ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১

আমানতে শুল্ক, সঞ্চয়পত্রে সুদ হ্রাস

প্রকাশিত: ০৫:৫০, ৬ জুন ২০১৭

আমানতে শুল্ক, সঞ্চয়পত্রে সুদ হ্রাস

কয়েক বছর আগে সরকারী একটি ব্যাংক কর্তৃক প্রচারিত জনপ্রিয় একটি বিজ্ঞাপনের সেøাগান ছিলÑ ‘চঞ্চল টাকা অঞ্চলে বেঁধো না।’ দৈনন্দিন সংসার চালানোর যৎসামান্য অর্থ এবং চাবির গোছা আঁচলের খুঁটে বেঁধে রাখা বঙ্গনারীর বহুদিনের অভ্যাস। এরই প্রেক্ষাপটে তখন বিজ্ঞাপনের বার্তায় বলা হয়েছিল যে, টাকা যেহেতু অস্থিরচিত্তসম্পন্ন সেহেতু তা আঁচলে বেঁধে না রেখে ব্যাংকে রাখা ভাল আমানত হিসেবে। এতে একদিকে যেমন আসলও সুরক্ষিত থাকে, তেমনি সুদও মেলে আমানতের ওপর। অস্বীকার করার উপায় নেই যে, গত কয়েক বছরে বাংলাদেশের প্রায় সব সরকারী-বেসরকারী ব্যাংকে সর্বস্তরের মানুষের আমানত বেড়েছে বহুগুণ। সরকারী ও আধা সরকারী সংস্থায় চাকরিজীবন শেষে অবসর গ্রহণ করে প্রায় সবাই তাদের প্রাপ্ত আর্থিক সুবিধাদি, এককালীন পেনশন, গ্র্যাচুইটি ইত্যাদি বাবদ প্রাপ্ত অর্থ ব্যাংকগুলোতে জমা রাখছেন, বিবিধ সঞ্চয়পত্র কিনে ও অন্যবিধ উপায়ে। পোস্ট অফিসও এর আওতার বাইরে নয়। অতঃপর অবসর জীবন অতিবাহিত করছেন ব্যাংকে আমানত হিসেবে গচ্ছিত অর্থ তথা সঞ্চয়পত্রের সুদ থেকে। এতে করে যথেচ্ছ সচ্ছলভাবে না হোক, অন্তত কায়ক্লেশে জীবনযাপন চলে যায়। অন্যদিকে সঞ্চয়ের পরিমাণ বৃদ্ধির ফলে ব্যাংকগুলোর আমানতের পরিমাণও বেড়েছে বহুগুণ। ব্যাংকগুলো শেয়ার মার্কেটসহ বিভিন্ন শিল্প-কারখানায় বিনিয়োগের সুযোগ পাচ্ছে। এমতাবস্থায় সঙ্গত কারণেই আশা করা গিয়েছিল যে, বহু প্রত্যাশিত নতুন বাজেটে বিভিন্ন ক্ষেত্রে একদিকে যেমন বিনিয়োগের সুযোগ বাড়বে, অন্যদিকে সঞ্চয়পত্রসহ আমানতকারীরা উপকৃত হবেন। বাস্তবে হিতে বিপরীত হয়েছে। নবঘোষিত বাজেটে অর্থমন্ত্রী ব্যাংকে রক্ষিত আমানতের ওপর শুল্ক আরোপ এবং সঞ্চয়পত্রে সুদ কমানোর ঘোষণার মাধ্যমে মহাবিপাকে ও দুশ্চিন্তায় ফেলে দিয়েছেন প্রায় সর্বস্তরের সাধারণ মানুষকে। সরকারের আয় বাড়াতে প্রস্তাবিত বাজেটে ‘আবগারি শুল্ক’ বসানো হয়েছে আমানতের ওপর। এতে যে সরকারের খুব বেশি আয় হবে তা নয়, মাত্র ১২শ’ কোটি টাকা। কিন্তু সাধারণ মানুষ যখন ব্যাংকে গিয়ে দেখবে যে, তার সঞ্চয়ী হিসাব থেকে সরাসরি টাকা কেটে নেয়া হচ্ছে, তখন স্বভাবতই সে হতাশ, এমনকি বিক্ষুব্ধ হবে। নতুন করে ব্যাংকে টাকা রাখার ওপর কর বাড়ানো হলে, প্রকৃতপক্ষে যা করা হয়েছে এবার, এ তো মড়ার উপর খাঁড়ার ঘা! এমনিতেই সার্বিকভাবে আমানতের ওপর সুদ কম। ফলে আমানতকারীরা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন দু’ভাবেÑ একদিকে সুদ কমছে, অন্যদিকে বাড়ছে কর। ফলে স্বভাবতই আমানতকারীরা শঙ্কিত, তারা কোথায় যাবেন? এর ফলে নতুন করে আর্থিক খাতে আবির্ভাব ঘটতে পারে ছায়া অর্থনীতির। বহুকথিত ও বিতর্কিত যুবক, ডেসটিনি, হলমার্ক ধরনের ভুঁইফোঁড় কোম্পানির পুনরাবির্ভাব ঘটতে পারে। ব্যাংকিং খাতে যেভাবে লেনদেন হওয়ার কথা ছিল তা হবে না; বরং কর আদায় ও আর্থিক কার্যক্রমে স্বচ্ছতা কমবে। সামান্য কিছু অর্থের জন্য জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের এহেন সিদ্ধান্ত সরকারের জন্য শেষ পর্যন্ত বুমেরাং তথা আত্মঘাতী হতে পারে। তবে আশার কথা এই যে, অর্থ ও পরিকল্পনা প্রতিমন্ত্রীর এক ভাষ্যে জানা যায়, বিস্তর সমালোচনার মুখে ব্যাংকে আমানতের ওপর আরোপিত বর্ধিত আবগারি শুল্ক শেষ পর্যন্ত প্রত্যাহার করা হতে পারে। মূলত সুদের হার কমায় আমানতকারীরা এখন আর ব্যাংকে টাকা রাখতে উৎসাহী হচ্ছেন না। আগামী অর্থবছরে সঞ্চয়পত্রের সুদের হার কমানোর কথাও বলেছেন অর্থমন্ত্রী। অর্থনীতিবিদদের মতে, সঞ্চয়ের বিনিময়ে প্রাপ্ত সুদ মূল্যস্ফীতির হারের চেয়ে বেশি হতে হয়। অন্যথায় টাকার ক্রয়ক্ষমতা কমায় লোকসান গুনতে হয় সঞ্চয়কারীকে। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী মার্চ শেষে ব্যাংকগুলোর গড় সুদ ছিল ৫ দশমিক ১ শতাংশ। আর মূল্যস্ফীতির হার ৫ দশমিক ৩৯ শতাংশ। অর্থাৎ এক বছরে ব্যাংকে রাখা টাকার ক্রয়ক্ষমতা যতটুকু কমেছে, সেই পরিমাণ সুদও পাচ্ছেন না আমানতকারীরা। এতে স্বভাবতই তাদের লোকসান তথা ক্ষতির সম্মুখীন হতে হচ্ছে। এহেন অসহায় অবস্থা থেকে মধ্যবিত্ত সম্প্রদায় ও নিম্নবিত্তকে স্বস্তি দিতে হবে সরকারকে। দেশের অর্থনীতিকে সচল ও উন্নয়নের ধারায় ধরে রাখতে হলে, সেটাই প্রত্যাশিত।
×