ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

রেশম পথ, ওয়ান বেল্ট ওয়ান রোড এবং প্রাসঙ্গিক কথা

প্রকাশিত: ০৩:৩৫, ৫ জুন ২০১৭

রেশম পথ, ওয়ান বেল্ট ওয়ান রোড এবং প্রাসঙ্গিক কথা

রেশম পথ। ওয়ান বেল্ট ওয়ান রোড বা ওবর। সাম্প্রতিককালে অর্থনৈতিক-দুনিয়া তোলপাড় হয়েছে যে কয়েকটা হাতেগোনা ইস্যু নিয়ে, তার মধ্যে ওবর ধারে ও ভারে যে অগ্রগণ্য তা বলার অপেক্ষা রাখে না। চীনের এই তিন মহাদেশ জোড়া মহাপ্রকল্প নিয়ে বেজিং যতই উৎসাহিত হোক, বিশেষজ্ঞদের মতে, এটি আসলে জ্বালানি আমদানির পথকে সুরক্ষিত করে অর্থনৈতিকভাবে চীনকে বিশ্বশক্তির পর্যায়ে বসানো জন্য এক দুনিয়াজোড়া কৌশল মাত্র। সম্প্রতি ঢাক ঢোল পিটিয়ে বেজিংয়ে রাষ্ট্রপ্রধানদের দু’দিনব্যাপী সম্মেলন করে চীন এই প্রকল্প দুনিয়ার সামনে এনেছে। ওবর-র অংশ হিসেবে ভারতের সার্বভৌমত্বে¡র তোয়াক্কা না করে যেভাবে পাক অধিকৃত কাশ্মীর দিয়ে চীন পাকিস্তান অর্থনৈতিক করিডর করার তোড়জোড় করা হচ্ছে, তাতে দিল্লী স্বাভাবিকভাবেই আপত্তি জানিয়েছে। রাষ্ট্রসঙ্ঘ ও এই করিডর নিয়ে যথেষ্ট উদ্বিগ্ন। ইউরোপের বহু দেশ এই প্রকল্পের অর্থনৈতিক ও পরিবেশগত দিকের আরও স্বচ্ছতা দাবি করেছে। তাই ওবর নিয়ে আলোচনা করতে গেলে জ্বালানির ব্যাপারটা মাথায় রাখা জরুরী। কারণ এই চীনা প্রকল্পের প্রতিটা অংশের সঙ্গেই প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে কয়লা, তেল বা গ্যাসের সরবরাহের বিষয়টা জড়িয়ে আছে। যেভাবে পারস্য উপসাগর থেকে উত্তর ভারত মহাসাগরের জলপথ তেল, গ্যাস আর কয়লা চীনে নিয়ে যাওয়ার সরবরাহ লাইন ওবর-র আরেক অংশ নৌ রেশম পথের মাধ্যমে সুরক্ষিত করতে উদ্যত হয়েছে বেজিং, তাতে দিল্লীর উদ্বেগ বেড়েছে বৈ কমেনি। তবে তার আগে ইতিহাসের পাতা উল্টে দেখে নেয়া যাক কি এই রেশম, কেনইবা এর এত গুরুত্ব। কারণ খ্রিস্টের জন্মের প্রায় ৪ হাজার বছর আগেই রেশম তৈরির বিদ্যার আয়ত্তকরণ থেকে শুরু করে একে কেন্দ্র করে দেড় হাজার বছর ধরে চলা পূর্ব এশিয়া, উত্তর আফ্রিকা আর দক্ষিণ ইউরোপের রোম পর্যন্ত বিশ্ববাণিজ্যের এক অভূতপূর্ব যোগাযোগ ব্যবস্থাই শুধু নয়, রেশমকে নিয়ে আর্থ-সামাজিক টানাপোড়েন, রেশমের রাজনৈতিক ও আর্থিক ক্ষমতার প্রতীক হয়ে ওঠা, যার বিনিময় অর্থনীতিরও অন্যতম বড় মাধ্যম হয়ে ওঠা। আর রেশম পথ? কি নেই তাতে? তার দেড় হাজার বছরের ইতিহাসের পরতে পরতে জড়িয়ে আছে হাজার হাজার মাইল মরুগিরি প্রান্তর পেরোনো শ’য়ে শ’য়ে উটের গলায় বাঁধা একটানা ঘণ্টা ধ্বনি, সেই একটানা সুরের তাল কেটে অশ্বের হ্বেষা, তরবারির ঝলকানি, যুদ্ধের রক্ত নদী, বাণিজ্যকে ঢাল করে সাম্রাজ্য বিস্তারের চেষ্টা বা হাজার হাজার মাইল পেরিয়ে পূর্ব এশিয়ার চীন থেকে বেতের লাঠির মধ্যে রেশম পোকার লার্ভা চুরি করে পশ্চিম এশিয়ার তুরস্কে নিয়ে আসা। তাই শুরুর দামামা বাজার সঙ্গে সঙ্গেই দুনিয়াজুড়ে যে রকম আলোড়ন উঠেছে অধুনা রেশম পথ নিয়ে, তা রাজনৈতিক ও আর্থিক গুরুত্বে তার প্রাচীন ভ্রাতাকে টেক্কা দিতে পারবে কিনা, বিপুল বৈদেশিক ঋণের বোঝা নিয়ে শেষমেশ এখনও বিপুলভাবে ভর্তুকি অর্থনীতির বোঝা বওয়া চীন মুখ থুবড়ে পড়বে কিনা (বিশেষত সম্প্রতি বিশ্ব অর্থ বাজারে চীনের ক্রেডিট রেটিং বা ঋণ শোধ দেয়ার ক্ষমতা কমার প্রেক্ষিতে), এসব হাজারো প্রশ্ন মাথাচাড়া দিয়েছে। তাই ইতিহাসের পথ ধরে কয়েক হাজার বছর পিছানো দরকার, প্রয়োজন প্রাচীন রেশম পথ দিয়ে হাঁটা। বিশেষজ্ঞদের মতে, এখানকার মতো তখনও আর্থিক আর দীর্ঘমেয়াদী রাজনৈতিক লক্ষ্যকে মাথায় রেখে চীন এগিয়েছিল। প্রাচীন রেশম পথ ৩৩৪ খ্রিস্ট পূর্বের এক দুপুরে আলেকজান্ডারের বর্শা যখন সদম্ভে এসে অধুনা তুরস্কের পশ্চিম উপকূলের বেলাভূমিতে গথল (যা এশিয়া মাইনর নামেও পরিচিত), লক্ষাধিক সেনার সগর্জনের মধ্যে গ্রিসের ম্যাসেডোনিয়া রাজ রণতরী থেকে নেমে সমুদ্র সৈকতে যখন ঘোষণা করলেন তার এশিয়া বিজয়ের বাসনা, ইউরোপ ও এশিয়ার মধ্যে ভৌগোলিক দূরত্বের অবসান কার্যত ঘটল সেই সময় থেকেই। ইতিহাস বলে, একইসঙ্গে ইউরোপের সঙ্গে চীনের যোগাযোগের বীজও রোপণ করা হয় আলেকজান্ডারের এই সাম্রাজ্য বিস্তারের মাধ্যমেই। এশিয়া মাইনরে অবতরণের পাঁচ বছরের পারস্য সাম্রাজ্য গ্রীক বাহিনীর পদানত হয় কিন্তু এই রক্তক্ষয়ী যুদ্ধে আলেকজান্ডারের সেনাবাহিনীর অনেক সদস্যই গুরুতর আহত হন। এদের পক্ষে আর বাহিনীর সঙ্গে যাওয়া সম্ভব হবে না বুঝে মধ্য এশিয়ার অধুনা তাজিকিস্থানের ফারজানা উপত্যকায় সদ্য স্থাপিত শিরদারিয়া নদীর ধারে আলেকজান্দ্রিয়া এসছাতে (ভূমধ্যসাগর তীরে মিসরের বন্দরনগরী আলেকজান্দ্রিয়া পত্তনের দু’বছরের মধ্যেই মধ্যএশিয়ায় এই শহর গড়ে ওঠে। সবমিলিয়ে আলেকজান্ডার তার নামাঙ্কিত ১২টি শহর গড়ে তোলেন।) শহরে এদের রেখে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। মধ্যএশিয়ার অধুনা আফগানিস্তান, তাজিকিস্তান আর উজবেকিস্তান সেসময় ব্যাকট্রিয়া নামে পরিচিত ছিল। পারস্য বিজয়ের ফলে ব্যাকট্রিয়া গ্রীক শাসনাধীনে আসে। আলেকজান্ডারের মৃত্যুর কয়েক বছর পর থেকে স্থানীয় জনগণের সঙ্গে উপনিবেশকারী গ্রীকদের মেলামেশা বাড়তে থাকে। ধীরে ধীরে মধ্যএশিয়ার এই বিস্তীর্ণ অঞ্চলজুড়ে গ্রীক-ব্যাকট্রিরীয় সংস্কৃতি তার ছাপ ফেলতে শুরু“ করে। গ্রিক-ব্যাকট্রিয় রাজারা রাজ্যের সীমা সেরেস অবধি নিয়ে যান। তৎকালীন গ্রীক ভাষায় সেরেস শব্দের অর্থ হলো যেখান থেকে রেশম আসে অর্থাৎ চীন। অন্যভাবে দেখলে বোঝা যাচ্ছে আনুমানিক ২০০ খ্রিস্ট পূর্বাব্দ থেকে চীনের সঙ্গে ব্যাকট্রিয়ার এক স্থল বাণিজ্যের সম্পর্ক ছিল। (চীনা রেশমের খ্যাতি অবশ্য তারও বহু আগে পশ্চিমে পৌঁছিয়ে গেছে। খ্রিস্ট জন্মের হাজার বছর আগেই মিসরে চীনা রেশম বস্ত্রের যথেষ্ট কদর ছিল।) কিন্তু সেই বাণিজ্যপথ স্থায়ী রূপ পেল আরও বছর সত্তর পরে। চীনে তখন হান রাজবংশ সিংহাসনে। কিন্তু উত্তরদিক থেকে জিয়ংনু আদিবাসীদের আক্রমণে চীনাদের তখন ত্রাহি অবস্থা। কিছুতেই এই বর্গী হানা সামলাতে না পেরে ১৩৮ খ্রিস্ট পূর্বাব্দে হান সম্রাট য়ু তার দূত জান কিয়ানকে মধ্য এশিয়ায় পাঠালেন যদি কোনও বৈদেশিক সাহায্য মেলে। কিয়ানও ঘুরতে ঘুরতে আলেকজান্দ্রিয়া এসছাতে শহরে (এই শহরকে চীনারা তখন দায়ুয়ান নামে চিনত) হাজির। সেখানে ব্যাকট্রিয়দের তেজীয়ান ঘোড়া দেখে তো চীনা রাষ্ট্রদূতের বেজায় পছন্দ হয়ে গেল। জিয়ংনু হানা রুখতে হলে তো এরকম তেজীয়ান ঘোড়াই দরকার চীনা অশ্বারোহী বাহিনীর। দূতের প্রস্তাব চীনা সম্রাট মেনেও নিলেন। ব্যাকট্রিয় অশ্বই হাতিয়ার হয়ে উঠল চীনা বাহিনীর কাছে হানাদারদের তাড়াতে। সফল সামরিক অভিযানের পর চীনা সম্রাট পশ্চিমের সঙ্গে বাণিজ্যিক সম্পর্কও করতে চাইলেন। ১৩০ খ্রিস্ট পূর্বাব্দে রেশম পথ খুলে গেল। পরের বছরই চীনা বাণিজ্য কুঠি খুলে গেল আলেকজান্দ্রিয়া এসছাতে। শুরু হয়ে গেল এশিয়া-উত্তর আফ্রিকা-ইউরোপজুড়ে পূর্ব চীনের গুয়াঙঝাউ থেকে মধ্যএশিয়ার কাশগড়, বুখারা, সমরখন্দ হয়ে, ভূমধ্যসাগর পেরিয়ে রোম অবধি রেশম পথ ধরে বিশ্ব বাণিজ্য। একদিনে এই দীর্ঘ বাণিজ্যপথ অবশ্য হয়নি। কয়েক শতাব্দী লেগেছে এই তিন মহাদেশজোড়া বাণিজ্যপথ হতে। কিন্তু প্রারম্ভটা হয়েছিল আলেকজান্ডারের নামাঙ্কিত শহরের হাত ধরেই। ফলে সামরিক অভিযানের দুই শতাব্দী পরেও রেশম পথের সঙ্গে আলেকজান্ডারের নামটা রয়ে গেল। ইতিহাস বলে, মূলত চীনা রেশমের রমরমা থাকলেও কাগজ আর বারুদের প্রভাবও কিছু কম ছিল না এ রেশম পথে। দুটোই চীনাদের আবিষ্কার। হান বংশের রাজত্বকালে কাগজ আবিষ্কৃত হয়। ফলে রেশম পথের ইতিহাস পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে লিপিবদ্ধ হয় তেমনি রেশম পথ সুরক্ষিত করতে বারুদের ব্যবহার হয়। মধ্যএশিয়ায় এই রেশম পথের ধারে এখনও বহু চীনা বাণিজ্য কুঠির ভগ্নাবশেষ দেখা যায়। যেমন চীনের পশ্চিম সীমান্তে জেড গেট গিরিপথ, জিয়ায়ুগুয়ান গিরিপথ বা দুনইয়াঙয়ে সেনা ছাউনি। এই বাণিজ্য কুঠিগুলোর গড়ন দেখে পরিষ্কার বোঝাও যায় রীতিমতো সামরিকভাবেও এগুলো রক্ষা করার ব্যবস্থা ছিল। শুধু তাই নয়, মধ্যএশিয়ায় চীনা সাম্রাজ্য বিস্তারেও এই রেশম পথ বড় ভূমিকা নেয়। ৪৭৬ খ্রিব্দাদে রোম সাম্রাজ্যের পতনের পর কনস্তানতিনোপলকে (অধুনা তুর্কি শহর ইস্তানবুল) রাজধানী করে পরবর্তী হাজার বছর বাইজানতাইন সাম্রাজ্য পূর্ব ইউরোপ এবং পশ্চিম ও মধ্যএশিয়ায় রাজত্ব করে। ফলে স্বাভাবিকভাবেই পশ্চিম এশিয়া থেকে ইউরোপ পর্যন্ত রেশম পথের কর্তৃত্ব চলে যায় কনস্তানতিনোপলের হাতে। এরপরই চীনাদের সঙ্গে রেশমের অত্যধিক দাম নিয়ে বাইজানতাইন সাম্রাজ্যের অসন্তোষ বাড়তে থাকে। এরইমধ্যে ভারতে খিস্ট্র ধর্ম প্রচারক দুই যাজক ৫৫১ সালে চীনে গিয়ে দেখেন কিভাবে রেশম পোকা চাষ করে তার থেকে রেশম বের করা হচ্ছে। এটা কোনও সাধারণ জ্ঞান নয় তৎকালীন বিশ্বে। খ্রিস্টের জন্মের চার হাজার আগে চীনারা রেশম পোকা থেকে রেশম তৈরির বিদ্যা আয়ত্ত করলেও তা এতটাই গোপন ছিল যে বহির্বিশ্বের কাছে তা ছিল অজানা। রোমানরা ভাবত রেশম বোধহয় কোনও ফল। বাইজানতাইনদের ধারণা ছিল রেশম হয় আসলে ভারতে। তাই পরের বছর যাজকদ্বয় যখন তাদের গোপন কথা বাইজানতাইন সম্রাট প্রথম জাস্টিনিয়ানকে বললেন, তখন কনস্তানতিনোপল মেঘ না চাইতেই যেন জল পেয়ে গেল। সম্রাট সঙ্গে সঙ্গে দুই যাজককে আবার চীনে যেতে বললেন, আদেশ হলো যেন তেন প্রকারেন রেশম কীট যোগাড় করে কনস্তানতিনোপলে নিয়ে আসার। জাস্টিনিয়ানের আদেশ শিরোধার্য করে ইতিহাসের সেই অজানা দুই ধর্মযাজক তাঁদের বেতের লাঠির মধ্যে রেশম পোকার ডিম নিয়ে চলে আসেন। অনতিবিলম্বে কনস্তানতিনোপল, বেইরুট, টায়ার প্রভৃতি জায়গায় রেশম চাষ শুরু হয়ে গেল। অচিরেই ইউরোপের বাজারে বাইজানতানীয় রেশমে ছেয়ে গেল। রেশম নিয়ে পিকিংয়ের (চীনের প্রাচীন রাজধানী) মৌরসীপাট্টার অবসান হলো। রেশম পথ অবশ্য এর পরেও আরও কয়েক শ’ বছর টিকেছিল। ১৪৫৩ সালে কনস্তানতিনোপল পতনের পর নয়া অটোমান সুলতান এই পথ বন্ধ করে দেন। বিশ্ব ইতিহাসের এক অধ্যায়ের অবসান ঘটে। বিশ্ববাণিজ্য তখন জলপথে করা শুরু হয় এশিয়ার সঙ্গে। হল্যান্ড, ডেনমার্ক, স্পেন, পর্তুগাল, ফ্রান্স ও ইংল্যান্ডের ইউরোপীয় নৌশক্তিধর দেশগুলোর সমদ্রপথ সমৃদ্ধির আরেক রাস্তা দেখায়। লেখক : ভারতীয় সিনিয়র সাংবাদিক
×