ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ২৩ এপ্রিল ২০২৪, ১০ বৈশাখ ১৪৩১

পারস্পরিক সহাবস্থান কাম্য

প্রকাশিত: ০৩:৩৩, ৫ জুন ২০১৭

পারস্পরিক সহাবস্থান কাম্য

রাঙ্গামাটির লংগদুতে স্থানীয় যুবলীগ নেতা ও মোটরবাইক চালক নুরুল ইসলাম নয়ন হত্যাকা-কে কেন্দ্র করে ওই এলাকায় রীতিমতো অশান্তি ও উত্তেজনাকর পরিস্থিতি বিরাজ করছে। লংগদু সদর, মানিকজোড় ছড়া, কাঁঠালতলী ও তিনটিলা গ্রামে চাকমা নৃ-গোষ্ঠীর শতাধিক ঘরবাড়িতে অগ্নিসংযোগ করা হয়েছে। আগুন দেয়া হয়েছে স্থানীয় জনসংহতি সমিতির অফিসে। পাহাড়ীদের পক্ষ থেকে অভিযোগ উঠেছে, হত্যার ঘটনায় বিক্ষুব্ধ লোকজন এই কাজ করেছে। অন্যদিকে কয়েকজন বাঙালীর ঘরবাড়ি পুড়িয়ে দেয়ার খবরও আছে। পরিস্থিতি শান্ত ও স্বাভাবিক রাখতে উপজেলা প্রশাসন ওই এলাকায় জারি করেছে ১৪৪ ধারা। পাল্টা হামলায় একজন পাহাড়ী হত্যার খবরও মিলেছে। উত্তেজনা প্রশমনে বিজিবি ও সেনাবাহিনী মোতায়েন করা হয়েছে। চব্বিশ ঘণ্টা মনিটরিং করা হচ্ছে সার্বিক পরিস্থিতি। স্থানীয় যুবলীগ নেতা নয়ন হত্যাকা-কে কেন্দ্র করে পাহাড়ী-বাঙালীদের যার যার পক্ষ থেকে যে ব্যাখ্যা বা বিবৃতিই প্রচার করা হোক না কেন, ঘটনাটিকে পুঁজি করে উভয় পক্ষের সুযোগ সন্ধানীরা যেন আরও কোন বড় ধরনের উত্তেজনা ও অনাকাক্সিক্ষত পরিস্থিতির সৃষ্টি করতে না পারে, তা নিশ্চিত করতে হবে স্থানীয় প্রশাসনকে। কোন অবস্থাতেই সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বিনষ্ট এবং পারস্পরিক শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানের পরিস্থিতির অবনতি হতে দেয়া যাবে না। আশার কথা এই যে, ইতোমধ্যে পাহাড়ী বাঙালীদের নিয়ে উপজেলা প্রশাসন ও সেনাবাহিনীর পক্ষ থেকে যৌথ সভা এবং মতবিনিময় করা হয়েছে। এর পাশাপাশি যে বা যারা পাহাড়ী-বাঙালী নির্বিশেষে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে তালিকা সাপেক্ষে তাদের ত্রাণ ও পুনর্বাসনও প্রত্যাশিত। ইতোমধ্যে ১৪৪ ধারা প্রত্যাহারসহ পাহাড়ীদের ঘরে ফেরার খবরও আছে। ১৯৯৭ সালে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার উদ্যোগ ও নেতৃত্বে পার্বত্য শান্তি চুক্তি সম্পাদিত হওয়ার পর সঙ্গত কারণেই আশা করা গিয়েছিল যে, ওই অঞ্চলে শান্তি প্রতিষ্ঠিত হবে। তবে দুঃখজনক বাস্তবতা হলো, এতদিনেও তা হয়নি। বরং ইতোমধ্যে কোন কোন অঞ্চল আরও অস্থির ও অশান্ত হয়ে উঠেছে। এর জন্য পাহাড়ীদের পক্ষ থেকে প্রায়ই শান্তি চুক্তির ধারাগুলো যথাযথভাবে বাস্তবায়িত না হওয়ার অভিযোগ উত্থাপিত হয়ে থাকে। এই অভিযোগ অবশ্য সর্বাংশে সঠিক নয়। বরং শান্তি চুক্তি বাস্তবায়নে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের সরকার বরাবরই আন্তরিক ও সচেষ্ট। তবে পার্বত্য অঞ্চলে সর্বাপেক্ষা জটিল সমস্যা ভূমি জরিপ ও বণ্টনের কাজটি এখনও অসম্পন্ন রয়ে গেছে। বিষয়টি সময়সাপেক্ষ এবং জটিলও বটে। আইনী জটিলতাও আছে বৈকি। সর্বোপরি পার্বত্য অঞ্চলের অধিবাসীরা একাধিক ক্ষুদ্র নৃতাত্ত্বিক গোষ্ঠীতে বিভক্ত। নেতৃত্বের সঙ্কটসহ বহুধাবিভক্ত গোষ্ঠী এমনকি সশস্ত্রপন্থীও বিদ্যমান। এমতাবস্থায় নিজেদের মধ্যে নেতৃত্বহীনতা, পারস্পরিক সন্দেহ ও অবিশ্বাস বিরাজমান থাকলে শান্তি চুক্তি বাস্তবায়ন যে হবে সুদূরপরাহত, তাতে আর সন্দেহ কী? পাহাড়ীদের এই সারসত্য বুঝতে হবে যে, নিজেদের মধ্যে অবিশ্বাস ও অনৈক্য বজায় রেখে এমনকি সশস্ত্র সংগ্রামের পথ বেছে নিয়েও খুব বেশিদূর অগ্রসর হওয়া যাবে না। তাতে তারা নিজেদের গোষ্ঠী ও সম্প্রদায়ের অনিবার্য ক্ষতিই ডেকে আনবেন। বরং তাদের উচিত হবে বাংলাদেশের সংবিধান ও আইনের শাসনের প্রতি শ্রদ্ধা এবং সম্মান প্রদর্শন করে পারস্পরিক শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান সুনিশ্চিত করা। পাহাড়ী-বাঙালী বিভেদ সর্বদাই অনভিপ্রেত ও অনাকাক্সিক্ষত। বাংলাদেশ ধর্মীয় সম্প্রীতি, শান্তি ও সহাবস্থানের দেশ। সেখানে অবস্থানরত বাঙালীদেরও বুঝতে হবে যে, পাহাড়ীরা তাদের আদৌ শত্রু নয়, বরং ভাই। সংখ্যাগুরুদের সংখ্যালঘুদের নিরাপত্তা দেয়া অন্যতম দায়িত্ব ও কর্তব্য। সে অবস্থায় উভয় পক্ষকেই আইনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল থাকতে হবে। আগামীতে এই ধরনের ঘটনার যেন আর পুনরাবৃত্তি না ঘটে এবং নয়ন হত্যার বিচার যাতে হয় তা নিশ্চিত করার দায়িত্ব স্থানীয় প্রশাসনের এবং রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের।
×