ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৫ বৈশাখ ১৪৩১

ডিপ্রজন্ম- আপনি কাজ করছেন প্রতিবন্ধীদের নিয়ে। কেমন বাংলাদেশ গড়ে তুলতে চান তাদের জন্য?

ফোর্বসে বাংলাদেশের কিরণ

প্রকাশিত: ০৯:৫৩, ৬ জুন ২০১৭

ফোর্বসে বাংলাদেশের কিরণ

মিজানুর রহমান- একটি বৈষম্যহীন, প্রতিবন্ধীবান্ধব বাংলাদেশের স্বপ্ন আমাদের, যেখানে সামাজিক, অর্থনৈতিক, রাজনৈতিকসহ সকল ক্ষেত্রে তারা তাদের সাংবিধানিক অধিকার ও সুযোগ নিশ্চিতভাবে উপভোগ করতে পারবে। আমরা এ পরিবর্তনটা দেখতে চাই আমাদের তরুণ প্রজন্মের চিন্তার বিপ্লবের মাধ্যমে। আমি বিশ্বাস করি, প্রতিবন্ধী মানুষের প্রতি দেশের যুবগোষ্ঠীর মন-মানসিকতা ইতিবাচক হলেই আমরা আমাদের কাক্সিক্ষত বাংলাদেশ দেখতে পাব, যেটাকে আমরা সোনার বাংলাদেশ বলি। ডিপ্রজন্মÑ প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের নিয়ে কাজ করার চিন্তাভাবনা কখন এল? মিজানুর রহমানÑ ২০০৮ সালের প্রথম দিকের কথা, ইতিহাস বিভাগে বরকত নামে এক শারীরিক প্রতিবন্ধী ছোট ভাই ভর্তি হয়। সে বিকেএসপিতে ম্যাথলেট ছিল। প্র্যাকটিসের সময় মেরুদণ্ডে আঘাত পায়। আমি ডিপার্টমেন্টের সিআর (ক্লাস প্রতিনিধি) ছিলাম। একারণে বিভিন্ন সময় বরকত আমার কাছে আসত। এভাবে আমার সঙ্গে ওর একটা সখ্য গড়ে ওঠে। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে বরকতের জীবন সহজ ছিল না। হলে সিট নেই, সিঁড়ি বেয়ে উঠা-নামা, অর্থনৈতিক টানাপোড়া ইত্যাদি তাকে মোকাবেলা করতে হতো প্রতিনিয়ত। আর আমিই ছিলাম তার কাছের কেউ যাকে সে এসব কথা বলত। এক সময় নিজের অজান্তেই আমি ওর বিষয়গুলো সিরিয়াসলি নিতে ব্রতী হই। একদিন সেন্ট্রাল লাইব্রেরিতে বরকতসহ আরও ২জন (ওহি এবং ডিউক, যাদের একহাত অকেজো ছিল) বসলাম একটা কিছু পরিকল্পনা করতে, কিভাবে তাদের সমস্যাগুলো সহজে সমাধান করা যায়। সেখানেই আমরা দলবদ্ধভাবে কাজ করার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম। উদ্দেশ্য ছিল, ক্যাম্পাসে তাদের সুযোগ সুবিধাগুলো নিশ্চিত করা এবং নিজেদের যোগ্যতা উন্নয়নে কিছু করা। ডিপ্রজন্মÑ ফোর্বস ম্যাগাজিন আপনার কার্যক্রমকে দিয়েছে বৈশ্বিক স্বীকৃতি। এসম্পর্কে আপনার অনুভূতি বলুন। মিজানুর রহমানÑ আমি নিজে এটার জন্য আবেদন করিনি, তাই যখন আমি এটা জানতে পারলাম তখন মনে হয়েছিল, আমরা সত্যিই ভাল কিছু করছি! আর ভাল কিছু করতে পারার অনুভূতি হলো পৃথিবীর সবচেয়ে সুন্দরতম এবং শ্রেষ্ঠতম। তবে এত দিন কাজটা করেছি ভালবাসা থেকে, এখন মনে হচ্ছে কাজটি আরও ভালভাবে করতে কেউ চাপ প্রয়োগ করছে। চাপের এই অনুভবটাই চ্যালেঞ্জ। আমি সব সমই চ্যালেঞ্জকে উপভোগ করি।’ ডিপ্রজন্মÑ বাংলাদেশের এক তরুণ হিসেবে ইতিহাসে পড়ে পিডিএফ নামের এত বড় সংগঠন গড়ে তুলেছেন, অনুপ্রেরণা পেয়েছেন কোথায় থেকে? মিজানুর রহমানÑ প্রথম প্রেরণাটা আসে আমার বিভাগ থেকেই, বরকত ছিল আমার বিভাগের ছাত্র। আমরা যখন সিদ্ধান্ত নিলাম কাজটি করার তখন আমরা শুরুতেই কথা বলি আমার বিভাগের শিক্ষক, প্রফেসর আতিকুর রহমান স্যার এর সঙ্গে। তিনি ছিলেন এই কাজের জন্য প্রথম উৎসাহদানকারী এবং এখন পর্যন্ত একইভাবে আমাদের কাজে সহযোগিতা করে যাচ্ছেন। কাজটিকে দেশব্যাপী ছড়িয়ে দিতে এবং এমনকি দেশের গ-ি পেরিয়ে যেতে মূলে রয়েছেন ড. ভেলোরি এ টেইলর। তিনিই আমার রোল মডেল ও মেনটর । তিনি তার স্বপ্ন (প্রতিবন্ধীবান্ধব সমাজ) পূরণে তার প্রেরণা ছড়িয়ে যাচ্ছেন প্রজন্ম থেকে প্রজন্ম। তার কাছেই আমি শিখেছি, কিভাবে লক্ষ্যকে নিজের জীবনের সঙ্গে রাঙিয়ে নিতে হয় এবং তারপর তার দ্যুতি ছড়িয়ে দিতে হয় মানুষের হৃদয়ে। ডিপ্রজন্মÑ জনকণ্ঠ ডিপ্রজন্ম পরিবার মনে করে, ‘পিডিএফ শুধু একটি প্রথাগত সংগঠন নয়, নৈতিক আন্দোলনের নামও’ বিষয়টিকে আপনি কিভাবে মূল্যায়ন করবেন? মিজানুর রহমানÑ আমি শুরুতেই বলেছি, পিডিএফ তার আন্দোলনের ফল দেখতে চায় দেশের যুবগোষ্ঠীর মনমানসিকতার ইতিবাচক পরিবর্তনের মধ্যদিয়ে। আমাদের দেশে প্রতিবন্ধী মানুষের প্রধান অন্তরায় হচ্ছে তাদের প্রতি অপ্রতিবন্ধী মানুষের অসহযোগিতামূলক মনোভাব, অনেকেই বুঝে করে, অনেকেই না বুঝে করে। আমাদের কাজটা সেখানেই, বৈষম্যের অঙ্কুরে আঘাত হেনে সেখানে মানবীয় মূল্যবোধকে জাগিয়ে দেয়া। ডিপ্রজন্ম Ñযেসব কাজের সঙ্গে যুক্ত রয়েছেন বর্তমানে - মিজানুর রহমানÑপিডিএফের পাশাপাশি আমি ব্র্যাকের এ্যাডভোকেসি বিভাগে ফুলটাইম কাজ করি। এছাড়া পিডিএফের কিছু নিয়মিত কাজ করছি আমরা, তাও চলবে। ডিপ্রজন্মÑএখন পর্যন্ত পাওয়া সব স্বীকৃতি বা অর্জন সম্পর্কে জানতে চাই- মিজানুর রহমানÑযুক্তরাষ্ট্রের স্টেট ডিপার্টমেন্ট অর্থায়নে এটলাস কোর ফেলোশিপ, ফোর্বসে স্বীকৃতিসহ নানা অর্জন রয়েছে। ডিপ্রজন্মÑপ্রতিবন্ধীদের নিয়ে কাজ করার মধ্যে কোন বাধা পেয়েছেন নিজের পরিবার থেকে? মিজানুর রহমানÑ মানুষের পাশে দাঁড়ানো শিখেছি ছোটবেলায় মায়ের কাছ থেকে, স্কুল-কলেজ জীবনে, সবসময় সামাজিক কাজে যুক্ত ছিলাম, পরিবার পাশে ছিল সবসময়। তেমনি পিডিএফের ক্ষেত্রেও সমর্থন ছিল। তবে কিছু বাধা ছিল যখন ২০১২ সালে আমার বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম দৃষ্টি প্রতিবন্ধী শিক্ষার্থী সুরাইয়া আকতারকে বিয়ে করতে চাই। তবে এই বাধা কাটতে খুব বেশি সময় লাগে না, কারণ দৃষ্টিহীন এই মেয়েটিই তো আমার জন্য আলো, সেটা সবাই বুঝতে পেরেছে। বর্তমানে আমরা অনেক সুখী। ডিপ্রজন্মÑআপনার এগিয়ে চলার গল্পটা শুনে সত্যি দারুণ লেগেছে। আশা করি আরও সফল হবেন, প্রতিবন্ধীদের কিরণ হয়ে বেঁচে থাকবেন প্রত্যাশা রইল। মিজানুর রহমানÑ অনেক অনেক ধন্যবাদ আপনাদের টিমের সবাইকে।
×