ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

সাবেক বিচারপতির দুর্নীতি তদন্তে সুপ্রীমকোর্ট প্রশাসনের বাধা!

প্রকাশিত: ০৫:৫৪, ৫ জুন ২০১৭

সাবেক বিচারপতির দুর্নীতি তদন্তে সুপ্রীমকোর্ট প্রশাসনের বাধা!

আরাফাত মুন্না ॥ আপীল বিভাগের সাবেক বিচারপতি মোঃ জয়নুল আবেদীনের বিরুদ্ধে থাকা দুর্নীতির অভিযোগ তদন্তে দুর্নীতি দমন কমিশনকে (দুদক) প্রকারান্তরে বাধা দিচ্ছে সুপ্রীমকোর্ট। সুপ্রীমকোর্টের আপীল বিভাগের অতিরিক্ত রেজিস্ট্রার অরুনাভ চক্রবর্তী স্বাক্ষরিত এক চিঠিতে বলা হয়েছে সাবেক বিচারপতি জয়নুল আবেদীনের বিরুদ্ধে দুদকের কোন ধরনের ব্যবস্থা গ্রহণ সমীচীন হবে না। প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহার অনুমোদন ও নির্দেশ ক্রমেই অরুনাভ চক্রবর্তী চিঠিটি দুদকে পাঠান বলে দুদকের নথি সূত্রে জানা গেছে। জয়নুল আবেদীন ১৯৯১ সালে বিএনপি সরকার ক্ষমতায় থাকার সময় হাইকোর্টের বিচারপতি হিসেবে নিয়োগ পান। পরে ২০০৯ সালে আপীল বিভাগের বিচারপতি হিসেবে অবসরে যান তিনি। আলোচিত এই বিচারপতি ২০০৪ সালে একুশে আগস্ট গ্রেনেড হামলার ঘটনায় বিদেশী গোয়েন্দা সংস্থা জড়িত বলে তদন্ত ভিন্ন খাতে প্রবাহিত করার চেষ্টাও করেছিলেন বলে জানা গেছে। আপীল বিভাগের সাবেক বিচারপতি মোঃ জয়নুল আবেদীনের বিরুদ্ধে জ্ঞাত আয় বহির্ভূত সম্পদ অর্জনের অভিযোগে ২০১০ সালের ১৮ জুলাই সম্পদের হিসাব চেয়ে নোটিস দেয় দুদক। জানা গেছে, তার বিরুদ্ধে আমেরিকার অর্থ পাচারেরও অভিযোগ রয়েছে দুদকের কাছে। বিচারপতি জয়নুল আবেদীনের বিষয়ে অনুসন্ধানের স্বার্থে গত ২ মার্চ সুপ্রীমকোর্টের কাছে প্রয়োজনীয় কাগজপত্র চেয়ে চিঠি দেয় দুর্নীতি দমন কমিশন। এর জবাবে গত ২৮ এপ্রিল আপীল বিভাগের অতিরিক্ত রেজিস্ট্রার অরুনাভ চক্রবর্তী স্বাক্ষরিত একটি চিঠি দুদকে পাঠায় সুপ্রীমকোর্ট প্রশাসন। এই চিঠিতে বলা হয়, বিচারপতি জয়নুল আবেদীন দীর্ঘকাল বাংলাদেশ সুপ্রীমকোর্টের হাইকোর্ট বিভাগ এবং আপীল বিভাগের বিচারক হিসেবে দায়িত্ব পাল করেন। দায়িত্ব পালনকালীন সময়ে তিনি অনেক মামলার রায় প্রদান করেন। অনেক ফৌজদারি মামলায় তার প্রদত্ত রায়ে অনেক আসামির ফাঁসিও কার্যকর করা হয়েছে। চিঠিতে আরও বলা হয়, বাংলাদেশের সংবিধানের ১১১ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী বিচারপতি জয়নুল আবেদীনের দেয়া রায় সকলের উপর বাধ্যকর। এমন পরিস্থিতিতে সর্বোচ্চ আদালতের একজন অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতির বিরুদ্ধে দুদক কোন ব্যবস্থা গ্রহণ করলে তার দেয়া রায়সমূহ প্রশ্নবিদ্ধ হবে এবং জনমনে বিভ্রান্তির উদ্রেক ঘটবে। সাবেক বিচারপতি জয়নুল আবেদীনের বিরুদ্ধে দুর্নীতি দমন কমিশনের কোনরকম ব্যবস্থা গ্রহণ করা সমীচীন হবে না মর্মে সুপ্রীমকোর্ট মনে করে বলেও চিঠিতে উল্লেখ করা হয়েছ। দুদক সূত্র জানায়, চিঠি পাওয়া পর তা যাচাই বাছাইও করেছে দুদক। চিঠি পাওয়ার পর তা কমিশনের সভায় উপস্থাপন করা হয় এবং আনুষ্ঠানিক ভাবে চিঠিটির সঠিকতা সম্পর্কে খোঁজ নেয়ার সিদ্ধান্ত হয় ওই সভায়। সভার সিদ্ধান্ত অনুযায়ী চিঠির সঠিকতা যাচাই করে তা আপীল বিভাগের অতিরিক্ত রেজিস্ট্রার অরুনাভ চক্রবর্তীরই বলে নিশ্চিত হয় দুদক। এ বিষয়ে দুদকের একটি নথিতে বলা হয়েছে, ‘পত্রটি স্বাক্ষরকারী অরুনাভ চক্রবর্তী মৌখিকভাবে জানিয়েছেন, প্রধান বিচারপতির অনুমোদন ও নির্দেশক্রমে প্রেরিত পত্রটিতে তার স্বাক্ষর সঠিক।’ এ বিষয়ে দুদকের দায়িত্বপ্রাপ্ত এক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে জনকণ্ঠকে বলেন, দুদকের কাছে কোন অভিযোগ এলেই প্রথমে অভিযোগ অনুসন্ধান করা হয়। দুদক একটি স্বাধীন প্রতিষ্ঠান। যে কারও দুর্নীতির বিষয়ে তদন্ত করার এখতিয়ার দুদকের রয়েছে। এ জন্য সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিকেও চিঠি দেয় দুদক। কিন্তু আপীল বিভাগের একজন সাবেক বিচারপতির বিরুদ্ধে অনুসন্ধান ঠেকাতে সুপ্রীমকোর্টের পক্ষ থেকে যে চিঠি দেয়া হয়েছে তা অত্যন্ত দুঃখজনক। জানা গেছে, সম্পদের বিবরণী চেয়ে দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) দেয়া নোটিসের বৈধতা চ্যালেঞ্জ করে বিচারপতি জয়নুল আবেদীন ২০১০ সালের ২৫ জুলাই রিট করেছিলেন। রিটের ওপর শুনানি গ্রহণের পর বিচারপতি মোঃ আবদুল ওয়াহ্হাব মিঞা ও বিচারপতি কাজী রেজা-উল হক সমন্বয়ে গঠিত হাইকোর্ট বেঞ্চ বিষয়টি উত্থাপিত হয়নি বিবেচনায় খারিজ করে দেন। ওই সময় দুদকের আইনজীবী খুরশিদ আলম খান সাংবাদিকদের জানিয়েছিলেন, রিট খারিজের ফলে এখন দুদকের দেয়া নোটিসের ভিত্তিতে পরবর্তী কার্যক্রম গ্রহণে আর কোন আইনগত বাধা নেই। সম্পদ বিবরণী চেয়ে গত ১৮ জুলাই দুদক বিচারপতি মোঃ জয়নুল আবেদীনকে নোটিস দিয়েছিল বলে তিনি জানান। রিট দায়েরকারীর আইনজীবী আহসানুল করিম ওই সময় সাংবাদিকদের জানিয়েছিলেন, ‘তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময় শেখ হাসিনাকে দুদক সম্পদের বিবরণী চেয়ে নোটিস দেয়। ওই নোটিস দেয়ার প্রক্রিয়া আইনানুগ হয়েছে বলে আপীল বিভাগের সিদ্ধান্ত রয়েছে। আপীল বিভাগের সিদ্ধান্ত হাইকোর্টের জন্য মানা বাধ্যকর। এ যুক্তিতে আদালত রিটটি উপস্থাপন করা হয়নি বিবেচনায় খারিজ করে দেন। একুশে আগস্ট গ্রেনেড হামলার তদন্তে কারসাজি ॥ বিএনপি-জামায়াত চারদলীয় জোট সরকারের আমলে ২০০৪ সালের ২১ আগস্ট রাজধানীর বঙ্গবন্ধু এভিনিউয়ে আওয়ামী লীগের সমাবেশে ভয়াবহ গ্রেনেড হামলা চালানো হয়। ওই হামলায় আহত হন তৎকালীন বিরোধীদলীয় নেতা বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাসহ আওয়ামী লীগের কয়েক শ’ নেতাকর্মী। নিহত হন আওয়ামী লীগের মহিলাবিষয়ক সম্পাদক আইভি রহমানসহ ২৪ জন। এই ভয়াবহ হামলার ঘটনায় ওইদিন নগরীর মতিঝিল থানায় দুটি মামলা দায়ের করে পুলিশ। একটি বিস্ফোরক আইনে, অন্যটি হত্যার ঘটনায়। মামলা তদন্তের দায়িত্ব পায় সিআইডি। পাশাপাশি সুপ্রীমকোর্টের আপীল বিভাগের বিচারক বিচারপতি মোঃ জয়নুল আবেদীনের নেতৃত্বে একটি বিচার বিভাগীয় তদন্ত কমিশন গঠন করে তৎকালীন সরকার। সেই কমিশনও নিরপেক্ষভাবে কাজ না করে তৎকালীন সরকারের ‘ধামাধরা’ হিসেবে কাজ করতে থাকে বলে অভিযোগ রয়েছে। ঘটনার ৪০ দিনের মাথায় বিচার বিভাগীয় কমিশন সরকারের কাছে ১৬২ পৃষ্ঠার প্রতিবেদন জমা দেয়। কমিশনের রিপোর্টে জোরালোভাবে বলা হয়, গ্রেনেড হামলার সঙ্গে একটি শক্তিশালী বিদেশী গোয়েন্দা সংস্থা জড়িত ছিল। অর্থাৎ কমিশনের অভিযোগের আঙ্গুল ছিল ভারতীয় গোয়েন্দা সংস্থার দিকে। কমিশনের রিপোর্টে সুনির্দিষ্টভাবে গোয়েন্দা সংস্থার নাম বলা হয়নি, অথচ বিদেশী গোয়েন্দা সংস্থা যে জড়িত তা সুস্পষ্টভাবে বলা হয়েছিল। তবে ২০০৪ সালের ৪ অক্টোবর একটি জাতীয় দৈনিককে দেয়া সাক্ষাতকারে কমিশনের চীফ, বিচারপতি জয়নাল আবেদীন বৃহৎ প্রতিবেশী শক্তি হিসেবে ভারতের প্রতি ইঙ্গিত করেন। এই রিপোর্ট দেয়ার পর তিনি ব্যাপক আলোচিত-সমালোচিত হন। তৎকালীন বিরোধী দল আওয়ামী লীগ কমিশনের এই প্রতিবেদন প্রত্যাখ্যান করে। ড. কামাল হোসেনের নেতৃত্বাধীন জাতীয় তদন্ত কমিটিও জয়নাল আবেদীনের প্রতিবেদন প্রত্যাখ্যান করেন।
×