ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪৩১

অরুণ কুমার বিশ্বাস

পকেট খরচা ও বাজেট কড়চা

প্রকাশিত: ০৩:৩৯, ৫ জুন ২০১৭

পকেট খরচা ও বাজেট কড়চা

গোড়াতে একটা অঙ্ক শিখে নেই, তাহলে আমজনতার বাজেট বুঝতে সুবিধা হবে। অঙ্কটা অনেকেরই জানা, তবে ব্যাপার কি জানেন তো- অধিকন্তু ন দোষায়! এক মহাপ-িত তার জ্ঞান জাহির করতে ভিনগাঁয়ে যাচ্ছেন। সঙ্গে আছে তার সাগরেদ, চাটুকারও বলতে পারেন। যেতে যেতে পথে পড়ল খাল। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সেই ছোট নদীর কথাও ধরা যায়। বিধিবাম, খালের ওপর নেই কোন সাঁকো। অথচ ভিনগাঁয়ে তাকে যেতেই হবে। প-িত ইতিউতি তাকিয়ে বললেন, যা যা, মালকোচা মেরে এগিয়ে যা। আশপাশে তেমন কেউ নেই যে, লজ্জা পাবি। কিন্তু স্যার নদীর পানিটা একটু মেপে নিলে হতো না! একেবারে নাদানের মতো নদী পারাপার, যদি ডুবে যাই! সন্দিগ্ধ সাগরেদ। অমনি নদীর পানি মাপতে শুরু করেন মহাপ-িত। লম্বা কঞ্চিমতো কিছু দিয়ে তিনি গভীরতা বিষয়ে তিনখানা তথ্য তুলে আনেন, যা অনেকটা এরকম- নদীর এপারে পানির গভীরতা দেড় ফুট, মাঝখানে তিন ফুট, আর ওপারে দেড় ফুট। নে, এবার গড় করে পানির সঠিক গভীরতা মেপে ফেল। সাগরেদকে আদেশ দেন মহাপ-িত। চাটুকার দুবার না ভেবে প-িতের কথামতো গড় গভীরতা বের করলেন দুই ফুট। ফল যা হবার তাই হলো। গড় হিসেবে পানি পেরোতে গিয়ে প-িত ও সাগরেদ দু’জনেই নাকানিচুবানি খেয়ে উঠল। আমাদের দেশের পার ক্যাপিটা ইনকামের হিসাব অনেকটা প-িতের পানির অঙ্কের মতোই। কারও কামাই মাসে দশ টাকা আবার কারও দশ লাখ। গড় করলে দশ টাকার কেরানিও তখন মেলা টাকার মালিক। ঠিক কি না কন! তাতেও কোন আপত্তি ছিল না, যদি আমজনতা নিত্যদিন ভরপেট দুটো খেতে পেত। রাষ্ট্রীয় বাজেট বিশাল ব্যাপার। অতি সাধারণ অন্ত্যজ মানুষের মগজে সেসব কুলোয় না। তামাম দেশ নিয়ে সরকারের কারবার। তার ভাবনার বিস্তার তাই অনেক। সেখানে আমাদের মতো চুনোপুঁটির মাথা গলাবার দরকারটা কী ভাই! কিন্তু আছে। বাস্তবে দরকার কিছু আছে। কারণ আমাদেরও পেট আছে। কিছু খেয়েপরে বাঁচতে হয়। সাধ-আহ্লাদ বলেও তো একটা বস্তু আছে, নাকি! সরকার ঘোষণা দেন নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের দাম এ বছর বাড়বে না। তোমরা নিশ্চিন্ত থাকতে পার। মানে ‘গিফেন গুডস’ বা আরও সোজা করে বললে মানুষের মৌলিক চাহিদা মেটাবার মতো মোটাদাগের জিনিসপত্র সুলভে মিলবে। সেই তালিকায় বেনসন সিগারেট, দামী গাড়ি কিংবা দুই টন এসি নেই। বিদ্যুতের নেই ঠিকঠাক, এসি দিয়ে কী হবে! লোকে মিছে চালের ডিব্বা মনে করে হাসবে যে! জিডিপি নামে এক বস্তু আছে, যার মানে আমরা অনেকেই বুঝি না। ওটা নাকি আবার ওঠানামা করে। বানরের সেই তৈলাক্ত বাঁশে আরোহণের মতো। গ্রস ডমেস্টিক প্রডাক্টের হিসাবে দেশের মান বাড়ল কি কমল, তাতে পানু ময়রার কী এসে যায়! সে শুধু চায় দুধ-চিনির দাম সীমার মধ্যে থাক, সেইসঙ্গে যারা মিষ্টি খায় সেইসব ক্রেতার ক্রয়ক্ষমতা কিছুটা বাড়–ক। ক্রয়ক্ষমতা যে বাড়বে, কিন্তু কিভাবে! কানাঘুষায় শোনা যায় বেতনের উপরেও ট্যাক্স-ভ্যাট বসছে। উপরি হিসেবে আরও চাপছে আবগারি শুল্ক। ব্যাংকে টাকা রাখলেই লস। আবগারি শুল্ক বেড়ে প্রায় দ্বিগুণ হলো। শুনে পানুর মুখ আমসি। কারণ বাপ-পোয়ে মিলে মেলা খেটেখুটে দুটো টাকা জমিয়েছিল। টাকা তো আর ঘরে রাখা যায় না, ছিঁচকে চোরে সিঁদ কাটবে। ব্যাংকে টাকা রাখা তো আরও লস, যাকে বলে লাভের গুড় পিঁপড়ায় খায়। জমানো টাকায় সুদ দূরে থাক, আসল নিয়ে টানাটানি এখন। এ কোন্ দুর্দৈব এলো রে ভাই! পানু ময়রা বিষম ভাবনায় পড়ে গেল। মাঝখান থেকে সুবিধা হলো চোর-বাটপাড়ের। কারণ ব্যাংকে টাকা রাখলে যখন আসল নিয়ে টানাটানি, তুলে এনে ঘরে রাখলে খাবে চোরে। তার মানে এই বাজেট চোরের জন্য খুব মঙ্গলজনক নয় কি! পানু আগে অভ্যাসবশত গুল আর খয়ের খেত। এখন আর খায় না। ক্যান্সারের ঝুঁকি তো আছেই, তাছাড়া সরকার নাকি তামাকের ওপর বাড়তি ট্যাক্স বসাচ্ছে। ভাল, খুব ভাল কথা। অস্বাস্থ্যকর জিনিস না থাকাই উত্তম। পরে আবার কী ভেবে ফিক্ করে হেসে ফেলে পানু। এতই যখন ধুচ্ছাই করে, তামাকের চাষ সরকার বন্ধ করে দিলেই পারে! তাহলে তো আর তামাকজনিত রোগ সারাতে দেশের মানুষের গুচ্ছের টাকা খরচ করতে হয় না। শোনা যায় এবার নাকি উচ্চাভিলাষী বাজেট হচ্ছে। চার লাখ কোটি টাকারও বেশি। মেলা টাকার কারবার। দেশে উন্নয়ন হচ্ছে, টাকা তো লাগবেই। কিন্তু তাতে পানু ময়রার কী! বা ধরুন গে দীনু কুমোরের! দীনু বসে বসে মাটির তৈজসপত্র তৈরি করে। এসব বিগ-বাজেট তাকে খুব একটা স্পর্শ করে না। তবে একটা বিষয় খুব ভাবাচ্ছে তাকে! ছেলেটা তার স্কুলে যায়। খালি পায়ে এখন আর স্কুলে যাওয়া যায় না। তার চপ্পল দরকার। দীনু শুনতে পায় সাধারণ মানের চপ্পলের উপরেও নাকি ট্যাক্স বসছে, মানে দাম বাড়বে। টিফিন হিসেবে ছেলেটা একটু কেক কিনে খায়। মেশিনে বানানো কেক, তাই তাতেও বাড়তি কর গুনতে হবে। কোন মানে হয়! দীনু অবশ্য নিশ্চিত নয়, এসব কেক মেশিনে নাকি পায়ে দলে বানায়! দু’রকম বাজেটের কথা শোনা যায়- ঘাটতি বাজেট আর উপরি মানে সারপ্লাস বাজেট। উপরির আবার রকমফের হয়। পেশা বুঝে উপরি। কারও কারও কাছে উপরি কামাই বেশ উপাদেয়। উপরি না জুটলে কাজেকামে ঠিক মন বসে না। নিজেকে কেমন এতিম এতিম মনে হয়। আফটার অল, পকেট খরচ বলে তো একটা কথা আছে! আমাদের ব্রাত্যজন দীনু কুমোর বা পানু ময়রার কিন্তু পকেট খরচের হ্যাপা নেই। তাদের শুধু এক থাল ভাত আর একটু সালুন পেলেই চলে যায়, আহারের পর বাহারি ডেজার্ট চাই না। আমাদের সরকার বাজেটে তাদের জন্য কী রেখেছে একটু ভাবুন! রমজান সংযমের মাস। অথচ এবার রোজা আর অর্থবাজেট সহোদর হয়ে আসায় দীনুদের শিরে সংক্রান্তি। তৈরি ছিল নাচুনে বুড়ি, বাজেট এসে দিল ঢোলের বাড়ি। ব্যস, অমনি নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যাদির দাম ধেই ধেই করে নাচতে শুরু করে দিল। বেগুন-পেঁপের কথা না হয় ছেড়ে দিলুম; কিন্তু চাল-তেল না হলে যে চলে না! পানুর পো রোজা রেখে যুত মতো ইফতার করবে তার জো আছে! ছোলা থেকে শুরু করে কীসের দাম আকাশ ছোঁয়নি! তারপর আবার মুনাফাখোর মধ্যস্বত্বভোগীরা বাজেটের ধুয়ো তুলে জিনিসের দাম আরও এককাঠি চড়িয়ে দিচ্ছে। একেই বলে গোদের উপর বিষফোঁড়া। গরিবরা সব কপালপোড়া! চ্যানেল আইয়ের সৌজন্যে ফিবছর কৃষকের বাজেট বলে একটি অনুষ্ঠান দেখি। একেবারে খেটেখাওয়া প্রান্তিক মানুষ ওরা। দেশ নিয়ে ওদের ভাবনা চাষের জমি আর সার অবধি। এডিপি-জিডিপি নিয়ে তাদের কোন ধারণা বা কৌতূহল নেই। অথচ কৃষকরা দেশের প্রকৃত মালিক। যাদের অনুপস্থিতিতে এই জমিন তার উর্বরতা হারায়। মাটি হয়ে পড়ে বন্ধ্যা। আমাদের প্রশ্ন, এই প্রান্তিক চাষীদের নিয়ে রাষ্ট্রীয় ভাবনা কতটা অভিনব! তাদের জন্য কোন সুখবর! আমরা তাদের নিয়ে আদৌ কি ভাবছি! কৃষক ভাল না থাকলে দেশ ভাল থাকবে না। আমাদের মৌলিক উৎপাদনশীলতা হ্রাস পাবে, আর তার নেতিবাচক প্রভাব পড়বে দেশের সামগ্রিক জিডিপির প্রবৃদ্ধিতে। এখন বাজেট মৌসুম চলছে। বাজেট নিয়ে টিভির পর্দায় বেশুমার কড়চা শোনা যায়। যুক্তি-অঙ্ক-ক্ষুরধার বুদ্ধি দিয়ে বাজেটের ভালমন্দ তুলে ধরা হচ্ছে। অত শত বুঝি না, আমাদের পরিষ্কার বক্তব্য, বাজেট যেন জনঘনিষ্ঠ হয়, বাজেট যেন জনতার কথা বলে! দেশের উন্নতি আমরা সকলেই চাই, তবে তা আমজনতাকে দূরে ঠেলে দিয়ে নয়। নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের দাম গণমানুষের হাতের নাগালে রেখেই আমাদের উন্নয়ন পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করা দরকার। নইলে সমস্ত উন্নয়ন-উত্তরণ অর্থহীন হয়ে পড়বে। লেখক : কথাসাহিত্যিক
×