ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

ইউজিসির ঘাড়ে বিভ্রান্তির দায় চাপাচ্ছে বুয়েট শিক্ষক সমিতি

প্রকাশিত: ০৫:৪৭, ৬ জুন ২০১৭

 ইউজিসির ঘাড়ে বিভ্রান্তির দায় চাপাচ্ছে বুয়েট শিক্ষক সমিতি

বিভাষ বাড়ৈ ॥ আইনের বাইরে গিয়ে ২০ শিক্ষকের অবসরসহ আর্থিক সুবিধার দাবিতে আন্দোলনরত বুয়েট শিক্ষক সমিতি এবার উল্টো বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের (ইউজিসি) বিরুদ্ধে বিভ্রান্তি সৃষ্টির অভিযোগ এনেছে। জনকণ্ঠে প্রকাশিত এক প্রতিবেদনের প্রতিবাদ করতে গিয়ে বুয়েট শিক্ষক সমিতির সভাপতি অধ্যাপক ড. ফরিদা নিলুফার অভিযোগ করেছেন, ইউজিসি চিঠি দিয়ে ২০১২ সালের আইন ও বুয়েট শিক্ষকদের ৬৫ বছরের পেনশন গ্রহণের বিষয়ে বিভ্রান্তি সৃষ্টি করেছে। এদিকে প্রতিবাদলিপিতে এক্সটেনশনে থাকা অবস্থ্য়াও শিক্ষকদের চাকরি নিয়মিত বলে দাবি করা হলেও সরকারের সকল আইন বলছে তার উল্টোটা। এর আগে গত ২৩ মে জনকণ্ঠ পত্রিকায় ‘চাকরির বয়স নিয়ে বুয়েট শিক্ষকদের আবদার’ শীর্ষক প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়। প্রতিবেদনে উঠে আসে ২০ শিক্ষকের অবসর সুবিধাসহ নানা আর্থিক বিষয়ে জাতীয় সংসদে পাস হওয়া পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের অবসর সুবিধা আইনের বাইরে গিয়ে আন্দোলন করার বিষয়টি। জানা গেছে, আইনে নেই তবু ২০ প্রবীণ শিক্ষক দাবি তুলেছেন তাদের দিতে হবে নতুন পে-স্কেল অনুসারে অবসরসহ সকল সুযোগ-সুবিধা। দিতে হবে নতুন আইন পাসের আগে থাকা সেশন বেনিফিটসহ আরও বহু সুবিধা। অথচ আইনের ধারা ৩ অনুসারে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের ৬৫ বছর পূর্তির পর সেশন বেনিফিট বা অন্য কোন সুযোগ-সুবিধা পাওয়ার সুযোগ নেই। অথচ এ বেআইনী দাবি করেই সকল প্রশাসনিক কার্যক্রম বন্ধ রেখেছেন যেসব শিক্ষক তাদের অধিকাংশেরই এখন চাকরির বৈধতা নিয়েই আছে প্রশ্ন। কারণ তাদের প্রায় প্রত্যেকেরই ৬৫ বছর চাকরির বয়স হয়ে যাওয়ার পরও ক্লাস পরীক্ষা গ্রহণসহ নিচ্ছেন বিশ্ববিদ্যালয়ের সকল সুযোগ-সুবিধা। অবৈধ দাবি নিয়ে দিনের পর দিন শিক্ষকদের এমন আচরণে হতাশ ও ক্ষুব্ধ সাধারণ শিক্ষক-শিক্ষার্থী। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা নতুন পে-স্কেলে বেতন প্রাপ্ত হয় ২০১৫ সালে। সে হিসেবে বুয়েট শিক্ষকদের নতুন পে-স্কেল অনুসারে আগের তুলনায় বেতন বেড়ে দাঁড়ায় প্রায় দ্বিগুণ। কিন্তু যে সকল শিক্ষক ২০১২ সালের ১০ জুলাইয়ের আগে অবসরে গিয়েছেন এমন অন্তত ২০ প্রবীণ শিক্ষক নতুন পে-স্কেল অনুযায়ী পেনশনের টাকা দাবি করছে। এ নিয়ে রীতিমতো সরকারকে চাপাচাপি শুরু করেছেন শিক্ষকরা। ১৯৬২ সালের বুয়েট আইনের ৪৩ ধারা অনুযায়ী একজন শিক্ষক ৬০ বছর বয়সে অবসর নেবেন। তবে তিনি যদি শারীরিক ও মানসিকভাবে সুস্থ থাকেন এবং বিশ্ববিদ্যালয় যদি বিবেচনা ও প্রয়োজন মনে করে তাহলে অবসরের পরেও একজন শিক্ষক প্রথম ধাপে ২ বছর, দ্বিতীয় ধাপে ২ বছর এবং সর্বশেষ আরও ১ বছর সর্বোচ্চ অর্থাৎ এই ৫ বছর চাকরি বর্ধিক করতে পারবেন। তবে প্রতি ধাপে ওই শিক্ষককে বিশ্ববিদ্যালয় সিন্ডিকেটের কাছে আবেদন করতে হয় এবং সিন্ডিকেটের অনুমতি সাপেক্ষে যথাযথ কর্তৃপক্ষের মাধ্যমে রাষ্ট্রপতি ও চ্যান্সেলরের অনুমতির পর বর্ধিত সর্বোচ্চ পাঁচ বছর শিক্ষক হিসেবে কর্মরত থাকতে পারতেন। তবে তাদের চাকরি মূলত ৬০ বছরেই শেষ। অতিরিক্ত সময় ছিল এক্সটেনশন পিরিয়ড। এমন অবস্থার পরেও এই প্রবীণ শিক্ষকদের দাবির পক্ষ নিয়ে বুয়েট শিক্ষক সমিতি ক্লাস-পরীক্ষা ব্যতিরেকে সকল প্রশাসনিক কর্মকা- থেকে নিজেদের সরিয়ে রেখেছেন। এছাড়া ওই সব শিক্ষক অন্দোলন করছেন প্রায় তিন মাস ধরে। শিক্ষক সমিতির ব্যানারে আন্দোলন চললেও বেশিরভাগ শিক্ষকই এই আন্দোলনকে বলছেন ‘অনৈতিক আবদার বাস্তবায়নের আন্দোলন’; যাতে সমর্থন নেই সাধারণ কোন শিক্ষক-কর্মকর্তা-কর্মচারীর। এসব বিষয় নিয়ে শিক্ষামন্ত্রী ও ইউজিসি চেয়ারম্যানের বক্তব্যসহ প্রতিবেদন প্রকাশের ১৩ দিনের মাথায় সোমবার পাঠানো এক প্রতিবাদলিপিতে ওই আন্দোলনে সমিতির অবস্থানের ব্যখ্যা দিয়েছেন শিক্ষক সমিতির সভাপতি অধ্যাপক ড. ফরিদা নিলুফার। ‘রিপোর্টে কিছু তথ্য সঠিকভাবে উপস্থাপন করা হয়নি’ এমন দাবি করে সভাপতি বলেছেন, বর্ধিত সময়ের চাকরি কোন চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ নয় ও এটি নিয়মিত চাকরি। আইন অনুসারে বর্ধিত সময়ের শিক্ষকরা এর আগে ভারপ্রাপ্ত উপাচার্য, সিন্ডিকেট সদস্য, ডিনসহ গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করেছেন বলেও উল্লেখ করেন সমিতির সভাপতি। সুতরাং, বর্ধিত সময়ে চাকরির জন্য কোন শর্ত নেই। ২০১২ সালের ১০ জুলাইয়ের আগে ৬০ বছর পূর্ণ হওয়ার পর যাদের চাকরির মেয়াদ বর্ধিত করা হয়েছে তাদের চাকরি নিয়মিত দাবি করে শিক্ষক সমিতির সভাপতি আরও বলেন, ওই আইন জারির সময় চাকরিরত সকল শিক্ষক নিয়মিত শিক্ষক এই আইনের আওতায় আসবেন। যারা বর্ধিত সময় চাকরিরত ছিলেন তারাও নিয়মিত শিক্ষক। এদিকে ইউজিসির একটি চিঠি নিয়ে আপত্তি তুলে শিক্ষক সমিতি বলছে, আমরা মনে করি বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন এই সকল পত্র প্রেরণের মাধ্যমে ২০১২’র আইন ও বুয়েটের শিক্ষকদের ৬৫ বছর বয়সে পেনশন গ্রহণ সংক্রান্ত বিভ্রান্তি সৃষ্টি করেছে। ওই শিক্ষকদের দাবির ন্যায্যতা, যথার্থতা ও আইনসম্মত বিবেচনা করেই সমিতি আন্দোলন পরিচালনা করছে বলে উল্লেখ করেন সভাপতি। একই সঙ্গে বলেন, সমিতি আইনের আওতায় থেকে ও শিক্ষকদের সম্মান-মর্যাদা অক্ষুন্ন রেখে তাদের ন্যয্য পাওনা আদায়ে আন্দোলন পরিচালনা করছে। এদিকে বর্ধিত অবস্থায় চাকরিতে থাকা শিক্ষকদের চাকরি সমিতির সভাপতি ‘নিয়মিত’ বলে দাবি করলেও এ সংক্রান্ত কোন সরকারী আইনে তার উল্লেখ নেই। শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের সকল আদেশ-নির্দেশ, শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদের মতামত, সকল পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের চাকরির বয়স বৃদ্ধির আইন ও ইউজিসির পাঠানো চিঠি প্রমান দেয় শিক্ষকদের দাবির ন্যয্য নয়। ইউজিসি সর্বশেষ বাজেট নিয়ে গেল মাসে বুয়েট কর্তৃপক্ষকে যে চিঠি দিয়েছে তাতেও স্পষ্ট করে বলা হয়েছে, ‘শিক্ষকগণের অবসরের বয়স ৬৫ বছর করার পূর্বে (২০১২ সালের ১০ জুলাই) যে সকল শিক্ষক অবসরের পর চুক্তিভিত্তিক নিয়োজিত ছিলেন তাদের চাকরি নিয়মিত চাকরি হিসাবে গণ্য করার সুযোগ নেই। এবং তারা ৬০ বছর পূর্তিতেই পেনশন সুবিধা প্রাপ্য হবে। এখানেই শেষ নয়, পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য জাতীয় সংসদে পাস করা আইনে বলা হয়েছে, ‘২০১২ সালের ১০ জুলাইয়ের পূর্বে যে সমস্ত শিক্ষকগণের বয়স ৬০ বছর পূর্ণ হয়েছে তাদের ক্ষেত্রে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক (অবসর গ্রহণ, বিশেষ বিধান) আইন, ২০১২ প্রযোজ্য হবে না। কিংবা আপাতত বলবৎ অন্য কোন আইন, অধ্যাদেশ, রাষ্ট্রপতির আদেশ, বিশ্ববিদ্যালয় সংবিধি, বিধি, প্রবিধি, উপ-আইন অথবা আইনের ক্ষমতাসম্পন্ন কোন দলিলে যাহা কিছুই থাকুক না কেন, পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন শিক্ষক ৬৫ বছর বয়স পূর্তিতে চাকরি হতে অবসর গ্রহণ করবেন। এ অবস্থায় শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদ বলেছেন, নতুন আইন হওয়ার পর আগের সকল আইন-বিধান যা আছে সব বাতিল। তাই এখন আগের কথা বলে কিছু দাবি তোলা অন্যায়, অযৌক্তিক। বুয়েটের মতো প্রতিষ্ঠানের শিক্ষকরা যদি এভাবে বার বার দাবি তোলেন যা আইনসম্মত নয় তাহলে তো মানুষ প্রশ্ন তুলবেই। আমার আহবান হবে তারা যেন আইন মেনে দাবি করেন। তাহলে আমরা তাদের বিষয়টি দেখতে পারি। তবে বেআইনী হলে তো করার কিছু থাকে না। বুয়েটের শিক্ষকদের দাবিকে অযৌক্তিক অভিহিত করে ইউজিসির চেয়ারম্যান অধ্যাপক আব্দুল মান্নান আগেই বলেছেন, আইনে বলছে নতুন পে-স্কেল অনুযায়ী তারা পেনশনের টাকা প্রাপ্ত হবেনা। অথচ ২০ জন শিক্ষক এই টাকার দাবি করছেন। তারা বলছেন, ইউজিসির আইন মানিনা। তাদেরকে টাকা দিতে হবে। কিন্তু চাইলেই তো আইনের বাইরে কোনও কিছু করা যাবেনা। কারন, তাদের দাবি অনুযায়ী টাকা দিলে তো সরকারের আইনের বরখেলাপ হবে। সরকার আইনের বাইরে গিয়ে তো কোন কিছু করবেনা।
×