ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

মৃত্যুদণ্ডের বদলে হাইকোর্টে ঐশীর যাবজ্জীবন

প্রকাশিত: ০৫:৩৪, ৬ জুন ২০১৭

মৃত্যুদণ্ডের বদলে হাইকোর্টে ঐশীর যাবজ্জীবন

স্টাফ রিপোর্টার ॥ বাবা-মাকে হত্যার অভিযোগে বিচারিক আদালতে মৃত্যুদ-প্রাপ্ত ঐশী রহমানের সাজা কমিয়ে তাকে যাবজ্জীবন কারাদ- প্রদান করেছেন হাইকোর্ট। যাবজ্জীবন কারাদ-ের সঙ্গে ঐশীকে পাঁচ হাজার টাকা জরিমানা, অনাদায়ে আরও ছয় মাসের কারাদ- দেয়া হয়েছে। হত্যায় সহযোগিতার জন্য ঐশীর বন্ধু মিজানুর রহমানকে বিচারিক আদালতের দেয়া দুই বছরের কারাদ-ের রায় হাইকোর্টেও বহাল রাখা হয়েছে। অন্যদিকে প্রায় এক যুগ আগে ময়মনসিংহের গার্লস ক্যাডেট কলেজের দ্বাদশ শ্রেণীর ছাত্রী শর্মিলা শাহরিন পলেন হত্যার অভিযোগে করা মামলার বিচার কার্যক্রম চলতে আইনগত কোন বাধা নেই। হাইকোর্টের রায়ের বিরুদ্ধে আসামিপক্ষের করা আবেদন খারিজ করে দিয়েছেন সর্বোচ্চ আদালত আপীল বিভাগ। সোমবার আপীল বিভাগ ও হাইকোর্টের সংশ্লিষ্ট বেঞ্চ এ আদেশ প্রদান করেছেন। বিচারিক আদালতে মৃত্যুদ-প্রাপ্ত ঐশী রহমানের সাজা কমিয়ে তাকে যাবজ্জীবন কারাদ- প্রদান করেছেন হাইকোর্ট। সোমবার ঐশী রহমানের ডেথ রেফারেন্স (মৃত্যুদ- অনুমোদন), আপীল ও জেল আপীলের শুনানি শেষে এ রায় ঘোষণা করেন আদালত। বিচারপতি জাহাঙ্গীর হোসেন সেলিম ও বিচারপতি মোহাম্মদ জাহাঙ্গীর হোসেনের সমন্বয়ে গঠিত বেঞ্চ এ রায় দেন। গত ৭ মে এ বিষয়ে শুনানি শেষ হয়। সেদিন বিষয়টি রায়ের জন্য অপেক্ষমাণ (সিএভি) রাখা হয়েছিল। হাইকোর্টে এ মামলায় রাষ্ট্রপক্ষে শুনানি করেন ডেপুটি এ্যাটর্নি জেনারেল জহুরুল হক জহির; তার সঙ্গে ছিলেন সহকারী এ্যাটর্নি জেনারেল আতিকুল হক সেলিম। অন্যদিকে ঐশীর পক্ষে ছিলেন সুজিত চ্যাটার্জি বাপ্পী। আসামিপক্ষের আইনজীবী সুজিত চ্যাটার্জি বাপ্পী জনকণ্ঠকে বলেছেন, এ রায়ের বিরুদ্ধে আমরা আপীল করব প্রাথমিকভাবে এটাই সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে। আশা করি আপীলে আমরা বেনিফিট পাব। আদালত তার রায়ে ঐশীকে কনডেম সেল থেকে সাধারণ কয়েদিদের সঙ্গে রাখারও নির্দেশ দিয়েছেন। উচ্চ আদালতে না গেলেও আসামি রেয়াত পাবেন। জেল কোড অনুয়ায়ী প্রতিবছরই রেয়াত পাবে। এছাড়া ঐশী গ্রেফতার হবার পর যতদিন কারাগারে আটক রয়েছেন সেটা বাদ যাবে। উল্লেখ্য, এর আগে সুপ্রীমকোর্টের জারিকৃত এক সার্কুলারে বলা হয়েছে, আসামির মামলা বিচারাধীন থাকাবস্থায় তার কারাবাস যে কোন প্রকার কারাদ-ে মোট দ-ের সময়কাল হতে বিয়োগ হবে। আইনজীবী সুজিত চ্যাটার্জি বাপ্পী আরও বলেন এই মৃত্যুতে মামলা চূড়ান্ত নিষ্পত্তি না হওয়া পর্যন্ত কিছু বলা যাবে না। অপরদিকে ডেপুটি এ্যাটর্নি জেনারেল জহিরুল হক জহির সাংবাদিকদের জানান, ঐশী রহমানের মৃত্যুদ-ের সাজা পাঁচ কারণে কমিয়ে যাবজ্জীবন কারাদ- দেন হাইকোর্ট। এর মধ্যে রয়েছে বয়স, পারিবারিক মানসিক রোগ, বাবা-মার অবহেলা, ঘটনার দুদিনের মধ্যে আত্মসমর্পণ ও মাদকাসক্ত। এর আগে গত ১০ এপ্রিল মানসিক অবস্থা পর্যবেক্ষণে ঐশীকে হাইকোর্টে হাজির করা হয়। সেদিন খাস কামরায় দুপক্ষের আইনজীবীর উপস্থিতিতে তার সঙ্গে কথা বলেন বিচারকরা। তার আগে ১২ মার্চ ডেথ রেফারেন্স ও আপীলের শুনানি শুরু হয়। পুলিশ কর্মকর্তা মাহফুজুর রহমান ও তার স্ত্রী স্বপ্না রহমানকে হত্যার দায়ে ২০১৫ সালের নবেম্বরে তাদের মেয়ে ঐশী রহমানকে মৃত্যুদ- দেন আদালত। একই সঙ্গে ঐশীর বন্ধু মিজানুর রহমান রনিকে দুই বছর কারাদ- ও পাঁচ হাজার টাকা জরিমানা করা হয়। অনাদায়ে এক মাসের কারাদ- দেয়া হয়। মামলার অন্য আসামি আসাদুজ্জামান জনিকে খালাস দেন আদালত। রায়ের বিরুদ্ধে ২০১৫ সালের ৬ ডিসেম্বর হাইকোর্টে ঐশীর আইনজীবী আপীল আবেদন করেন। এর আগে মৃত্যুদ- অনুমোদনের জন্য ডেথ রেফারেন্স হিসেবেও মামলাটি হাইকোর্টে পাঠানো হয়। ওই দিন ৬ ডিসেম্বর ২৫টি যুক্তি দেখিয়ে ঐশী রহমান হাইকোর্টে আপীল করেন। স্ত্রী, দুই সন্তান এবং শিশু গৃহকর্মীকে নিয়ে মালিবাগের চামেলীবাগের এক ফ্ল্যাটে থাকতেন পুলিশের স্পেশাল ব্রাঞ্চের (রাজনৈতিক শাখা) পরিদর্শক মাহফুজুর রহমান। ২০১৩ সালের ১৬ আগস্ট ওই বাসা থেকেই তাদের ক্ষতবিক্ষত লাশ উদ্ধার করা হয়। এর পরদিন ঐশী গৃহকর্মী সুমীকে নিয়ে রমনা থানায় আত্মসমর্পণ করেন। হত্যাকা-ের ঘটনায় নিহত মাহফুজুর রহমানের ভাই মশিউর রহমান ওই দিনই পল্টন থানায় হত্যা মামলা করেন। ২৪ আগস্ট ঐশী আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দী দেন। তবে পরে তিনি ওই জবানবন্দী প্রত্যাহারের আবেদন করেন। ২০১৫ সালের ৯ মার্চ ঐশী ও তার দুই বন্ধুর বিরুদ্ধে একটি অভিযোগপত্র এবং নিহতদের বাসার শিশু গৃহকর্মী সুমীর বিরুদ্ধে শিশু আইনে পৃথক অভিযোগপত্র দেয় ঢাকা মহানগর পুলিশের গোয়েন্দা বিভাগ (ডিবি)। পরে ওই বছরের ৬ মে ঢাকার মহানগর দায়রা জজ আদালত প্রথমে ঐশীসহ তিনজনের বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন করেন। পরে মামলাটি (নিষ্পত্তি) বিচারের জন্য দ্রুতবিচার ট্রাইব্যুনালে পাঠায়। ট্রাইব্যুনাল ৩০ নবেম্বর আবারও অভিযোগ গঠন করে। বিচারিক আদালতে মামলা চলবে ময়মনসিংহের গার্লস ক্যাডেট কলেজের দ্বাদশ শ্রেণীর ছাত্রী শর্মিলা শাহরিন পলেন হত্যার অভিযোগে করা মামলার বিচার কার্যক্রম চলতে আইনগত কোন বাধা নেই। হাইকোর্টের রায়ের বিরুদ্ধে আসামিপক্ষের করা আবেদন খারিজ করে দিয়েছেন সর্বোচ্চ আদালত। সোমবার প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহার নেতৃত্বাধীন চার সদস্যের আপীল বেঞ্চ আবেদন খারিজ করে আদেশ দেন। আদালতে রাষ্ট্রপক্ষে শুনানিতে অংশ নেন অতিরিক্ত এ্যাটর্নি জেনারেল মুরাদ রেজা। নিহত পলেনের পক্ষে শুনানিতে ছিলেন জ্যেষ্ঠ আইনজীবী খন্দকার মাহবুব হোসেন ও ফাওজিয়া করিম ফিরোজ। আসামিপক্ষে শুনানি করেন আইনজীবী রোকন উদ্দিন মাহমুদ। মামলা সূত্রে জানা যায়, ময়মনসিংহ গার্লস ক্যাডেট কলেজের ছাত্রী হোস্টেল থেকে ২০০৫ সালের ১১ ফেব্রুয়ারি দ্বাদশ শ্রেণীর ছাত্রী শর্মিলা শাহরিন পলেনের লাশ উদ্ধার করা হয়। ওই দিন ময়মনসিংহ কোতোয়ালি থানায় অপমৃত্যুর মামলা করেন কলেজের অধ্যক্ষ। পরে ওই বছরের ১৯ ফেব্রুয়ারি পলেনের বাবা এম এ বাশার পাটোয়ারী ময়মনসিংহের আদালতে হত্যার অভিযোগ মামলা করেন। আদালত বিচার বিভাগীয় তদন্তের নির্দেশ দেন। ২০১৩ সালে বিচার বিভাগীয় তদন্তে উঠে আসে, শর্মিলাকে হত্যা করা হয়েছিল এবং ঘটনাটি ধামাচাপা দিতে কর্তৃপক্ষ ঘটনাটিকে আত্মহত্যা বলে সাজিয়েছিল। ঘটনার প্রায় ১১ বছর পর গত বছরের ৩ মার্চ ওই মামলায় কলেজের তৎকালীন এ্যাডজুট্যান্ট মেজর নাজমুল হকসহ পাঁচজনের বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন করেন ময়মনসিংহের জেলা দায়রা জজ আদালত। অপর চারজন হলেন ক্যাডেট কলেজের তৎকালীন সহযোগী অধ্যাপক মোঃ আবুল হোসেন, নন-কমিশন অফিসার মোঃ নওশের উদ-জামান, হোস্টেলের আয়া হেনা বেগম ও মেজর মুনীর আহাম্মদ চৌধুরী। পাঁচজনের মধ্যে নাজমুল হকসহ চারজন জামিনে আছেন। এদের মধ্যে মুনির আহমেদ পলাতক রয়েছেন। সাজা কমানোর বিষয়ে হাইকোর্টের রায়ে বলা হয়, মৃত্যুদ-প্রাপ্ত আসামি জোড়া খুনের ঘটনা ঘটিয়েছে সুস্পষ্ট উদ্দেশ্য ছাড়া ও মানসিকভাবে বিচ্যুতির কারণেই। মামলার আসামি (ঐশী রহমান) এ্যাজমাসহ নানা রোগে আক্রান্ত। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয় হাসপাতালের প্রতিবেদন অনুযায়ী, আসামি ঐশীর দাদি ও মামা অনেক আগে থেকেই মানসিকভাবে বিপর্যস্ত ছিলেন। তার পরিবারে মানসিক বিপর্যস্তের ইতিহাস রয়েছে। হত্যাকা-ের ঘটনার সময় তার বয়স ছিল ১৯ বছর। সে এ ঘটনার সময় সাবালকত্ব পাওয়ার মুহূর্তে ছিল। তার বিরুদ্ধে অতীতে ফৌজদারি অপরাধের নজির নেই। সে ঘটনার দুইদিন পরই স্বেচ্ছায় থানায় আত্মসমর্পণ করে। উদ্ভূত পারিপার্শিক অবস্থা বিবেচনায় নিয়ে সাজা কমানো হয়েছে। তার (ঐশী) বাবা পুলিশে ও মা ডেসটিনিতে চাকরিরত ছিলেন। জীবন-জীবিকা নিয়ে ব্যস্ত ছিলেন তারা। ঐশীকে পর্যাপ্ত সময় দিতে পারেননি। তারা যখন উপলব্ধি করছিলেন ঠিক সে সময় তার জীবন আসক্তিতে ও উচ্ছন্নে (ধ্বংস) চলে গেছে। আমেরিকা, অস্ট্রেলিয়া, কানাডাসহ বিভিন্ন দেশে মৃত্যুদ-কে নিরুৎসাহিত করা হয়েছে। কিন্তু আমাদের দেশে মৃত্যুদ- কমানোর কোন গাইডলাইন নেই। এমনকি তা বিলুপ্ত করার পরিবেশ আসেনি। শিক্ষার হার বেড়েছে। জনসংখ্যাও বেড়েছে। ফলে অপরাধের প্রবণতাও বাড়ছে। এ অবস্থায় মৃত্যুদ- রহিত করা যুক্তি সঙ্গত নয়। মৃত্যুদ-ই একমাত্র দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি নয়। এটা কার্যকর করলেই যে সমাজ থেকে অপরাধ দূর হয়ে যাবে তা নয়। কম সাজাও অনেক সময় সমাজ থেকে অপরাধ কমাতে সুস্পষ্ট ও গুরুত্বপূর্ণভাবে ভূমিকা রাখতে পারে বা সাহায্য করে। মৃত্যুদ- রহিত করতে সমাজের প্রতিটি স্তরে সুশাসন ও মানুষের মধ্যে অপরাধ প্রবণতা রোধে সচেতনা বৃদ্ধি করতে হবে। শুধু রাষ্ট্রের মধ্যে নয় সমাজের প্রতিটি স্তরে সুশাসন নিশ্চিত করতে হবে। নিম্ন আদালত সামাজিক অবক্ষয় বিবেচনায় নিয়ে কিছুটা আবেগ প্রবণ হয়ে এ রায় দিয়েছে। যেখানে বলা হয়েছে, একটা মেয়ে তার পিতা-মাতাকে নিজের হাতে নিষ্ঠুরভাবে হত্যা করার সাহস দেখিয়েছে। কিন্তু সাজা নির্ধারণ ও বিচারের ক্ষেত্রে এ ধরনের আবেগ প্রদর্শনের সুযোগ নেই। আদালত আইনগত তথ্যাদি ও প্রমাণাদি বিবেচনায় নেবে। যেখানে একজন নারী হিসেবে ১৯ বছর বয়সে এ ধরনের অপরাধ করেছে। রায়ে আরও বলা হয়, সন্তানদের জন্য বাবা-মা ও অভিভাবকই হলেন প্রাথমিক শিক্ষক। এটা হিসাব করেই তাদের জন্য ভাল পরিবেশে ও সময় দেয়া প্রয়োজন।
×