ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

মিল্টন বিশ্বাস

পাহাড়ী-বাঙালী দ্বন্দ্বের শেষ কোথায়?

প্রকাশিত: ০৩:৩৫, ৫ জুন ২০১৭

পাহাড়ী-বাঙালী দ্বন্দ্বের শেষ কোথায়?

চট্টগ্রামের একটি বেসরকারী বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র আদর তঞ্চঙ্গ্যা ফেসবুকে লিখেছেন, ‘পুড়ে জ্বলছে রাঙ্গামাটির লংগদু উপজেলা! অনিশ্চিত ভবিষ্যত...অনিশ্চিত আমাদের জীবন! প্লিজ, চোখ খুলুন, এগিয়ে আসুন...।’ আদর আরও লিখেছেন, ‘আজ যেসব ফল আমরা ভোগ করছি, স্বীকার করতে হবে সব নেতাদের ব্যর্থতার দায়। তাদের দুর্বল মানসিকতা, মাথা নত করা, দূরদর্শী চিন্তার অভাব, নেই একাগ্রতা, প্রতি পদক্ষেপে ব্যর্থতা, এসব কারণেই আজ আমরা বিলীন হয়ে যাওয়ার সম্মুখীন। মোট কথা, গাছটাকে যেভাবে রোপণ করেছি, বড় করেছি ফলও ঠিক সেভাবে পাচ্ছি। যে যাই বলুক, ২ ডিসেম্বর (১৯৯৭) ওটা কখনও আমাদের অস্তিত্বের চুক্তি ছিল না। কারণ চুক্তির ফল কখনও এমন হতে পারে না। আজ আমরা নিজ দেশে পরবাসী! তাহলে চুক্তির অর্থ কি?!’ ২ জুন (২০১৭) রাঙ্গামাটির লংগদুতে স্থানীয় এক যুবলীগ নেতা নিহতের প্রতিবাদে বিক্ষোভ মিছিল থেকে পাহাড়ীদের বাড়িঘরে আগুন দেয়ার ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে আদর তার প্রতিক্রিয়া জানিয়েছেন এভাবে। ওই মিছিল থেকে পাহাড়ীদের আড়াইশ’র বেশি বসতঘর ও দোকানপাট পুড়িয়ে দেয়া হয়েছে। বাড়িঘরে আগুন দেয়ার পর স্থানীয় পাহাড়ীরা আতঙ্কে এলাকা ছেড়ে অন্যত্র চলে গেছেনÑ এ দৃশ্যও আমরা ফেসবুক সূত্রে তাৎক্ষণিক পেয়েছি। তবে আদর তঞ্চঙ্গ্যার ক্ষোভ শান্তি চুক্তির ফল নিয়ে হলেও সেই চুক্তির নেতৃত্বে থাকা শেখ হাসিনার সদিচ্ছা যে এখনও তাৎপর্যবহ সেটা স্বীকার করতে হবে নির্দ্বিধায়। কারণ তাঁর শান্তি প্রচেষ্টায় পার্বত্য এলাকার সমস্যা সমাধানে গুরুত্বপূর্ণ অগ্রগতি সম্পন্ন হয়েছে। কারণ, তিনি অনেক আগে থেকেই বঙ্গবন্ধুর দেখানো পথে ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর মঙ্গল চিন্তায় নিবেদিতপ্রাণ। বঙ্গবন্ধুর রাজনীতি ছিল সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি, সহাবস্থানের রাজনীতি। শেখ হাসিনার রাজনীতি সুবুদ্ধি দিয়ে টিকে থাকার রাজনীতি। হিংসা, বিদ্বেষের রাজনীতি, ধর্মের রাজনীতি চালু করে গেছেন মরহুম জিয়াউর রহমান, তা চালু রেখেছে জামায়াত ইসলাম। বিএনপি, জামায়াতের হিংসাত্মক, সাম্প্রদায়িক রাজনীতির পথ থেকে বের হয়ে আসার সময় অনেক আগেই তৈরি করে দিয়েছেন শেখ হাসিনা। ॥ দুই ॥ যুবলীগ নেতার হত্যাকা- নিঃসন্দেহে দুঃখজনক ঘটনা। কিন্তু সেই ঘটনার জন্য সকল পাহাড়ীকে দগ্ধ করার কোন অধিকার বাঙালীদের নেই। তিনটিলা এলাকার বাসিন্দা ও উপজেলা জনসংহতি সমিতির সাধারণ সম্পাদক মনিশংকর চাকমা বলেছেন, ‘আমাদের পাড়ার একটি ঘরও অবশিষ্ট নেই। দুই শতাধিক বাড়িঘর সম্পূর্ণ পুড়ে গেছে।’ তিনি আরও বলেছেন, ‘এই হত্যার ঘটনার সঙ্গে তো আমাদের কোন সম্পৃক্ততা নেই, আমরা তো কিছুই জানি না। তবুও কেন আমাদের বাড়িঘর আগুনে পোড়ানো হলো, জানি না।’ রাজনৈতিক সহিংসতার কথা মাথায় রেখেও বলা চলে সহজ-সরল ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর জন্য বাঙালীদের বিবেচনা বোধকে আরও তীক্ষè করতে হবে। বুঝতে হবে সেখানকার কৃষিনির্ভর মানুষগুলো নিজ দেশে যেন পরবাসীর মতো বসবাস না করে। তারা যেন বাঙালীদের বিশ^াস করে। এজন্য দরকার শান্তি চুক্তির পূর্ণাঙ্গ বাস্তবায়ন; আর শেখ হাসিনার চিন্তাধারায় আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের উজ্জীবিত হওয়া। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ‘পার্বত্য চট্টগ্রাম : শান্তির অন্বেষায়’ প্রবন্ধে ১৯৯৮ সালে লিখেছেন, ‘পাহাড়ে বসবাসকারী কি পাহাড়ী, কি বাঙালী সকলেই দারিদ্র্যের কশাঘাতে জর্জরিত। শান্তি স্থায়ী করতে হলে অর্থনৈতিক কর্মকা- বৃদ্ধি করতে হবে।... শিক্ষা, স্বাস্থ্য, কর্মে উন্নত সমাজ গড়তে পারলেই স্থায়ী শান্তি স্থাপন হবে। মানুষের সহজাত প্রবৃত্তিই হচ্ছে শান্তির পক্ষে। সকলেই শান্তি চায়।’ (শেখ হাসিনা রচনাসমগ্র ১, পৃ ২৩৯) শান্তির এই প্রত্যয়কে রাজনৈতিক প্রজ্ঞায় ধারণ করে শেখ হাসিনার উদ্যোগে ১৯৯৭ সালের ২ ডিসেম্বর পার্বত্য শান্তি চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। পার্বত্য সমস্যার সৃষ্টি করা হয়েছিল ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টের পর। সেসময় উদ্দেশ্যমূলকভাবে সামরিক জান্তা জিয়াউর রহমান ওই এলাকায় স্থায়ী বসবাসের জন্য অন্য স্থান থেকে মানুষ স্থানান্তর করেন। সেই অনাকাক্সিক্ষত ঘটনা ছিল অগ্রহণযোগ্য। তৎকালীন সরকারী প্রশাসন সমতল জেলার বিভিন্ন অঞ্চলের নদীভাঙ্গা, ভূমিহীন, দিনমজুর, অসহায়, দুস্থ পরিবারকে এনে সরকারী খাস ভূমিতে পুনর্বাসন করে। এই পুনর্বাসনের কয়েক বছর যেতে না যেতেই শান্তিবাহিনী নামক উপজাতীয় গেরিলারা সরকারের ওপর প্রতিশোধ নিতে পুনর্বাসিত বাঙালীদের ওপর হামলা চালায়। সুরক্ষিত ওই অঞ্চলে ভারতের জঙ্গীরা সহায়তা করত শান্তিবাহিনীদের। সেখানে বাংলাদেশ সরকারের জড়িত হওয়াটা ছিল ব্যয়বহুল। কিন্তু তাদের সঙ্গে আমাদের সেনাবাহিনীকে যুদ্ধ করতে হয়েছে দৃঢ়চিত্তে। ৬ তরুণ অফিসার, ১ মেজর, ৩ ক্যাপ্টেন ও ২ লেফটেন্যান্টসহ ৩১২ সৈনিক পার্বত্য চট্টগ্রামে শান্তিবাহিনীর সঙ্গে যুদ্ধে শহীদ হয়েছেন। একইসঙ্গে অজস্র পাহাড়ী জনতা নৃশংসতার শিকার হন, মৃত্যুবরণ করেন। অবশ্য তাতে সেখানকার উন্নয়নের গতিধারা ব্যাহত হয়নি। বর্তমান সরকারের আমলে পার্বত্য চট্টগ্রামের কয়েক হাজার কিলোমিটার রাস্তার অর্ধেকের বেশি বাংলাদেশ সেনাবাহিনী কর্তৃক নির্মিত। নৈসর্গিক সৌন্দর্য উপভোগ করার জন্য দেশী-বিদেশী হাজার হাজার পর্যটক বান্দরবানের নীলগিরিসহ পার্বত্য চট্টগ্রামের যেসব স্পটে ছুটে যান তার পুরো অবদানটাই সেনাবাহিনীর। নিরাপত্তা ব্যবস্থা গ্রহণ ও রাস্তা নির্মাণ না করা হলে রাতযাপন করে নৈসর্গিক সৌন্দর্য উপভোগ করা দূরের কথা, সেখানে কেউ যাওয়ার কল্পনাও করতেন না। বর্তমানে অপহরণ একেবারেই শূন্যের কোঠায় নেমে এসেছে। ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হলে ভারতের সঙ্গে পুনরায় সুসম্পর্ক গড়ে ওঠে। আর ১৯৯৭ সালের ২ ডিসেম্বর ঐতিহাসিক পার্বত্য শান্তি চুক্তির মাধ্যমে চট্টগ্রামের দ্বন্দ্ব-সংঘাতের সমাপ্তি ঘটে। কিন্তু কিছু অস্ত্র ব্যবসায়ী ও ধর্মীয় মৌলবাদীর কারণে সেই সংঘাত এখনও জিইয়ে রাখা হয়েছে। ॥ তিন ॥ শেখ হাসিনার সরকার পার্বত্য চট্টগ্রামের অধিবাসীদের আশা-আকাক্সক্ষা ও প্রত্যাশা পূরণে সর্বদা সচেষ্ট। সেই অঞ্চলকে কেন্দ্র করে বর্তমান সরকারের কোন অগণতান্ত্রিক ও জনবিরোধী উদ্যোগ নেই। গত মহাজোট সরকার ক্ষমতায় আসার পর পার্বত্য চট্টগ্রাম উন্নয়ন বোর্ডের চেয়ারম্যান নিয়োগ পেয়েছেন। ভূমি কমিশন গঠন ও ‘ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠান বিল ২০১০’ জাতীয় সংসদে গৃহীত হয়েছে। ইতোমধ্যে দেশের অখ-তা রক্ষার জন্য উপজাতি, ক্ষুদ্র জাতিসত্তা, নৃগোষ্ঠী ও সম্প্রদায়ের ধারণা সবাই মেনে নিয়েছে। মূলত পাহাড়ী-বাঙালী দ্বন্দ্ব নিরসনে এবং পার্বত্য শান্তিচুক্তি বাস্তবায়নের জন্য সবার ঐকান্তিক প্রচেষ্টাই গুরুত্বপূর্ণ। বৈচিত্র্যময় সৌন্দর্যের লীলাভূমি পার্বত্য অঞ্চল বাংলাদেশের সব নাগরিকের কাছে প্রিয় এলাকা। পাহাড়ী উপজাতিরা যদি সমতলের বাঙালীদের সন্দেহের চোখে দেখে এবং অনুপ্রবেশকারী মনে করে, অন্যদিকে বাঙালীরা পাহাড়ীদের হেয় প্রতিপন্ন করতে তৎপর হয় তাহলে তা হবে দেশের শান্তি প্রচেষ্টার জন্য আত্মঘাতী। এ জন্য কেবল শেখ হাসিনার নেতৃত্ব ও তাঁর শান্তি প্রচেষ্টায় আস্থা রাখা পার্বত্য এলাকার উভয়পক্ষের জন্য কল্যাণকর। লেখক : অধ্যাপক, বাংলা বিভাগ এবং পরিচালক, জনসংযোগ, তথ্য ও প্রকাশনা দফতর জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়
×