ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

‘এ বাড়ির সঙ্গে আমার জীবন জড়িত,... বাড়ি ছাড়ব না’

প্রকাশিত: ০৫:১৩, ৫ জুন ২০১৭

‘এ বাড়ির সঙ্গে আমার জীবন জড়িত,... বাড়ি ছাড়ব না’

স্টাফ রিপোর্টার ॥ বিএনপির স্থায়ী কমিটির নেতা মওদুদ আহমেদ গুলশান-২ নম্বর সেকশনের ১৫৯ নম্বর প্লটের বাড়িটি পাচ্ছেন না। এই বাড়ি নিয়ে করা মামলায় আপীল বিভাগের দেয়া রায় পুনর্বিবেচনার (রিভিউ) দুদকের ও মওদুদের ভাই মনজুরের পৃথক দুটি আবেদন কিছু পর্যবেক্ষণ দিয়ে রবিবার খারিজ করে দিয়েছেন প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহার নেতৃত্বাধীন পাঁচ সদস্যের আপীল বিভাগের বেঞ্চ। ৩১ মে শুনানি শেষ রায়ের জন্য রবিবার দিন ধার্য ছিল। নির্ধারিত দিনে এই রায় ঘোষণা করে আদালত। আদালতে ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদের পক্ষে শুনানি করেন ব্যারিস্টার মওদুদ আহমেদ নিজেই, ব্যারিস্টার রোকন উদ্দীন মাহমুদ ও কামরুল হক সিদ্দিকী। অপরদিকে রাজউক ও রাষ্ট্রপক্ষে ছিলেন এ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম। দুদকের পক্ষে ছিলেনÑ এ্যাডভোকেট আবদুল মতিন খসরু ও এ্যাডভোকেট খুরশিদ আলম খান। রায় ঘোষণার পর এ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম সাংবাদিকদের জানান, দুদক ও মওদুদের ভাইয়ের পক্ষে করা রিভিউ খারিজ করে দিয়েছেন আপীল বিভাগ। বাড়িটি রাজউকের নামে বরাদ্দ রয়েছে। এখন আর মওদুদের বাড়িতে থাকার কোন অধিকার নেই। অন্যদিকে ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদ বলেন, ‘এটা সরকারের বাড়ি নয়। আমি বাড়ি ছাড়বো না। বাড়ি ছাড়ার বিষয়টি মালিক ও আমি বুঝবো।’ দুদকের আইনজীবী খুরশিদ আলম খান জানান, মওদুদ আহমদের বাড়ি নিয়ে করা দুদক ও তার ভাই মনজুরের দুটি রিভিউ খারিজ করে দিয়েছে আদালত। এখন বাড়ি ছাড়া না ছাড়ার বিষয়টি রাজউক ঠিক করবেন। বাড়ি ছাড়তেই হবে এ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম রায়ের পর প্রতিক্রিয়ায় বলেন, বাড়ি অবশ্যই ছাড়তে হবে। বাড়িটা বর্তমানে নিয়ে নেয়া সরকারের দায়িত্ব। এ্যাটর্নি জেনারেল বলেন, মওদুদ আহমদ তার ভাইয়ের নামে বাড়িটির মূল মালিকের সঙ্গে যে চুক্তি দেখিয়েছিল সেটার মামলা আপীল বিভাগে খারিজ হয়ে গিয়েছিল। রায়ে বলা হয়েছিল পাওয়ার অব এ্যাটর্নি এবং চুক্তিটা জাল-জালিয়াতির মধ্যে হয়েছে। সেটাই মওদুদ আহমদ সাহেব বলতে চান তার ভাইয়ের আইনজীবী হিসেবে, মহসিন দরবার নামে এক লোকের সঙ্গে বাড়িটি নিয়ে চুক্তি হয়েছিল, যিনি বাংলাদেশে ছিল। ‘আমরা বলেছি মালিক ইনজে প্লাজ অস্ট্রিয়ান নাগরিক ১৯৮৫ সালের ৩০ মার্চ মারা যান। কথিত মহসিন দরবার ইনজের পক্ষে চুক্তি দেখিয়েছিল, যেটা হয়েছে একই সালের আগস্ট মাসে। তার মানে মালিক মরার ৫ মাস পরে। আর বাড়ি পাওয়ার জন্য ওনারা মামলা করেছিল ১৯৯৩ সালে। বিচারিক আদালত এবং আপীল বিভাগ রাইটলি বলেছেন, তাদের নামে নামজারি হবে না। রিভিউয়ের আদেশের বিষয়ে মাহবুবে আলম বলেন, ‘ওনাদের অনুরোধে আদালত বলছে, বিচারে ভুল হয়নি। তবে বিষয়টি দেখবো। এখন অবৈধভাবে এ জন লোক থাকবে আর সরকার সেটা মেনে নেবে, তা হতে পারে না। এ মামলায় মওদুদ একটি পাওয়ার অব এ্যাটর্নি দেখিয়েছিলেন যেখানে তার ভাই তাকে বাড়িটি দেখাশুনা করতে নিয়োগ দিয়েছেন। সুতরাং যেখানে তার ভাইয়েরও কোন টাইটেল নাই, অধিকার নাই তার মামলা ডিসমিস হয়ে গেছে উচ্চ আদালতে। এ বাড়িতে যে তিনি থাকবেন একজন রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব হিসেবে এ কথা বলা তো আমি মনে করি এর চেয়ে বড় ধৃষ্টতা আর হতে পারে না। বাড়ি ছাড়ার বিষয়ে তিনি বলেন, ‘সেটা আমরা দেখবো। অন্য যে কোন দেশে হলে রাজনীতিবিদ এ প্রশ্ন উঠার সঙ্গে সঙ্গে সম্মান রক্ষার্থে বাড়ি ছেড়ে দিতেন। মূল মালিকের সঙ্গে মওদুদ আহমদের বোঝাপড়ার বিষয়ে মাহবুবে আলম বলেন, মালিক তো বিদেশী। স্বাধীনতার পরে আসেনি কোন সময়েই। এখানে ছিলই না। ওনার এ সমস্ত কথা দুঃখজনক। মূল মালিকের সঙ্গে চুক্তি নিয়ে মামলায় হেরে গিয়ে এ কথা বলাও দুঃখজনক। রিভিউ খারিজের পর বাড়ি ছাড়তে হবে কি না, এই প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, অবশ্যই ছাড়তে হবে। বাড়িটি ছাড়বো না রায়ের পর এক প্রতিক্রিয়ায় ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদ বলেন, এই বাড়িটির সঙ্গে আমার জীবন জড়িত। এই বাড়িতে বিশ্ববরেণ্য অনেক রাজনৈতিক নেতারা এসেছেন। আমার সন্তানেরা এখানে বড় হয়েছে। তাই এ বাড়িটি ছাড়বো না। সকল আইনী প্রক্রিয়া শেষ হওয়ার পরও কেন বাড়িটি ছাড়বেন নাÑ এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, বিরোধী দলে থাকার কারণে সরকার এই বাড়ি ছাড়ার প্রক্রিয়া হাতে নিয়েছে। আদালতে রিভিউ খারিজ হয়েছে কিন্তু বাড়ি ছাড়ার কোন অর্ডার তো আমাকে কেউ দেয়নি। তবে অর্ডার দিলে তখন আমি আইনী প্রক্রিয়া গ্রহণ করব। আইনের তো অনেক দিক আছে। মওদুদ আহমদ বলেন, আমি বিরোধী দলে আছি বলে আজকে এ মামলায় সাত বছর পরে আপীল করেছে সরকার। বাড়ি ছাড়তে হবে এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, এখানে তো সরকারকে স্বত্ব দেয়া হয়নি। অধিকার দেয়া হয়নি। আমরা মূল মালিকের সঙ্গে বোঝাপড়া করব। ওনার ছেলে করিম সুলায়মান আছে। আর আদালতও কিছু পর্যবেক্ষণ দেবেন। উল্লেখ্য, গত বছর ২ আগস্ট মওদুদ আহমদের ভাই মনজুর আহমদের নামে ওই বাড়ির নামজারির নির্দেশ দিয়ে হাইকোর্টের রায়ের বিরুদ্ধে রাজউকের আপীল গ্রহণ করেন আপীল বিভাগ। তার আগে ২০১৬ সালের ৩ আগস্ট বাড়ি নিয়ে ৮০ পৃষ্ঠার আপীলের পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশ করেন আপীল বিভাগ। নিয়ম অনুযায়ী, রায় প্রকাশের ৩০ দিনের মধ্যে এই রায়ের বিরুদ্ধে রিভিউ আবেদন দাখিল করতে হয়। সেই রায়ের বিরুদ্ধে প্রথমে মওদুদ রিভিউ করেন, পরে দুদক একটি রিভিউ করে। ২০১০ সালের ১২ আগস্ট এক আবেদনের শুনানি নিয়ে গুলশানের ওই বাড়িটি মনজুর আহমদের নামে মিউটেশন করার জন্য রায় দেয় হাইকোর্ট। রাজউক এ রায়ের বিরুদ্ধে লিভ টু আপীল দায়ের করে ২০১১ সালের ৩ ফেব্রুয়ারি। ২০১৪ সালের ৯ মার্চ আপীল বিভাগ রাজউককে আপীলের অনুমতি দেন। দুদকের দাবি, বাড়িটির প্রকৃত মালিক ছিলেন পাকিস্তানি নাগরিক মোঃ এহসান। ১৯৬০ সালে তৎকালীন ডিআইটির (রাজউক) কাছ থেকে এক বিঘা ১৩ কাঠার এ বাড়ির মালিকানা পান এহসান। ১৯৬৫ সালে বাড়ির মালিকানার কাগজপত্রে এহসানের পাশাপাশি তার স্ত্রী অস্ট্রিয়ার নাগরিক ইনজে মারিয়া প্লাজের নামও অন্তর্ভুক্ত হয়। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে স্ত্রীসহ ঢাকা ত্যাগ করেন এহসান। তারা আর ফিরে না আসায় ১৯৭২ সালে এটি পরিত্যক্ত সম্পত্তির তালিকাভুক্ত হয়। এরপর ১৯৭৩ সালের ২ আগস্ট মওদুদ তার ইংল্যান্ড প্রবাসী ভাই মনজুরের নামে থাকা একটি আমমোক্তারনামার ভিত্তিতে বাড়িটি সরকারের কাছ থেকে বরাদ্দ নেন। কিন্তু বাড়িটির নামজারি কার্যক্রম নিয়ে জটিলতা ছিল। মনজুর আহমেদ তার অনুকূলে নামজারি করার জন্য হাইকোর্টে একটি রিট আবেদন করেন। বর্তমান সরকারের আমলে ২০১০ সালের ১২ আগস্ট হাইকোর্ট এক মাসের মধ্যে মওদুদ আহমদের ভাইয়ের অনুকূলে নামজারি সম্পন্নের জন্য নির্দেশ দেয়। হাইকোর্টের এই রায়ের বিরুদ্ধে রাজউক আপীল করে। অন্যদিকে আমমোক্তারনামা সঠিক নয় এই অভিযোগে দুদক একটি মামলা দায়ের করে। ২০১৪ সালের ১৪ জুন এ মামলায় অভিযোগ আমলে নেয় বিচারিক আদালত। এর বিরুদ্ধে তাদের আবেদন ২০১৬ সালের ২৩ জুন খারিজ করে দেয় হাইকোর্ট। পরে হাইকোর্টের রায়ের বিরুদ্ধে লিভ টু আপীল করেন মওদুদ আহমদ।
×