ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

ঢাকার ট্রাফিক ব্যবস্থাপনা

প্রকাশিত: ০৫:৫২, ৬ জুন ২০১৭

ঢাকার ট্রাফিক ব্যবস্থাপনা

ঢাকা অত্যন্ত ঘনবসতিপূর্ণ একটি শহর। এখানে প্রতি বর্গ কিলোমিটারে প্রায় ১ লাখ লোক বাস করে। সম্ভবত ঢাকাই বিশ্বের সবচেয়ে ঘনবসতিপূর্ণ শহর। ঢাকা শহরে সড়কের পরিমাণ চাহিদার তুলনায় ১/৩ ভাগের কম। কিন্তু সড়কের পরিমাণ বৃদ্ধি প্রায় অসম্ভব। ঢাকা শহর পরিকল্পিতভাবে গড়ে ওঠেনি। এখানকার সড়কগুলোও পরিকল্পিতভাবে তৈরি হয়নি। ঢাকায় আন্তর্জাতিক মানের ট্রাফিক ব্যবস্থা গড়ে ওঠেনি। এখানকার বিদ্যমান ট্রাফিক ব্যবস্থাপনা অত্যন্ত বিরক্তিকর। ট্রাফিক অব্যবস্থাপনার কারণে যানজট লেগে থাকে। যাত্রীদের দীর্ঘসময় পথে কাটাতে হয়। জ্বালানির অপচয় হয়, লাখ লাখ কর্ম ঘণ্টা নষ্ট হয়, কোটি কোটি টাকার আর্থিক ক্ষতি হয়। বিশ্বের সর্বত্র স্বয়ংক্রিয় সিগন্যাল লাল, হলুদ ও সবুজ বাতির মাধ্যমে ট্রাফিক নিয়ন্ত্রণ করা হয়। লাল বাতিতে গাড়ি থেমে থাকে, হলুদে চলার প্রস্তুতি নেয় এবং সবুজে চলে। ঢাকা সিটিতে স্বয়ংক্রিয় সিগন্যাল বাতির ব্যবস্থা থাকলেও সেটার ব্যবহার নেই। কোটি কোটি টাকা ব্যয় করে স্বয়ংক্রিয় সিগন্যাল বাতির ব্যবস্থা করা হয়েছে, নিয়মিত লাল, হলুদ ও সবুজ বাতি জ্বলছে, বিদ্যুত অপচয় হচ্ছে, কিন্তু ট্রাফিক নিয়ন্ত্রণে সেগুলোর ব্যবহার হয় না। ঢাকা শহরে লাল বাতিতে গাড়ি চলে এবং সবুজ বাতিতে গাড়ি থেমে থাকে, যা ট্রাফিক নিয়ম ও আইনের পরিপন্থী। ট্রাফিক পুলিশ ও গাড়ি চালকগণ এ কাজটি সব সময়েই অবাধে করছে। এতে নাগরিকদের মধ্যে আইন ভঙ্গ করার প্রবণতা তৈরি হয়। আইন মেনে চলা সভ্যতার প্রকাশ। আমরা বাংলাদেশের নাগরিকগণ ট্রাফিক আইন মেনে চলি না। আমরা নিজেদের সভ্য জাতি দাবি করতে পারি না। বিশ্বের সর্বত্র যদি স্বয়ংক্রিয় ট্রাফিক সিগন্যালের মাধ্যমে ট্রাফিক নিয়ন্ত্রণ সম্ভব হয়, ঢাকা শহরে কেন হবে না? অবশ্যই স্বয়ংক্রিয় ট্রাফিক সিগন্যাল মেনে ট্রাফিক নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। স্বয়ংক্রিয় ট্রাফিক সিগন্যালের মাধ্যমে ট্রাফিক নিয়ন্ত্রণে যেসব সমস্যা হয়, সেগুলো চিহ্নিত করে দূর করতে হবে। এ কাজে ট্রাফিক পুলিশের ওপর সিদ্ধান্ত নেওয়ার দায়িত্ব ছেড়ে দিলে চলবে না। প্রয়োজনে ঢাকা শহরের ট্রাফিক নিয়ন্ত্রণের জন্য মেয়রের বা স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের বা সড়ক ও জনপথ মন্ত্রণালয়ের অধীনে একটি বিশেষজ্ঞ উপদেষ্টা পরিষদ গঠন করতে হবে। পরিষদ সড়কে থেকে দেখবে স্বয়ংক্রিয় ট্রাফিক সিগন্যাল ব্যবহারে কোথায় সমস্যা হচ্ছে। তারা সেটার সমাধানে পরামর্শ দেবে। পুলিশের দায়িত্ব হবে বিশেষজ্ঞ পরিষদের পরামর্শ বাস্তবায়ন করা। এ কাজ হয়ত এক সপ্তাহ বা এক মাসে সম্ভব হবে না। সময় নিয়ে সমস্যার সমাধান করতে হবে। ঢাকা সিটি কর্পোরেশনের উত্তর ও দক্ষিণের বর্তমান নির্বাচিত মেয়রদ্বয় নির্বাচনের প্রাক্কালে ঢাকা শহরের অন্যান্য সমস্যার সঙ্গে ঢাকার যানজট নিরসনেরও ওয়াদা করেছিলেন। আনিসুল হক বলেছিলেন, নির্বাচিত হলে তিনি গ্রীন ঢাকা, ক্লিন ঢাকা এবং চলমান ঢাকা গড়ে তুলবেন। নির্বাচিত হওয়ার পর তারা ঢাকা মেট্রোপলিটন শহরের যানজট নিরসনের চেষ্টাও করেছিলেন। কিন্তু হতাশ হয়ে সরে গেলেন। বললেন, বিষয়টি পুলিশের এখতিয়ারে, তাদের কিছু করণীয় নেই। কিন্তু এটা সঠিক নয়। যানজট নিরসনে মেয়রদের অবশ্যই করণীয় রয়েছে। তাদের সহায়তা ছাড়া পুলিশের পক্ষে যানজট নিরসন কোনভাবেই সম্ভব নয়। গণতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থায় মেয়রকেই নাগরিকদের সেবা প্রদানের দায়িত্ব নিতে হয়। সেবা প্রদানকারী সংস্থাগুলো মেয়রের অধীনেই থাকার কথা। কিন্তু বাংলাদেশে গণতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থা থাকলেও, সকল সেবাখাতসহ সবকিছুই কেন্দ্রীয় সরকারের নিয়ন্ত্রণে। যে কারণে ঢাকা শহরে ট্রাফিক নিয়ন্ত্রণ কার অধীনে থাকবে সেটা স্পষ্ট নয়। পুলিশ স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অধীনে কাজ করে থাকে। কিন্তু ঢাকার ট্রাফিক ব্যবস্থাপনা স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অধীনে নয়। ট্রাফিক ব্যবস্থাপনা কার অধীনে থাকবে সেটা স্পষ্ট হওয়া জরুরী এবং সেটা অবশ্যই নির্বাচিত জনপ্রতিনিধির অধীনে হতে হবে। পুলিশকে অবশ্যই সংশ্লিষ্ট গণতান্ত্রিক কর্তৃপক্ষের অধীনে কাজ করতে হবে। ঢাকা শহরের যানজটের বিষয়ে প্রচুর আলোচনা-সমালোচনা ও লেখালেখি হয়েছে। সেসব আলোচনা-সমালোচনা ও লেখালেখি থেকে যানজটের কারণগুলো মোটামুটি চিহ্নিত হয়েছে। যানজট নিরসনের উপায়েও অনেকে সুপারিশ করেছেন। কিন্তু যথাযথ ব্যবস্থার অভাবে যানজট সমস্যার সমাধান না হয়ে দিন দিন সেটা আরও প্রকট হয়ে উঠছে। বিশেষজ্ঞগণ যানজটের যে কারণ চিহ্নিত করেছেন সেগুলো মোটামুটি নি¤œরূপ :- ক) অতিরিক্ত জনসংখ্যার কারণে ঢাকায় অতিরিক্ত যানবাহন চলাচল করে। সে তুলনায় ঢাকায় সড়কের পরিমাণ যথেষ্ট নয়। উন্নত দেশে বড় শহরগুলোর মোট এলাকার ২৫-২৭ ভাগের অধিক সড়ক থাকে। কিন্তু ঢাকায় ৭-৮ এর বেশি সড়ক নেই। খ) এখানে দ্রুতগতির, স্বল্পগতির, যন্ত্রচালিত এবং অযন্ত্রচালিত, সব ধরনের যানবাহন একই রাস্তায় চলাচল করে থাকে। গ) অদক্ষ গাড়িচালক, গাড়ি চালকদের ধৈর্যের অভাব, গাড়ি চালানোর সময় ক্রমাগত লেন পরিবর্তন ইত্যাদি কারণে বিশৃঙ্খলার সৃষ্টি হয়। ঘ) সাধারণ নিয়মে ভারি যানবাহন রাস্তার বাম দিকে এবং দ্রুত গতির হাল্কা যানবাহনগুলো রাস্তার ডানদিক দিয়ে চলাচল করে। বাংলাদেশে এ রীতি মেনে চলা হয় না। ঢাকা শহরের ট্রাক বাসের মত ভারি যাহবাহনগুলো তাদের ইচ্ছামত রাস্তায় এলোমেলোভাবে চলাচল করে। ভারি যানবাহনগুলো অব্যাহতভাবে লেন পরিবর্তন করার কারণে অধিকাংশ সময় যানজটের সৃষ্টি হয়। ঙ) নাগরিকদের মধ্যে আইন মেনে না চলার মানসিকতা আছে। আইন প্রয়োগের ব্যাপারে পুলিশও অনেক নমনীয়। চ) স্বয়ংক্রিয় বৈদ্যুতিক ট্রাফিক সিগন্যালের ব্যবস্থা থাকলেও পুলিশ সেটার ব্যবহার করে না। তারা রাস্তায় দাঁড়িয়ে ম্যানুয়াল পদ্ধতিতে ট্রাফিক নিয়ন্ত্রণে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করে। যে কারণে প্রধান সড়কের ক্রসিংগুলোতে তীব্র যানজট হয়। ঢাকা শহরে বিজ্ঞানসম্মত ট্রাফিক ব্যবস্থাপনা গড়ে ওঠেনি। উন্নত দেশের শহরের রাস্তাগুলো ট্রাফিক সংকেত, ট্রাফিক নির্দেশনা, ট্রাফিক পরামর্শ ও রোডমার্কিং (ঞৎধভভরপ ংরমহধষ, ঃৎধভভরপ রহংঃৎঁপঃরড়হ, ঃৎধভভরপ ধফারপব, ৎড়ধফ সধৎশরহম) দ্বারা সজ্জিত থাকে। ঢাকা শহরে এগুলো যথাযথভাবে নেই। ট্রাফিক শৃঙ্খলার জন্য এগুলো অত্যন্ত জরুরী। ট্রাফিক সাইন-সিগন্যাল চালকদের ট্রাফিক আইন মেনে গাড়ি চালনার ক্ষেত্রে সহায়তা করে। তাদের মনস্তত্ত্বের ওপরেও এগুলো প্রভাব ফেলে। ট্রাফিক সাইন-সিগন্যালগুলোর মধ্যে কিছু বাধ্যতামূলক বা অবশ্য পালনীয়। কিছু পরামর্শমূলক, তথ্যমূলক হয়ে থাকে। রাস্তার পাশে পরিষ্কারভাবে দৃশ্যমান স্থানে খুঁটির ওপর এগুলো স্থাপন করতে হয়। এগুলো নির্দিষ্ট আকারের, চিহ্নের ও রঙের হয়ে থাকে। যা অনুসরণ করে গাড়ি চালকগণ গাড়ি চালিয়ে থাকে। রোডমার্কিং দ¦ারা কোথায় গাড়ি লেন পরিবর্তন করা যাবে, কোথায় যাবে না, তীর চিহ্নের মাধ্যমে ট্রাফিকের দিক নির্দেশনা থাকে। স্ট্যান্ডার্ড রোড সাইন দ্বারা সামনে হাসপাতাল, বাচ্চাদের স্কুল, রাস্তার বাঁক, ডানে বামে রাস্তা, একদিকে চলাচল, সামনে প্রধান সড়ক, রেল ক্রসিং, সামনে আঁকাবাঁকা রাস্তা, পার্কিং, পার্কিং নিষেধ, প্রবেশ নিষেধ, থামুন, ঠেলাগাড়ি প্রবেশ নিষেধ, ট্রাক প্রবেশ নিষেধ প্রভৃতি তথ্যমূলক ট্রাফিক সাইন থাকে। তাছাড়াও বাধ্যতামূলক ট্রাফিক সিগন্যাল থাকে, যেগুলো ড্রাইভারদের অবশ্যই মেনে চলতে হয়। তারমধ্যে রয়েছে সর্বোচ্চ গতিসীমা, কোন রাস্তায় কত টন ওজনের ট্রাক চলবে, ওভারটেকিং নিষেধ, ডানে মোড় নিষেধ, ইউটার্ন নিষেধ প্রভৃতি। তাছাড়াও স্বয়ংক্রিয় বৈদ্যুতিক ট্রাফিক সিগন্যাল থাকে, যেখানে লাল হলুদ ও সবুজ বাতির ব্যবস্থা আছে। লাল বাতির সময় সামনে চলা নিষেধ, হলুদ বাতির সময় চলার জন্য প্রস্তুতি এবং সবুজ বাতির সময় সামনে চলতে হবে। বাধ্যতামূলক ট্রাফিক সিগন্যাল ভঙ্গ করা দ-নীয় অপরাধ। চলবে... লেখক : সাবেক ডি.আই.জি
×