ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

সুকান্ত চৌধুরী

গরুবিষয়ক রচনা

প্রকাশিত: ০৫:৫২, ৬ জুন ২০১৭

গরুবিষয়ক রচনা

গল্পটা সবাই জানি। একটি ছেলে ফি-বার বাংলা পরীক্ষার দিন একটাই রচনা মুখস্থ করে যেত, তার বিষয় ‘গরু’। পরীক্ষায় ‘নদী’র ওপর রচনা এলে লিখত ‘নদীর ধারে অনেক গরু চড়ে। গরু একটি গৃহপালিত পশু’ ইত্যাদি। বিষয়টা ‘রবীন্দ্রনাথ’ হলে লিখত, ‘কবিগুরু কেবল কবিতা লিখতেন না, স্বাস্থ্য ভাল রাখার জন্য গরুর দুধ খেতেন। গরু“ একটি গৃহপালিত পশু...’ এমন ছেলে আজকের দিনে উন্নতি করবে, কারণ মুগ্ধ দেশবাসীর চোখের সামনে দেশ শাসনের আলেখ্য হয়ে উঠছে গরুর ওপর রচনা। রাষ্ট্রনীতির সব প্রসঙ্গে প্রাণীটি অনুপ্রবেশ করছে, দখল নিচ্ছে সমাজ ও প্রশাসনের নানা ক্ষেত্রের। এক নিরীহ তৃণভোজী জীবকে কেন্দ্র করে খুনজখম মারদাঙ্গায় স্বভাবতই আমরা চিন্তিত। যে মানসিক অবস্থান থেকে এসব ঘটছে, সেটাই কিন্তু সমস্যার মূলে। রাজস্থান এ বিষয়ে পথিকৃৎ। সেখানকার শিক্ষামন্ত্রী ও এক প্রবীণ বিচারপতি মিলে অনেক চমকপ্রদ তথ্য পেশ করেছেন, যথা: গরু নিশ্বাসের সঙ্গে অক্সিজেন নির্গত করে; গোবর তেজস্ক্রিয়তা শুষে নেয়; গরুর শিং বেয়ে মহাজাগতিক শক্তি প্রবাহিত হয়। ময়ূরের সঙ্গমহীন প্রজননের কথা ছেড়েই দিলাম। রাজস্থানে জীববিজ্ঞান-শিক্ষকরা বড় আতান্তরে পড়লেন। টিভির খবর দেখে যদি কোনও ছাত্র প্রশ্ন করে, ‘স্যর, গরুর নিশ্বাসে কি সত্যি অক্সিজেন ছড়ায়?’, কী উত্তর দেবেন? সেøচ্ছদের বইয়ে অন্য কথা লেখা থাকলে কি বইগুলো পুড়িয়ে ফেলা হবে? পঞ্চগব্য নিয়ে গবেষণায় ভারত সরকার দরাজ অনুদান জোগাচ্ছে। প্রাচীন আয়ুর্বিদ্যার নানা ওষুধের গুণ ইতোমধ্যে প্রমাণিত; বাকিগুলো নিয়ে অনুসন্ধান নিশ্চয় জরুরী। কিন্তু এ ক্ষেত্রে গবেষণা চালিত হবে পূর্ব সংস্কারের দ্বারা: একটা সিদ্ধান্ত আগে থেকে ঠিক বলে ধরে নিয়ে, তার সপক্ষে সওয়াল খাড়া করা হবে। এটা বৈজ্ঞানিক পদ্ধতি নয়; কারণ এটা সম্ভব নয় যে প্রকল্পের শেষে কৃপাধন্য গবেষকরা বলবেন, গোময় বা গোমূত্রের কোনও উপকারিতা নেই। যেসব তথ্যের বৈজ্ঞানিক ভিত্তি আছে (যেমন গোবর থেকে জৈবগ্যাস), এই সুযোগে তার সঙ্গে মিশিয়ে দেয়া হচ্ছে অপ্রমাণিত আপাত উদ্ভট দাবি: বিজ্ঞান-অপবিজ্ঞান একাকার। হয়ত একদিন পরীক্ষাগারে প্রমাণ হবে গোমূত্রে ওষুধের গুণ আছে; তাতে গরুর নিশ্বাসে অক্সিজেন থাকার গল্প মান্যতা পাবে না। আপাতত উভয় দাবিই যে ভিত্তিতে করা হচ্ছে তাকে বৈজ্ঞানিক বলা চলে না। এখন, আমাদের জীবনের নানা ক্রিয়াপ্রক্রিয়া। কতগুলো বিশ্বাস, সংস্কার, আবেগ ও রুচি সংক্রান্ত; এগুলি ব্যক্তিগত সম্পর্ক, সমাজনীতি, মূল্যবোধ, ধর্মীয় অবস্থান ইত্যাদি চালিত করে। বাস্তববোধ ও যুক্তিতথ্যের ভূমিকা এখানে গৌণ বা অনুপস্থিত। ‘বিশ্বাস’ শব্দটার একটা সংজ্ঞা হলো, যা যুক্তি বা তথ্যপ্রমাণ বিনা কেবল অন্তরাত্মার সম্মতিতে মেনে নেয়া হয়। অন্য কিছু ক্ষেত্রে বাস্তববোধ ও বাস্তব লাভই প্রধান, যেমন আর্থিক লেনদেনে বা অন্য ব্যবহারিক কাজে। আর কতগুলো ক্ষেত্র আছে, যেখানে বাস্তবের নৈর্ব্যক্তিক বিচার-বিশ্লেষণ হয় যুক্তি ও তথ্যপ্রমাণ দিয়ে, লাভের জন্য ততটা (বা আদৌ) নয়, নিছক জানা-বোঝার জন্য। এই শেষোক্ত মানসিকতাকে আমরা বলি বৈজ্ঞানিক। প্রতিটি ক্ষেত্রের নিজস্ব প্রয়োজন ও সার্থকতা আছে, একটার এলাকায় আর একটা ঢুকে পড়লে বিপদ। স্বস্থানে যতই মূল্যবান হোক, তখন তা হয়ে পড়ে বেমানান, অবান্তর, হয়ত হানিকর। আর্থিক লাভক্ষতির নিরিখে ব্যক্তিগত সম্পর্ক পাতলে অনর্থ ঘটতে বাধ্য। অঙ্ক কষে ধর্মবিশ্বাস পোক্ত করা যায় না। গো-তত্ত্বের ক্ষেত্রে কিন্তু বিজ্ঞানকে টেনে আনা হচ্ছে বিশ্বাস বা সংস্কারের সমর্থনে। বিশ্বাস স্বয়ংসম্পূর্ণ, যুক্তি-বাস্তবের ওপর নির্ভরশীল নয়, কিন্তু ক্ষতি হয় বিজ্ঞানের, কারণ তার আবহে এমন কিছু ঢুকে যায়, যা বিজ্ঞানসিদ্ধ নয়। অতএব ক্ষতি সমাজের, কারণ বিজ্ঞান ও তার প্রয়োগ বা প্রযুক্তি আমাদের জীবনে প্রভূত গুরুত্বলাভ করে চলেছে। তার চেয়েও বড় কথা, জড়জগতের বাইরে বহু ক্ষেত্রে (যেমন আইনের প্রশ্নে, সর্বোপরি অসংখ্য প্রাত্যহিক সিদ্ধান্তে ও আদানপ্রদানে) যুক্তিতথ্যের ভিত্তিতে, বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে বিচার আমরা কাম্য বা অপরিহার্য বলে স্বীকার করি। সেই বিচারের ভিত টললে ব্যক্তিজীবন ও সমাজজীবনে ছোটবড় অশেষ বিপর্যয় ঘটবে, বিপন্ন হবে আমাদের অর্থনীতি ও বৌদ্ধিক অস্তিত্ব। বিশ্বের চোখে বিজ্ঞান-প্রযুক্তির কর্মকেন্দ্র হিসেবে ভারতের কদর কমবে, তার প্রভাব পড়বে প্রযুক্তিভিত্তিক শিল্পবাণিজ্যে। দেশের বৃহত্তম ও সবচেয়ে মর্যাদার বিজ্ঞান সমাবেশে ইদানীং পৌরাণিক কল্পকাহিনী ঠাঁই পাচ্ছে: এতে শুধু বিজ্ঞানী বা বিদ্বজ্জন নন, নিছক জাগতিক স্বার্থে প্রত্যেক দেশবাসীর উদ্বিগ্ন হওয়া উচিত। এটাই ‘গরুর ওপর রচনা’র আসল সমস্যা: এতে সব প্রশ্নের উত্তর এক হয়ে যায়, জীবনের সব ক্ষেত্র গুলিয়ে ফেলা হয়, ফলে কোনওটাই সার্থক হতে পারে না। গোরক্ষার নামে যত ধ্বংসাত্মক অনাচার ঘটছে তার মূলে এই মানসিকতা: সমাজের আর সব প্রসঙ্গ, বিচারের আর সব মাপকাঠি ত্যাগ করে একটিই উদ্দেশ্য আঁকড়ে থাকা। গো-ব্যবসায় সম্বন্ধে প্রস্তাবিত নতুন বিধির বিরুদ্ধ যুক্তিগুলো বহুচর্চিত। এতে দেশের বিপুল আর্থিক ক্ষতি হবে। (অনুপাতে বেশি হবে পশ্চিমবঙ্গের।) বহু মানুষ রুজি হারাবেন, অধিকাংশই দরিদ্র ও বঞ্চিত গোষ্ঠীর। যারা খাতা-কলমে হারাবেন না (যেমন দুধের ব্যবসায়ী), তাদের জীবনও জটিল, ব্যয়বহুল, কখনওবা বিপন্ন হয়ে পড়বে, শ্বেতবিপ্লব গতি হারাবে। পুরো ব্যবস্থাটা ঘিরে আমলাতন্ত্রের এক নতুন আবেষ্টন গড়ে উঠবে; সবচেয়ে ভয়ের কথা, গোরক্ষক বাহিনীর আস্ফালন চরমে উঠবে। দেশের জাতিগত ও সাম্প্রদায়িক ভারসাম্য অস্থির হয়ে পড়বে, হয়ত কালে সেই ভারসাম্য একটা দমনমূলক স্থবিরত্ব লাভ করবে। এত যুক্তির বিরুদ্ধে একটাই প্রতিতর্ক: এতে গোরক্ষার কর্মসূচী গতি পাবে। হতে পারে, সেটাই আমরা চাই। সেজন্য অন্য এতগুলো ক্ষতি আমরা মানতে প্রস্তুত। কিন্তু কোন্ পথে এই সিদ্ধান্তে পৌঁছলাম? আপত্তিগুলো যুক্তিবিচারে খণ্ডন করে তো নয়, বরং সেগুলোর পাশ কাটিয়ে সম্পর্কহীন একটাই প্রসঙ্গকে চূড়ান্ত করে দেখে! অর্থাৎ, বাণিজ্যিক সামাজিক মানবিক সাম্প্রদায়িক যে প্রশ্নই উঠুক না কেন, উত্তর সেই গরুর ওপর রচনা। এমন রচনা যে কোনও বিষয়ে হতে পারে। গল্পের বালকটি ‘নদী’র রচনাও মুখস্থ করতে পারত। পরীক্ষায় ‘গরু’ এলে লিখত ‘গরু নদীতে জল খেতে আসে। নদী এক বহমান জলরাশি...’ এ ক্ষেত্রেও সে হতবয়স্কদের পথিকৃৎ, কারণ বিষয় ও প্রাসঙ্গিকতা অগ্রাহ্য করে সে সব কিছু এক ছাঁচে ঢালছে। আমাদের রাষ্ট্রীয় জীবনে অশেষ ভিন্নতা ও জটিলতা। সেটা বুঝতে গেলে এবং সার্বিক মঙ্গল ঘটাতে চাইলে, মাথায় রাখতে হবে যে পদে পদে আমরা নতুন নতুন পরিস্থিতির সম্মুখীন হব; প্রতিটির বিচার করব তার নিজস্ব চরিত্র অনুসারে, তবেই সব মিলিয়ে ফুটে উঠবে এক সর্বাঙ্গীণ চিত্র। কিছু গোষ্ঠী এটা বুঝতে নারাজ। তারা এক বিশেষ অবস্থানে এমন আবদ্ধ যে, সব কিছু সেই দৃষ্টিতে দেখে। এদের আমরা মৌলবাদী বলি। বাকি সমাজ থেকে এরা বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে: কেউ বেছে বেছে শত্রু খতম করে, কেউ সমাজে ধ্বংস ও সন্ত্রাস ছড়ায়। কোনও বৃহত্তর দায়িত্বে এরা সচরাচর উত্তীর্ণ হয় না: এদের ধর্ম রাজধর্মের বিপরীত। তাই নাগরিক সমাজে বিশেষ উদ্বেগের কারণ ঘটে যখন রাজণ্যবর্গের ভাষা, আচরণ ও অবস্থান হয়ে ওঠে সঙ্কীর্ণ, অনমনীয়, একদেশদর্শী। দেশপ্রেম ও মানবিকতা পর্যবসিত হয় গত বাধা যান্ত্রিক উচ্চারণ বা অনুষ্ঠানে; নাগরিকত্বের তালিম দেয়া হয় নির্দিষ্ট নেতার বাক্সবন্দী ভাষণ মারফত। সব প্রশ্নের উত্তরে মেলে একটাই ছাঁচে ঢালা বয়ান। চিন্তার বদলে আসে সেøাগান, স্বতঃস্ফূর্ত উদ্যমের বদলে কুচকাওয়াজ। রাষ্ট্রচেতনার এই সরল পাটিগণিত না মিললে শাসককুল বিভ্রান্ত হয়, বিভ্রান্তি থেকে আক্রোশ জন্মায়, সেটাও প্রকাশ পায় অক্লান্ত একরোখা জেদের বাঁধা বয়ানে। অযোগ্য শিক্ষক ঠিক তেমনি মেধাবী ছাত্রের লেখা না বুঝে ঢ্যাঁড়া মেরে দেন; খুশি হন তার কোচিং ক্লাসের শেখানো বুলি মুক্তাক্ষরে লিপিবদ্ধ দেখলে। এমন ব্যবস্থায় বেশিরভাগ ছাত্র-অভিভাবকের বিলক্ষণ সম্মতি থাকে। রাজ্যপাটের সঙ্গে তুলনা এখানেও খাটে। সোজা-সরল বাঁধানো রাস্তায় চলা সহজ, তাতে একটা স্বস্তি আর ভরসা আসে। অগোছালো উদভ্রান্ত সমাজে সেটাই মনে হয় শান্তিশৃঙ্খলার পরাকাষ্ঠা, যা থেকে আরও অনেক মঙ্গল আসবে; ফলে অন্তত কিছু দিন এই প্রবণতার পিছনে জনসমর্থন থাকে প্রচুর। এ বিষয়ে ইতিহাসের সর্বকালীন কুশীলবদের এক জনের বক্তব্য দেখা যাক। বইয়ের নাম আমার সংগ্রাম (মাইন কাম্পফ), লেখক আডল্ফ হিটলার। ‘আপামর জনসাধারণকে জাতীয়তাবাদী করে তুলতে গেলে আধাখেচড়াভাবে করা চলবে না। করতে হবে নির্দয় ও একাগ্রভাবে, একটিমাত্র অভীষ্ট লক্ষ্য আঁকড়ে থেকে: দ্বিধা-দ্বন্দ্বে ভরা নয়, প্রবল ও চরম জাতীয়তাবাদ দিয়ে। ...বিদ্যার চেয়ে বিশ্বাসের বিরুদ্ধে লড়া অনেক বেশি শক্ত। নিছক বিতৃষ্ণার চেয়ে তীব্র বিদ্বেষ ঢের বেশি দীর্ঘস্থায়ী।’ বড় চরম দৃষ্টান্ত দিলাম। প্রায় সব দেশের পরিচালনায় এ প্রবণতা অল্পবিস্তর দেখা যায়। কর্তৃত্ব কায়েম করতে শাসকবর্গ এভাবেই জনসমর্থনকে কাজে লাগায়, গণতন্ত্রের খোলস রেখে শাঁসটা শুষে নেয়। উদ্ধৃতিটি পড়ে আতঙ্কের কারণ না থাক, সতর্কতার অবকাশ আছে। গরুর রচনা আওড়াতে আওড়াতে আমরাও যেন পালের জীব না বনে যাই। (আনন্দবাজার পত্রিকার সৌজন্যে) লেখক : যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজী বিভাগের এমেরিটাস অধ্যাপক
×