ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

দেখতে কৃষ্ণচূড়ার মতো

পথের ধারে নামহারা ফুল...বেড়ে উঠেছে অনাদরে, প্রকৃতির সৌন্দর্যে ভরপুর

প্রকাশিত: ০৬:০৯, ৪ জুন ২০১৭

পথের ধারে নামহারা ফুল...বেড়ে উঠেছে অনাদরে, প্রকৃতির সৌন্দর্যে ভরপুর

সমুদ্র হক ॥ “পথের ধারে নাম হারা ফুল ফোটে কত রাত্রি দিনে, যে তারে চিনতে পারে দাম দিয়ে তারে কেনে...” এমন ফুল প্রকৃতিকে সৌন্দর্যে ভরে সাজিয়ে তুলেছে। তৈরি করছে নিসর্গের এক ভুবন। ফুলগুলো অনাদরে ফুটে কিছুটা সময় থেকে অনাদরেই ঝরে পড়ছে। সুরভিত সপনে দেখা ফুলগুলো পথিক যখন পথের ধারে দেখে তখন কিছুটা সময়ের জন্য থমকে দাঁড়ায়। তেমনই এক ফুল বগুড়ার শেরপুর উপজেলার গ্রামের পথের ধারে দীর্ঘ সময় ধরে বনফুলের পরিচয়ে ফুটছে। এখন কেউ বলছে- এই ফুল রেড সোনাইল। গ্রীষ্মের এই সময়টায় লাল কৃষ্ণচূড়া আকাশপানে চোখ মেলে জানান দেয়, অগ্নিঝরা দিনের প্রতীক হয়ে এসেছে। দাবদাহে হাঁসফাঁস করা মানুষ এই কৃষ্ণচূড়ার ছায়ার নিচেই বসে জুড়িয়ে নেয় অবসন্ন দেহ। কৃষ্ণচূড়ার মতোই লম্বা এক গাছ বনফুলের বৃক্ষের পরিচিতি নিয়ে ফুটছে গ্রামের পথের ধারে। দূর থেকে লম্বা বৃক্ষে ফোটা লাল রঙের এই ফুল দেখে সাধারনজন ধারণা করে, এটাও কৃষ্ণচূড়া। আসলে এই ফুল কৃষ্ণচূড়া নয়। রাধাচূড়াও নয়। সোনালু বলতে হলদেটে ও সোনালি রঙের যে ফুল দেখা যায় অনেকটা তারই মতো এই ফুল দেখতে লালচে। ভ্রান্তি বিলাসের মধ্যে পড়ে এই ফুল পরিচিতি পাচ্ছে কৃষ্ণচূড়া। গাছতলায় ফুলের দিকে তাকালে ভ্রান্তি কেটে যায়। এ তো কৃষ্ণচূড়া নয়। লাল কোন এক বনফুল। বহু যুগ পর জানা যাচ্ছে- এর পরিচিতি লাল সোনাইল। বগুড়ার শেরপুর-ধুনট সড়কে ব্রিজের পরেই উত্তর ধারে ১৫ থেকে ২০ মিটার উঁচু এই গাছে থোকায় থোকায় ফুল ফুটেছে। এলাকার লোকজন বলল, তারা এই ফুলের নাম জানে না। বংশপরম্পরায় তারা এই ফুল দেখছে। বনের ফুলের মতোই ফোটে। গ্রীষ্মে ফুটে শ্রাবণের অনেকটা সময় ধরে থাকে। তারপর ঝরে যায়। ফের ফোটে। লম্বা এই গাছের ছাল-বাকল বেশি শক্ত নয়। তাই টিম্বার ভেলু নেই। তবে ছাল-বাকলের ঔষধি গুণাগুণ আছে। শীতে গাছের সকল পাতা ঝরে পড়ে। গ্রীষ্মে শাখা-প্রশাখা জুড়ে ঝুলন্ত মঞ্জরিতে ফুল ফোটে। ফুলের পাপড়ি সাধারণত পাঁচটি। তবে বেশিও হয়। মাঝে হলদেটে পরাগ। পাতা হালকা সবুজাভ। লাল সোনাইল বা রেড সোনাইলের ফল অনেকটা সজনের মতো। সহজে দৃষ্টিগোচর হয় না। মনে হবে শাখার সঙ্গে মিশে আছে। এই ফলের বীজ মাটিতে পড়লে আপনাআপনি বনফুলের মতো গাছ জন্মে তা বেড়ে ওঠে। বেড়ে ওঠার পর্যায়ে গ্রামের অনেকে বৃক্ষটিকে উপড়ে দেয়। যেগুলো টিকে থাকে তা বেড়ে ওঠে অনাদরেই। কেউ পরিচর্যাও করে না। এরা প্রকৃতির সান্নিধ্যে থেকেই বেড়ে ওঠে। প্রকৃতিই ওদের মমতায় জড়িয়ে রাখে। লম্বা এই বৃক্ষকে কোন কোন বৃক্ষপ্রেমী বলেন, ঝর্ণাধারার বৃক্ষ। সোনালু ফুলের বৃক্ষ গোল্ডেন সাওয়ার ট্রি পরিচিতি অনেক আগেই পেয়েছে। সোনালু গোত্রের ফুল হওয়ায় তারই পথ ধরে রেড সোনাইল পেয়েছে ঝর্ণাধারার বৃক্ষের মর্যাদা। এর বৈজ্ঞানিক নাম ক্যাসিয়া ফিসটুলা। আরেকটি নাম এ্যালবেজিয়া ইনআনডেট। ফুলের আদি নিবাস হিমালয় অঞ্চলে। বহু আগে অস্ট্রেলিয়ার নিউ সাউথ ওয়েস্ট কুইন্সের উষ্ণ অঞ্চলে রাস্তার ধারে শোভাবর্ধন করে রাখে এই ফুল। বাংলাদেশ, ভারত, মিয়ানমারে এই ফুল বনফুল হিসেবেই বেড়ে উঠছে। কোন জায়গায় বৃক্ষ ও ফুলপ্রেমীরা নাম দিয়েছেন। কোথাও দেননি। সোনালু গোত্রের পরিচয়েই টিকে আছে। এখন হয়েছে রেড সোনাইল। বাংলাদেশে আজও এই ফুল অনেকের কাছে অচেনা। দেশে কত যে বনফুল আছে তার হিসাব কেউ করে না। এ নিয়ে ফুল গবেষক ও বৃক্ষপ্রেমীরা বেশিরভাগ সময়ই নীরব হয়ে থাকেন। বোটানিক্যাল গার্ডেনও দেশে কম। হাতেগোনা। গ্রামের পথে-প্রান্তরে এবং ঝাউবনগুলোতে অযতনে-অনাদরে হাজারো বনফুল ফুটে ঝরে পড়ছে। কেউ তার খোঁজ রাখে না। রেড সোনাইল বৃক্ষটি দীর্ঘ বলে দৃষ্টিতে আসে। কৃষ্ণচূড়ার মতোই উঁকি দেয়। কৃষ্ণচূড়ার মতো ভ্রান্তি বিলাসে না পড়লে এই বৃক্ষকে হয়ত মানুষের হাতেই মরতে হতো (যদিও অনেক বৃক্ষ উপড়ে ফেলা হয়েছে)। সম্প্রতি ঢাকার হাতিরঝিলে এই বৃক্ষ চোখে পড়েছে। বলা হয়েছে কোন বৃক্ষপ্রেমী মিয়ানমার থেকে এই ফুল এনেছে। তবে বগুড়ার গ্রামগুলোতে এই ফুল বহু আগে থেকেই ফুটছে। বলা হয়েছে এই ফুলের নাম বার্মা সোনালু বা রেড সোনাইল। যে নামেই ডাকা হোকÑএই ফুল শোভাবর্ধন করে দেশের পথ-ঘাটকে। কোন বোটানিক্যাল গার্ডেনে। কেউ শখ করে এখন বাড়ির শোভাবর্ধনে এই ফুলগাছ রোপণ করেনি। হয়ত বৃক্ষটি উঁচু বলে। বাড়ির সামনে লাগাবে সেই জায়গা কই। নগরীতে তো নেই-ই। গ্রামও দিনে দিনে উপশহরে পরিণত হচ্ছে। এই ফুল অনাদরে বনফুল হয়েই হয়ত রয়ে যাবে....।
×