে পাকিস্তানের ওই পররাষ্ট্রনীতি আসলে চীনের নিয়ন্ত্রণে। আর চীন তা করে থাকে তাদের বশংবদ পাকিস্তানী সেনাবাহিনীর মাধ্যমে। পাকিস্তানের নীতি-নির্ধারকদের এসব দেশের ব্যাপারে তার পররাষ্ট্রনীতি-কৌশল নির্ধারণকালে তাই ভারত ও আফগানিস্তানের ক্ষেত্রে চীনের কৌশলগত স্পর্শকাতরতা আর প্রধান প্রধান শক্তিশালী দেশগুলোর ব্যাপারেও চীনের নীতিভঙ্গির বিষয়টিকেই মাথায় রাখতে হয়। পাকিস্তানী সেনাবাহিনী ও রাজনৈতিক মুরব্বিদের যোগসাজশে রচিত এই চীন-পাকিস্তান কৌশলগত অবস্থান ২০১৭ সালে স্পষ্টভাবে সকলের চোখে পড়েছে। তাদের মধ্যকার এই বন্ধনের প্রতিফলন অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণভাবে দেখা যায় ভারত, আফগানিস্তান, যুক্তরাষ্ট্র ও রাশিয়ার ব্যাপারে পাকিস্তানের নীতিভঙ্গির মধ্যে। মোদ্দাকথা, পাকিস্তানের রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের রাজনৈতিক চিন্তা ও চেতনার ওপর চীন প্রভাব বিস্তার করতে বা নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হয়েছে সেনাবাহিনীর ক্ষমতাধর পাঞ্জাবী সেনাকর্মকর্তাদের ও পাক রাজনীতিবিদদের মানসজগতে নিজেদের সুপ্রতিষ্ঠিত করার মাধ্যমে। আর এক্ষেত্রে পাকিস্তানে পাঞ্জাবী শাসকদের বা রাজনীতিবিদদের মধ্যেই শুধু নয়, দেশটির অন্যান্য প্রদেশের রাজনীতিবিদদের মধ্যেও এই প্রভাব লক্ষণীয়ভাবে ফুটে উঠেছে বৈকি! পাকিস্তানের রাজনীতিবিদরা তাদের স্ব-স্ব ফায়দা হাসিলের প্রয়োজনেই চীনের এত মাহাত্ম্য বর্ণনা বা গুণকীর্তন করে থাকে। এতে নিজেদের লাভ না থাকলে নিশ্চয়ই তারা যে চীনের প্রশংসায় এতটা পঞ্চমুখ হতো না, সে কথা তো বলাই বাহুল্য! বোঝা দরকার যে, চীন কেন আন্তর্জাতিকভাবে কুখ্যাত সন্ত্রাসী মাসুদ আজহারের ব্যাপারে জাতিসংঘের নিষেধাজ্ঞা আরোপের বিরুদ্ধে ভেটো প্রয়োগ করে তাকে বাঁচানোর পথ বেছে নিয়েছিল? কেনইবা তারা এ জাতীয় সন্ত্রাসীদের ঢাল হিসেবে এগিয়ে আসে? এর আসল কারণ কি এই নয় যে, পাকিস্তান সেনাবাহিনীর অভ্যন্তরে ভারতকে লক্ষ্য করে যে জেহাদী অংশটি সৃষ্টি করা হয়েছে সেই অংশটিকে ঘিরে চীনের কায়েমী স্বার্থ রয়েছে, আর সে স্বার্থ রক্ষার জন্যই চীন ওই কুখ্যাত সন্ত্রাসীদের বাঁচাবার প্রকাশ্য প্রয়াস গ্রহণ করে থাকে। আসলে পাক সেনাবাহিনীর ওই অংশকে কাজে লাগিয়ে ভারতকে অস্থিতিশীল করে তোলার চীনা মতলব হাসিলের পাঁয়তারা ছাড়া এগুলো আর কিছুই নয়। পাকিস্তানের প্রাতিষ্ঠানিকভাবে ক্ষমতাধররা যেরূপ জঘন্য ও নৃশংসভাবে উত্তরাঞ্চলের গিলগিট ও বালতিস্তানে এবং দক্ষিণ আরব সাগরের উপকূলবর্তী বালুচিস্তানের গণআন্দোলন বা জনঅসন্তোষ দমন করতে উদ্যোগী হয়, এর পেছনেও যে চীনা স্বার্থ কাজ করেছে এতে কোনই সন্দেহ নেই। বিশেষজ্ঞরা এ ব্যাপারে বলছেন যে, ওই অঞ্চলে চীনের কৌশলগত স্বার্থ সংরক্ষণ বা চীনা স্বার্থ উদ্ধারের প্রয়োজনেই এই ভয়ঙ্কর ও নির্মম দমনমূলক ব্যবস্থা নেয়া হয়। চীন কর্তৃক পাকিস্তানকে উপনিবেশ হিসেবে ব্যবহারের ক্ষেত্রে আরেকটি বিষয় খুবই প্রণিধানযোগ্য। সেটি এই যে, ২০১৭- তে এসে বলতে গেলে চীন পাকিস্তানের সকল অর্থনৈতিক বিষয়ের ওপর দৃঢ়ভাবে তার ঔপনিবেশিক কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করেছে। বিদ্যুত উৎপাদন, অবকাঠামো উন্নয়ন ইত্যাদি ক্ষেত্রে তো বটেই, এমনকি সেই ঔপনিবেশিক ব্রিটিশ আমলের মতোই চীন আজ পাকিস্তানকে চীনা অর্থনীতির জন্য কাঁচামাল সরবরাহের ক্ষেত্রভূমিতে পরিণত করেছে। পাকিস্তানের বর্তমান ও ভবিষ্যত অর্থনৈতিক উন্নয়ন ধারাকে চীনের কাছে বন্ধক রাখার ব্যাপারে অসাধারণ নৈপুণ্য দেখাতে পেরেছেন চীনা প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং। ২০১৫ সালে ৪৬ বিলিয়ন ডলারের ঋণ সাহায্য প্রদানের ঘোষণার মধ্য দিয়ে তিনি এই কার্যোদ্ধার করেছেন। চীন-পাকিস্তান অর্থনৈতিক করিডরের নামে এই সাহায্য দেয়ার বন্দোবস্ত করা হয়। চীন একে পাকিস্তানী অর্থনীতিকে সম্পূর্ণ রূপান্তরের নীলনক্সা হিসেবে অভিহিত করেছে। কিন্তু বিশদ বিশ্লেষণে প্রতীয়মান হবে যে, এই সাহায্য প্রকারান্তরে পাকিস্তানের ওপর চীনের ঔপনিবেশিক কৌশলগত ও অর্থনৈতিক কর্তৃত্বকে চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের রূপ দেবে মাত্র! এই চুক্তির আওতায় চীনা ব্যাংকসমূহ থেকে পাকিস্তানকে অত্যধিক চড়া সুদে ঋণ গ্রহণে বাধ্য করা হয়েছে। বিশেষজ্ঞদের মতে এই ঋণ শোধ করতে পাকিস্তানের কমপক্ষে ৪০ বছর সময় লাগবে। এদিকে ইতোমধ্যেই পাকিস্তানের অভ্যন্তরে এই চীনা ঋণ বিষয়ে নানা জল্পনা-কল্পনা ও প্রশ্ন দেখা দিয়েছে বলে জানা যায়। আর যারা এসব প্রশ্ন তুলেছেন তাদের মধ্যে বিশিষ্টজনরাও আছেন। তারা এই অর্থনৈতিক করিডরের ফলে পাকিস্তানের জন্য কি লাভ অর্জন হবে তা নিয়ে শুধু প্রশ্নই তুলছেন না, এমনকি তারা এ কথাও বলেছেন যে, আসলে তো এতে করে পাকিস্তান নয়, চীনই লাভবান হবে অনেক বেশি। অন্যদিকে আবার এই করিডর থেকে যেটুকু লাভ পাকিস্তানের পক্ষে আসবে তাতে পাঞ্জাবী কর্তৃত্বাধীন পাক সেনাবাহিনী আর পাঞ্জাব প্রদেশই লাভের মুখ দেখবে, অন্যরা এ থেকে বঞ্চিত থেকে যাবে কেবল! উল্লেখ্য, তথাকথিত এই করিডরকে পাকিস্তানে সেই ঔপনিবেশিক আমলের ‘ভাগ কর, শাসন কর’ নীতিকৌশলটিকে যেন ফিরিয়ে এনে রাজনৈতিক মহলে নতুন করে বিভেদ সৃষ্টি করেছে। উল্লেখ্য, এই অর্থনৈতিক করিডর বিষয়টি প্রধানত পাকিস্তানের পাঞ্জাব প্রদেশটিকে মাথায় রেখে প্রণয়ন করা হয়েছে। যুগের পর যুগ ধরে যুক্তরাষ্ট্র পাকিস্তানকে ‘কৌশলগত পৃষ্ঠপোষকতা’ এবং এর অতিরিক্ত বিলিয়ন বিলিয়ন ডলার সাহায্য দিয়ে এলেও পাকিস্তান সেনাবাহিনী কখনই তাদের ‘আত্মা’কে যুক্তরাষ্ট্রের কাছে বিক্রি করেনি। এক্ষেত্রে বরাবরই পাক সেনাবাহিনী যুক্তরাষ্ট্রের কাছে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ দূরে থাকুক, বরাবরই তারা যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে নয়-ছয় করেছে। অথচ যুক্তরাষ্ট্রের তুলনায় চীনা সাহায্য-সহযোগিতা অকিঞ্চিৎকর বলে সাব্যস্ত হলেও পাকিস্তান কখনই চীনের সঙ্গে কিন্তু অনুরূপ নয়-ছয় করার সাহস পায়নি। চীনের কৌশলগত স্বার্থসংরক্ষণ বিষয়ে চীনকে সহযোগিতা না করার মনের জোর বা বুকের সাহস পাকিস্তান কখনই সঞ্চার করতে পারেনি। এক্ষেত্রে চীনা কর্তৃপক্ষের নির্দেশকে পাক সেনাবাহিনী সর্বদাই শিরোধার্য জ্ঞান করেছে। যা হোক, ওই অর্থনৈতিক করিডরের মাধ্যমে চীন যে পাকিস্তানকে আষ্টেপৃষ্ঠে বেঁধে ফেলেছে এবং এর পরিণতিতে একদিন এই ঋণ পাকিস্তানের গলার ফাঁস হিসেবে যদি দেখা দেয় তাতে বিস্মিত হওয়ার কিছুই থাকবে না। আর এই ধরনের দাসত্ববরণের ব্যাপারে দেশটির সংহতি, অখ-তা ও সার্বভৌমত্ব রক্ষার দায়িত্বে নিয়োজিত সেনাবাহিনী ঘোরতরভাবে ‘ঘরের শত্রু বিভীষণের’ ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছে। এর চাইতে লজ্জাকর আর কি হতে পারে একটি দেশের জন্য? তারা চীনের এই মতলবি উদ্দেশ্য পূরণের জন্য সকল প্রকার সহযোগিতা দিচ্ছে নিছক গোষ্ঠীগত স্বার্থে। এই তথাকথিত করিডরের এককভাবে নিরাপত্তা বিধানের জন্য দুজন সেনাপ্রধানের নেতৃত্বে ইতোমধ্যেই একটি পূর্ণাঙ্গ ডিভিশনের আকৃতিসম্পন্ন সেনাদল তৈরি করা হয়েছে বিশেষ প্রশিক্ষণ দিয়ে। এদিকে এই প্রকল্পের পুরো ব্যবস্থাপনার দায়িত্ব সেনাবাহিনী নিয়ন্ত্রণে নিতে চায়। আর এ ব্যাপারে বেসামরিক সংস্থাসমূহের সঙ্গে সেনাবাহিনীর ব্যাপক মতানৈক্য ও বাদ-বিসম্বাদ দেখা দিয়েছে। যা হোক, পাকিস্তানী সেনাবাহিনীর পারমাণবিক অস্ত্রের ভা-ার এবং ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র ভা-ার উভয়ই চীনা প্রযুক্তি ও সাহায্যের আওতায় নির্মিত হয়। ২০১৭ সালের সামরিক অন্যান্য সরঞ্জামের ক্ষেত্রেও ওই একই কথা প্রযোজ্য। পাকিস্তান যখনই কোন সঙ্কটে পড়ে বা পড়ার উপক্রম হয়, বিশেষত তা যখন ভারতকে ঘিরে তৈরি হয় ঠিক তখনই পাকিস্তান সেনাবাহিনী প্রধানকে বেজিংয়ের উদ্দেশে রওনা হতে দেখা যায়। তাই একথা নির্দ্বিধায় আজ বলা চলে যে, বাহ্যিকভাবে আমরা যে পাকিস্তানকে দেখি তা এক প্রকার মুখোশ। এর পেছনে আরেকটি মুখ লুকিয়ে আছে আর তা হলো চীনের মুখ। ভারত এতদিন যে পাকিস্তানের মোকাবেলা করেছে বর্তমানের এই পাকিস্তান সে পাকিস্তান থেকে ভিন্নতর। সুতরাং একে মোকাবেলা করার ক্ষেত্রে সদা সজাগ দৃষ্টি রাখা ভারতের জন্য একান্তই প্রয়োজন বলে বিশেষজ্ঞ ও পর্যবেক্ষকরা অভিমত ব্যক্ত করেছেন। লেখক : সাংবাদিক ও কলামিস্ট
×