ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

এসএম মুকুল

দেশজ স্বনির্ভরতার প্রতীক মুড়ি

প্রকাশিত: ০৭:১০, ৪ জুন ২০১৭

দেশজ স্বনির্ভরতার প্রতীক মুড়ি

মুড়ি প্রায় সবারই পছন্দের খাবার। নাস্তায়, ইফতারিতে, আড্ডায় মুড়ির জুড়ি নেই। কুড়কুড়ে, মুড়মুড়ে মুড়ি বাঙালীর প্রাচীন মুখরোচক খাবার। আমাদের অনেকেরই জানা নেই যে- মুড়ি ভাজাকে উপজীব্য করে জীবিকা নির্বাহ করে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলের মানুষ। যেখানে সারা বছর মুড়ি ভাজা হয়। রমজান মাসে মুড়ির চাহিদা বেড়ে যায় দ্বিগুণ। জীবন-জীবিকাকে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠা এসব শিল্প দেশজ স্বনির্ভরতার প্রতীক হয়ে আশা জাগাচ্ছে। সুনাম আছে ঝালকাঠির মুড়ির বিশ্বাস করুন আর নাই বা করুন, এই দপদপিয়ায় নাকি বছরে প্রায় দুই কোটি টাকার মুড়ি উৎপাদন হয়। মুড়িকে যত সাধারণই ভাবা হোক না কেন, দপদপিয়ার মানুষ প্রমাণ করেছে মুড়ি ভাজাটাই একটা শিল্প। একটি নয় দুটি নয় ঝালকাঠির দপদপিয়া ইউনিয়নের রাজাখালী, দপদপিয়া, তিমিরকাঠি, ভরতকাঠি ও জুরাকাঠি এই পাঁচটি গ্রামের অধিকাংশ মানুষ মুড়ি তৈরির ওপর জীবিকা নির্বাহ করে। গ্রামগুলোতে রাতদিন চলে মুড়ি তৈরির ব্যস্ততা। একক পেশায় সর্বাধিক জনগণের অংশগ্রহণের কারণেই এ গ্রামের নাম হয়েছে মুড়ি গ্রাম। মুড়ি তৈরিকে পেশা হিসেবে বেছে নিয়ে অনেক পরিবার দেখেছে সচ্ছলতার মুখ। ঝালকাঠির মুড়ি বিদেশেও সমান জনপ্রিয়। এখানে দুই পদ্ধতিতে মুড়ি ভাজা হয়। যারা একটু সচ্ছল তারা নিজেরা বাজার থেকে ধান কিনে আনে। তারপর বিশেষভাবে প্রক্রিয়াজাত করে চাল তৈরি করে মুড়ি ভেজে নিজেরাই বাজারজাত করে। যারা আর্থিকভাবে অসচ্ছল তারা আড়তদারদের কাছ থেকে বিনামূল্যে চাল এনে মুড়ি ভেজে আড়তে সরবরাহ করে। তথ্যে জানা গেছে একজন পূর্ণবয়স্ক মানুষ দৈনিক ২ মণ মুড়ি ভাজতে পারে। বুড়িরহাটের মোটা মুড়ি রাত ২টা বাজতেই মাটির হাঁড়ি-পাতিলের টুংটাং শব্দ। মুড়ি ভাজার উৎসবে জ্বলে ওঠে ৩০০ ঘরের এক হাজার ২০০ চুলার আগুন। তৈরি হয় বরিশালের মোটা মুড়ি। বরিশাল-ঝালকাঠি সীমান্ত এলাকা বুড়িরহাট ও আশপাশের ১০ গ্রামে মোটা মুড়ি বানানো হচ্ছে ১০০ বছরেরও বেশি সময় ধরে। স্বাদে অতুলনীয় বলে বরিশালের বুড়িরহাটের মোটা মুড়ির খ্যাতি ছড়িয়েছে দেশের বাইরে। রমজান মাস এলেই সরগরম হয়ে ওঠে বরিশালের বুড়িরহাটের মুড়িপল্লী। বুড়িরহাট ও এর আশপাশের এলাকায় প্রতিদিন তৈরি হয় ২০০ মণ মুড়ি, যা দেশের বিভিন্ন বাজারে চলে যায়। রমজান আসামাত্র মুড়ির চাহিদা আরও ১০০ মণ বেড়ে যায়। ভোলার ভেজালমুক্ত মুড়ি ভেজালমুক্ত মুড়ি ভাজায় সুনাম অর্জন করেছেন ভোলার বাপ্তা ইউনিয়নের মুছাকান্দি ও চাচরা গ্রামের নারীরা। ঢেঁকিছাটা চালে তৈরি ভেজালমুক্ত ও স্বাস্থ্যসম্মত উপায়ে মুড়ি ভাজায় ভোলার এই দুই গ্রামের মুড়ির ব্যাপক চাহিদা। প্রতিদিন ভাজা এসব মুড়ি যাচ্ছে জেলার বিভিন্ন হাট-বাজার হয়ে চলে আসছে রাজধানী ঢাকায়। এসব গ্রামের অনেকেই এখন স্বাবলম্বী। বিশেষ করে নারীরা। মধ্যবাপ্তা ৫নং ওয়ার্ডের মুছাকান্দি গ্রামের কয়েকশ নারী-পুরুষ মুড়ি তৈরির কাজ করেন। এই মুড়ির নামও দিয়েছেন নিরাপদ মুড়ি। প্রতিদিন এই এলাকায় প্রায় ২০ মণ মুড়ি তৈরি হয়। সোনারগাঁয়ের মুড়ি নেই তার জুড়ি নারায়ণগঞ্জের সোনারগাঁয়ের কাজীরগাঁ, চৌধুরীগাঁ, মঙ্গলেরগাঁ, দুর্গাপ্রসাদ, তাতুয়াকান্দি, দুধঘাটা গ্রামের তিন শতাধিক পরিবার ১৯৫০ সাল থেকে হাতে মুড়ি তৈরি করে দেশ-বিদেশে ব্যাপক খ্যাতি ও সুনাম অর্জন করেছে। এসব গ্রামে বছরে প্রায় তিন-চার কোটি টাকার মুড়ি বিক্রি হয়। পেশার সুবাদে গ্রামগুলোর মূল নাম হারিয়ে মুড়িপল্লী হিসেবে সমধিক পরিচিতি লাভ করেছে। তারা নিশ্চিত করেই বলছেনÑ এখানকার মুড়িতে রাসায়নিক ব্যবহার করা হয় না। সোনারগাঁয়ের গ্রামগুলোতে তৈরি হাতেভাজা মুড়ির রাজধানীর চাহিদা মিটিয়ে রফতানি হচ্ছে পৃথিবীর প্রায় ১৫টি দেশে। ওখানকার পিরোজপুর ও সম্ভুপুরা ইউনিয়নের ৫টি গ্রামের ঘরে ঘরে রমজান মাসে হাতেভাজা মুড়ির ধুম পড়ে যায়। দেশের মুড়ির বিদেশ পাড়ি চট্টগ্রাম বন্দর দিয়ে বছরে প্রায় ২০ কোটি টাকার মুড়ি রফতানি হয়। মুড়ি রফতানি করে বছরে ২৫ লাখ মার্কিন ডলার অর্থাৎ সাড়ে ১৮ কোটি টাকা রফতানি আয় হয়। মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশের মধ্যে আবুধাবী, সৌদি আরব ও কাতার এবং লন্ডন, যুক্তরাষ্ট্র, জার্মানি, বেলজিয়াম, ফ্রান্স, দুবাই, পাকিস্তান, কুয়েত, নেপাল ও সিঙ্গাপুরে মুড়ি রফতানি হয়। মধ্যপ্রাচ্য প্রবাসীদের কাছে মেশিনে তৈরি মুড়ির চেয়ে হাতে তৈরি মুড়ির চাহিদাই বেশি। বিগত বছরে দুই হাজার থেকে ২২ শত টন মুড়ি রফতানি হয় চট্টগ্রাম বন্দর দিয়ে। দু’একটি প্রতিষ্ঠান ছাড়া এই মুড়ির বেশির ভাগই হাতে তৈরি করা হয়। অপ্রচলিত পণ্য রফতানি উৎসাহিত করতে সরকার ২০ শতাংশ ইনসেনটিভ দেয়ায় গত ক’বছরে রেকর্ড পরিমাণ মুড়ি রফতানি হয়েছে। চট্টগ্রামের ছোট-বড় ৫০টি প্রতিষ্ঠানসহ দেশের বেশকিছু প্রতিষ্ঠান এই মুড়ি রফতানি করে। এ শিল্পেরও অনেক সমস্যা আছে। মেশিনের মাধ্যমে সার মিশ্রিত মুড়ি অপেক্ষাকৃত কম খরচে তৈরি করে কম মূল্যে বাজারজাত করার কারণে এই গ্রামবাসীর রোজগারের পথের অন্তরায় হয়ে দাঁড়িয়েছে। এসব মুড়ি সহজ উপায়ে সার মিশিয়ে তৈরি হয়। স্বাস্থ্যের জন্য এগুলো খুবই ক্ষতিকর। সরকারী বা বেসরকারী উদ্যোগে এই মুড়ি গ্রামকে বাণিজ্যিক মুড়ি উৎপাদন কেন্দ্র হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করার কথা ভাবা যেতে পারে। আমরা প্রত্যাশা করব মুড়ি গ্রামগুলোকে বাণিজিকীকরণ করে আরও অধিক উৎপাদন এবং এ পেশায় ব্যাপক কর্মসংস্থান সৃষ্টি করতে সরকার ও উদ্যোক্তারা এগিয়ে আসবেন।
×