ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

সাজা দশ বছরের-অথচ ১২ বছর ধরে কনডেম সেলে

প্রকাশিত: ০৫:৩৬, ৬ জুন ২০১৭

সাজা দশ বছরের-অথচ ১২ বছর ধরে কনডেম সেলে

মশিউর রহমান খান ॥ আমি ফাঁসির আসামি নই, আমাকে ফাঁসির সেল থেকে থেকে বের করও। আমার সাজা ১০ বছর, আমার সাজা খাটা অনেক আগেই শেষ। আমাকে আমার মায়ের কাছে যেতে দাও। আমি বাড়ি যেতে চাই। আমি মেন্টাল রোগী নই। কেউ কি নেই এ দুনিয়ায় আমাকে জেল থেকে বের করবে? আর বের করতে না চাইলে আমাকে ফাঁসিতেই ঝুলিয়ে দেন? প্রতিদিন সকাল-বিকাল কয়েক বছর ধরে একটানা নিজে ফাঁসির আসামি নয় দাবি করে চিৎকার করে আর্তনাদ করেন সিলেট কেন্দ্রীয় কারাগারের কনডেম সেলে আটক ফাঁসির দ-প্রাপ্ত আসামি আবদুল খালেক। ২০০৩ সাল থেকে এ পর্যন্ত হাজতবাসসহ মোট ১৪ বছর ধরে কারাগারেই কেটেছে তার জীবন। এর মধ্যে ২০০৫ সালের ২৪ জুলাই থেকে প্রায় ১২ বছর ধরে ফাঁসির আসামি হিসেবে এই কনডেম সেলের একটি কক্ষেই আটক সে। কারাগারের দায়িত্বপ্রাপ্ত প্রায় সকল কারারক্ষী ও আটক পুরনো কয়েদিদের সবাই জানেন আবদুল খালেক মানসিক রোগী। তাই এসব উল্টোপাল্টা বলেন। কেউ তার কথা বা আর্তনাদও পর্যন্ত শোনেন না। কেউ জানতেই চায় না কি বলতে চান তিনি। তার পুরনো এ আবদারে কনডেম সেলে তার সঙ্গে থাকা দুই ফাঁসির আসামিসহ প্রতিদিনের ওই সেলের নিরাপত্তায় দায়িত্বপ্রাপ্ত কারারক্ষীসহ সবাই অতিষ্ঠ হয়ে পড়েছে। কিন্তু কারা কর্তৃপক্ষের কাছে তিনি ফাঁসির আসামি হওয়ায় তাই নির্বিকার কারা কর্তৃপক্ষসহ সবাই। ফাঁসির সেলে আটক থাকা ওই আসামির বিপরীতে আদালত থেকে কারাগারে পাঠানো তার কাগজপত্র অনুযায়ী দেখা যায় তিনি ফাঁসির দ-প্রাপ্ত আসামি। তবে তার দাবি তিনি দশ বছরের সশ্রম কারাদ-প্রাপ্ত কয়েদি আসামি। উচ্চ আদালতের আপীল শেষে সর্বোচ্চ আদালত কর্তৃক তাকে দশ বছরের সশ্রম কারাদ- দেয়া হয়েছে। এই দাবি অনুযায়ী সে অন্য সাধারণ কয়েদিদের মতোই তাকে সবার সঙ্গেই কারা সীমানায় চলাফেরা করা ও মিশতে দেয়াসহ কয়েদিদের ন্যায় সুবিধা প্রদান করার কথা। কিন্তু কারা কর্তৃপক্ষ তাকে আটকে রেখেছে ফাঁসির আসামির সেলে। তার দৃষ্টিতে এটি অন্যায় ও তার অধিকার লঙ্ঘন। তাই তিনি প্রতিদিনই চিৎকার করে সবাইকে বলেন তাকে কারাগার থেকে মুক্তি দিতে। কিন্তু কে শোনে কার কথা, তার আর্তনাদ কারা ফটক পেরিয়ে বাইরে পৌঁছায় না। সরেজমিনে ছাতকে অনুসন্ধানে দেখা গেছে, ভারতের সীমান্তবর্তী গ্রাম বনগাঁও। জেলার ছাতক উপজেলার ইসলামপুর ইউনিয়নের শেষ মাথায় গ্রাম। এ গ্রামেরই দক্ষিণ পাড়ার ছনবাড়ির ছেলে আবদুল খালেক। ২০০২ সালের হত্যা মামলায় আসামি হয়ে হারিয়েছেন ভাইবোন জীবন যৌবন সহায় সম্পদ সব। মৃত পিতা তৈমুজ আলী আর মা খুরশিদুন্নেছার সংসারে ৬ ছেলে। এক ছেলে খুন হয়েছেন। আরেকজন পাগল অবস্থায় দিনযাপন করেন বলেই এলাকাবাসী জানায়। কারাগারে প্রবেশের সময় ২৩ বছরের অবিবাহিত যুবক ছিলেন আবদুল খালেক। কারাগারে প্রবেশের পর আবদুল খালেকের খোঁজখবর করে না, এ পর্যন্ত বড় ভাই শামছুল ইসলাম মাত্র একবার দেখতে এসেছিলেন। দুনিয়াতে তাকে দেখার জন্য কারা ফটকে আসেন একমাত্র বৃদ্ধা মা। ৭০ বছরের একমাত্র মাই তার খোঁজ নিতে মাঝেমধ্যে কারা ফটকে আসেন। সর্বশেষ মা খুরশিদুন্নেছা পুত্র খালেককে দেখতে এসেছেন ৩-৪ মাস আগে। আর্থিক দুরবস্থার কারণে তিনি নিয়মিত ছেলের সঙ্গে দেখা করতে পারেন না। আটকের পর একটানা ৪ বছর গাজীপুরের কাশিমপুর হাই সিকিউরিটি প্রিজন্সে বন্দী ছিলেন। সে সময় তার মা ৪ বছরে মাত্র একবার খালেকের সাথে দেখা করেছেন। কারণ নিকটাত্মীয় না থাকা ও ঢাকায় আসার মতো অর্থ না থাকা। ঘটনাক্রম চারদিকে ঘুটঘুটে অন্ধকার। সুনসান নীরবতায় মানুষজনের চলাচল পর্যন্ত নেই। দেখা যাচ্ছে না কোনকিছুই, এমনকি পাশে দাঁড়িয়ে থাকা মানুষটিকেও। সিলেটের সুনামগঞ্জ জেলার ছাতকের সীমান্তবর্তী বনগাঁও গ্রামে এমন এক রাতের দ্বিতীয় প্রহরে বাড়িতে ফেরার পথে খুন হন ইসলামপুর ইউনিয়নের আবদুল জলিল মেম্বার (৫৫)। পরদিন তার ছেলে সেলিম যথারীতি ৫ আসামির বিরুদ্ধে ছাতক থানায় মামলা দায়ের করেন। ২০০২ সালের ১৭ জুলাই খুন হওয়া এ ঘটনায় দায়ের করা ছাতক থানার মামলার নং ২৬৩/২। খালেক ছাড়া মামলার অপর আসামিরা হচ্ছেনÑ আবদুল হাই-পিতা ছবদর আলী, মানিক মিয়া-পিতা জগম্বর আলী, মাখন মিয়া-পিতা জালাল উদ্দীন, ছালিক পিতা ফয়জুর রহমান। বেশ কিছুদিন পালিয়ে থাকার পর পার্শ্ববর্তী বিশ্বনাথের একটি ব্যাংকের সামনে থেকে গ্রেফতার হন জলিল মেম্বার হত্যা মামলার আসামি আবদুল খালেক। এরপর প্রায় আড়াই বছর কারাগারে হাজতবাসের পর তিনি জামিনে মুক্তি পান। ৪ মাস বিশ দিন পর আদালতে হাজিরা দিতে এসে শেষবারের মতো আটক হন তিনি। সেই থেকে আটক কারাবন্দী খালেক। এরপর দীর্ঘ বিচার শেষে মামলায় জজ কোর্ট থেকে পাঁচজনের বিরুদ্ধে ফাঁসি কার্যকরের রায় দেয়। রায়ের বিরুদ্ধে উচ্চ আদালতে আপীলের পর উচ্চ আদালত ওই ৫ আসামির মধ্যে খালেক ছাড়া অন্য আসামিদের ফাঁসির দ- মওকুফ করে তাদের বেকসুর খালাসের রায় প্রদান করেন। আর খালেকের সাজা ফাঁসি থেকে কমিয়ে ১০ বছরের সশ্রম কারাদ- প্রদান করা হয়। কিন্তু আজ পর্যন্ত উচ্চ আদালতের রায়ের কপি কারাগারে এসে পৌঁছায়নি। স্থানীয় লোকজন ও পারিবারিক সূত্রে জানা গেছে, ২০০২ সালের ১৭ জুলাই হঠাৎ নিখোঁজ হন ছাতকের ইসলামপুর ইউনিয়নের বনগাঁও গ্রামের তৈমুজ আলীর ছেলে আবদুল মালিক। অনেক খোঁজাখুঁজির পরও পরিবারের লোকজন তার কোন খোঁজ পায়নি। এর পাঁচদিন পর ২২ জুলাই সুরমা নদীতে তার লাশ ভেসে ওঠে। মৃত মালিকের ছোট ভাই আবদুুল খালেক (কারাবন্দী) নিজে বাদী হয়ে ১০ জনকে আসামি করে ছাতক থানায় একটি হত্যা মামলা দায়ের করেন। এর কয়েক মাসের মাথায় স্থানীয় কয়েকজনসহ জলিল মেম্বারকে নিয়ে মামলাটি আপোস করা যায় কি না, তার জন্য আবদুল খালেকের বাড়িতে যান। এ সময় আবদুল খালেক জলিল মেম্বারের সঙ্গে মামলাটি কোনক্রমেই আপোস করবে না বলে রাগারাগি করেন। পরবর্তীতে কয়েক দফা বোঝানোর পরও আপোস করতে রাজি হননি আবদুল খালেক। মামলা চালিয়ে যাবেন বলে ঘোষণা দেন। এরপর একই বছরের ৫ ডিসেম্বর রাতে ছনবাড়ি থেকে বাড়ি ফেরার পথে খুন হন জলিল মেম্বার। এ ঘটনায় বনগাঁও গ্রামের দক্ষিণপাড়ার আবদুল খালেক, তার ভাই শামসুল ইসলাম, একই এলাকার আবদুল হাই, মানিক মিয়া, মাখন মিয়া ও ছালিক মিয়াকে আসামি করে মামলা দায়ের করেন জলিল মেম্বারের ছেলে সেলিম মিয়া। পরবর্তীতে এই মামলা সুনামগঞ্জ জজ কোর্ট থেকে সিলেট দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনালে স্থানান্তরিত হয়। ওই মামলায় ২০০৫ সালের ২৪ জুলাই সিলেটের দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনালের বিচারক আসামি আবদুল খালেক, আবদুল হাই, মানিক মিয়া, মাখন মিয়া ও ছালিক মিয়াকে ফাঁসির আদেশ দেন। ওইদিন থেকে আজ পর্যন্ত ফাঁসির সেলেই আটক রয়েছেন আবদুল খালেক। এই রায়ের বিরুদ্ধে আবদুল খালেকের কোন অর্থকড়ি না থাকায় বাকি চার আসামির টাকায় আপীল করেন। উচ্চ আদালতে ক্রিমিনাল আপীল নং ৩৭৫৭/২০০৫ এবং ডেথ রেফারেন্স নং ১১৬/২০০৫। এরপর হাইকোর্ট পাঁচ আসামির মধ্যে চারজনকে খালাস ও আবদুল খালেকের বয়স বিবেচনা করে ২০১০ সালের ২২ মার্চ হাইকোর্ট ১০ বছরের সশ্রম কারাদ- প্রদান করেন। কিন্তু আজ পর্যন্ত এ রায় সিলেট কেন্দ্রীয় কারাগারে এসে পৌঁছায়নি। আবদুল খালেকের রায়ের কপি না পৌঁছানোয় কারা কর্তৃপক্ষ তাকে জজ কোর্টের দেয়া রায়ের কপি পেয়ে নিয়মানুযায়ী ফাঁসির সেলেই আটকে রাখে। অপরদিকে ২০১৪ সালের ২১ আগস্ট সিলেটের দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনালে নথি এসে পৌঁছায়। কিন্তু গত সাত বছরেও তা কারাগারে এসে পৌঁছায়নি। যার খেসারত প্রতিনিয়তই দিচ্ছেন আবদুল খালেক। কারা সূত্র জানায়, দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনালের সাজা উচ্চ আদালত থেকে কমে ১০ বছর হওয়ার রায়ের কপি এসে সিলেটের দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনালে এসে পৌঁছেছে বলে আবদুল খালেক অনেক আগেই শুনলেও খোঁজখবর নেয়ার মতো কোন লোক না থাকায় এ বিষয়ে কোন কিছুই করতে পারেননি তিনি। বাদী সেলিম মিয়া জনকণ্ঠকে বলেন, আমরা জানি যে এই মামলায় আবদুল খালেকের যাবজ্জীবন সাজা হয়েছে। তার ফাঁসি হয়নি বলেই জানি। আবদুল খালেক এখন সিলেট কেন্দ্রীয় কারাগারে আটক আছে। শুনেছি যে তাকে নাকি ফাঁসির সেলেই আটক রাখা হয়েছে। এছাড়া আমার বড় ভাই এই মামলা চালিয়েছেন তিনি বর্তমানে সৌদি আরবে আছেন। তাই এর বেশি কিছু বলতে পারবো না। ইসলামপুর ইউনিয়নের বর্তমান চেয়ারম্যান আবদুল হাকিম শুক্রবার গণেশপুর ইউপি ভবনে জনকণ্ঠকে বলেন, আমার এই ভবনেই খালেকের মা খরশিদুন্নেছো কিছুদিন পরপরই আসেন। তিনি শুধু বলেন আমার ছেলে নিরপরাধ হিসেবে জেল খাটতেছে। তাকে জেল থেকে বের করার ব্যবস্থা করুন। কিন্তু আমরা শুনেছি যে, খালেকের বিরুদ্ধে করা মামলায় সবাই খালাস পেলেও তাকে আমৃত্যু কারাদ- প্রদান করেছে আদালত। তাই এ বিষয়ে কিছুই করতে পারিনি। অতি গরিব পরিবারের সন্তান খালেকের একটি ভাই পাগল। অপর ভাইও খুন হয়েছিলেন। শুনেছি যার বাদী ছিলেন খালেক নিজেই। এ বিষয়ে আর্তনাদ করে বলেন, আবদুল খালেকের মা খোরশেদুন্নেছা জনকণ্ঠকে বলেন, আমার এক ছেলে খুন হয়েছে, আজ পর্যন্ত তার কোন বিচার আমি পাইনি। টাকা নাই বলে এই মামলাটার পর্যন্ত কোন খোঁজ খবর নিতে পারিনি। আরেক ছেলে জেলে বিনা কারণে বন্দী। আর এক ছেলে পাগল। খালেকের কারণে আমিও পাগলের মতোই জীবন কাটাচ্ছি। স্বামীহারা এই সন্তানদের নিয়েই আমার জীবন। আমার ছেলে মামলায় ফাঁসি থেকে বেঁচেছে বলে অনেক আগেই শুনেছি। আমি গরিব মানুষ আমার কোন অর্থকড়ি নেই। কতবার জেলখানায় গিয়েছি, চেয়ারম্যান, মেম্বার, মাতাব্বর সবার কাছেই গেছি আমার ছেলের দশ বছরের সাজা হয়েছে ফাঁসি হয়নি। কিন্তু কেউ কোন সাহায্য করেনি। একই মামলায় রায়ে সবাই খালাস পাইছে। ছেলের সাজা তো অনেক আগেই শেষ হয়েছে। সর্বশেষ জেলে যাওয়ার আগেও প্রায় আড়াই বছর সে কারাগারে হাজত খেটেছে। এরপরও তার ১০ বছরের সাজার মেয়াদ শেষ হয়েছে অনেক আগেই। তবু সরকার আর কারাগারের লোকজন তাকে মুক্তি দিচ্ছেন না। আমার এক ছেলে পাগল আর অন্যরা তার তেমন কোন খোঁজও নেয় না। আমি আমার ছেলের মুক্তি চাই তারে অতি তাড়াতাড়ি আমি আমার বুকে পেতে চাই। আমার কেউ নেই। বাবারা আপনারা সহায়তা করেন। সরকার চাইলেই আমার ছেলে মুক্তি পেতে পারে। একই সঙ্গে তিনি খুন হওয়া ছেলেরও বিচার চান খুরশিদুন্নেচ্ছা।
×