মোয়াজ্জেমুল হক, চট্টগ্রাম অফিস ॥ ২০১৬ সালের ৫ জুন চট্টগ্রামের সাবেক এসপি বাবুল আক্তারের স্ত্রী মাহমুদা খানম মিতু নির্মমভাবে সন্ত্রাসীদের উপর্যুপরি ছুরিকাঘাত ও গুলিতে প্রাণ হারান। ওইদিন সকালে বড় ছেলেকে স্কুলগামী বাসে উঠিয়ে দেয়ার জন্য বাড়ি থেকে বের হয়ে ৫ থেকে ৭ মিনিট হেঁটে যাওয়ার পথে ৩ মোটরসাইকেল আরোহী সন্ত্রাসী তার গতিরোধ করে তাকে খুন করে পালিয়ে যায়।
মিতু হত্যাকা-ের পর দেশজুড়ে এ নিয়ে ব্যাপক চাঞ্চল্য সৃষ্টি হয়। বিভিন্ন মাধ্যমে বিভিন্ন তথ্য প্রকাশিত হতে থাকে। মিতুর স্বামী তৎকালীন এসপি বাবুল আক্তার প্রথমে এটি জঙ্গীদের কাজ বলে ধারণা দিলেও পরবর্তীতে সে ধারণা পাল্টে গিয়ে তিনি নিজেই সন্দেহের আবর্তে পড়ে যান। কেননা, পুলিশ কর্মকর্তা হিসেবে তিনি যে সব সোর্সের মাধ্যমে বিভিন্ন ধরনের বেআইনী কার্যক্রম উদঘাটন করতেন এমন এক শীর্ষ সোর্সই মিতু হত্যাকা-ের মূল হোতা বলে পরবর্তীতে তদন্তে উদঘাটিত হয়েছে। কিন্তু সেই মুসার কোন হদিস গত প্রায় এক বছরেও মেলেনি। অথচ মুসার স্ত্রী নিজেই দাবি করেছেন তার স্বামীকে সাদা পোশাকধারী পুলিশ বাসা থেকে তুলে নিয়ে গেছে। তিনি ওই পুলিশের নামও উল্লেখ করেছেন। অপরদিকে, কিলিং স্কোয়াডে জড়িত সকলেই একে একে গ্রেফতার হয়েছে। এরা হচ্ছে ওয়াসিম, নবী, আনোয়ার, রাশেদ, শাহজাহান, এহতেশামুল হক ভোলা ও কালু। মুসাকেও আটক করার ঘটনা চাউর হয়ে থাকলেও পুলিশ এ পর্যন্ত স্বীকার করেনি। বরাবরই পুলিশ বলে আসছে তাকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। অপরদিকে, নবী ও রাশেদ পরবর্তীতে পুলিশের সঙ্গে রাঙ্গুনীয়ায় বন্দুকযুদ্ধে প্রাণ হারিয়েছে। বর্তমানে পলাতক দেখানো হয়েছে মুসা ও সহযোগী কালুকে। মুসাকে ধরার জন্য ৫ লাখ টাকা পুরস্কার দিয়ে রেখেছে সিএমপি কর্তৃপক্ষ।
আগামীকাল ৫ জুন মিতু হত্যাকা-ের বছর পূর্ণ হবে। যেখানে গ্রেফতারকৃত আসামিরা মিতুকে হত্যার স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দী দিয়েছে আদালতে সেখানে শুধু হত্যাকা-ের মূল নির্দেশদাতা কে সেটিই রয়েছে অনুদঘাটিত। এ ধরনের পরিস্থিতিতে মিতুকে হত্যার ব্যাপারে স্বামী বাবুল আক্তারের সংশ্লিষ্টতা রয়েছে বলে বিভিন্ন মিডিয়ায় বিভিন্নভাবে তথ্য প্রচার হওয়ার পর শ্বশুর ও শাশুড়িও এমন সন্দেহ পোষণ করে গণমাধ্যম কর্মীদের কাছে বক্তব্য দিয়েছেন। এছাড়া বাবুল আক্তার অপর এক পুলিশের স্ত্রীর সঙ্গে পরকীয়ায় জড়িত বলে অভিযোগও উঠে। এ বিষয়টিও বাবুলের শ্বশুরের পক্ষ জোরালোভাবে তদন্ত করে দেখার জন্য তদন্ত কর্মকর্তার কাছে আবেদন করে গেছেন।
সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন পুলিশের গোয়েন্দা বিভাগ এ মামলার তদন্ত কার্যক্রমে জড়িত হলেও অন্যান্য বিভাগের একাধিক কর্মকর্তা এ নিয়ে শুরু থেকে বিভিন্নভাবে সহযোগিতা করেছেন। গ্রেফতারকৃতদের জিজ্ঞাসাবাদে ৫টি উপ টিম কাজ করেছে খোদ আইজির নির্দেশে। যে কারণে অতি দ্রুততম সময়ে কিলিং স্কোয়াডের সদস্যরা ধরা পড়ে যায়। গণমাধ্যম কর্মীদের কাছে নিশ্চিতভাবে তথ্য চলে আসে যে মুসাও আটক অবস্থায় রয়েছে। পরে তাকে গুম করা হয়েছে। এসব নিয়ে নানা জল্পনাকল্পনা চাউর হয়ে থাকলেও তদন্ত কর্মকর্তা গোয়েন্দা বিভাগের অতিরিক্ত উপ কমিশনার (উত্তর) মোঃ কামরুজ্জামান বরাবরই তদন্ত এগিয়ে চলছে বলে দাবি করে আসছে। পাশাপাশি সিএমপি কমিশনার মোঃ ইকবাল বাহারও গণমাধ্যম কর্মীদের প্রশ্নের উত্তরে বলে থাকেন তদন্ত তদন্তের নিয়মেই চলছে।
এ ধরনের পরিস্থিতিতে সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞ মহলে প্রশ্ন উঠেছে, সাবেক একজন এসপির স্ত্রীকে দিবালোকে কিলিং স্কোয়াডের সদস্যরা হত্যা করল। যা সিসি টিভির ফুটেজেও চিহ্নিত হলো। এ নিয়ে তদন্তও বহুদূর এগিয়ে যায়। পুলিশের সর্বোচ্চ মহল থেকে শুরু করে তদন্ত কর্মকর্তা পর্যন্ত বিষয়টি নিয়ে জোরালো ভূমিকা গ্রহণ করে। এ প্রেক্ষিতেই একে একে কিলার গ্রুপের সদস্যরা ধরা পড়ে যায়। তাদের জবানবন্দী গৃহীত হয়। পুলিশের বিভিন্ন সূত্রে জানানো হয়েছে, বাবুল আক্তারের প্রধান সোর্স মুসাই কিলিং মিশনে নেতৃত্ব দিয়েছে। সেই মুসা যে পুলিশ হেফাজতে ছিল তাও সকলের জানা থাকলেও দালিলিক কোন প্রমাণ নেই। এ মুসার অনুপস্থিতির বিষয়টি উল্লেখ করে তদন্তের গতি অত্যন্ত ধীর হয়ে আছে।
অপরদিকে, বিভিন্নভাবে বাবুল আক্তার নিজে এ হত্যাকা-ের সঙ্গে জড়িত বলে নানা অভিযোগের পাশাপাশি তার শ্বশুর ও শাশুড়িও এ নিয়ে সন্দেহ জানিয়ে গেছেন এবং তাকে আইনের আওতায় এনে জিজ্ঞাসাবাদের আবেদন করেছেন। কিন্তু মিতু হত্যাকা- পর্যালোচনায় দেখা যায় সবই যেন রহস্যের আবডালে পড়ে গেছে। কেন এই ঘটনা। খোদ পুলিশের পক্ষ থেকে বলা হয়ে থাকে একজন ডাকসাইটের এসপি হিসেবে পরিচিত বাবুল আক্তারের স্ত্রী হত্যাকা-ের সঙ্গে যারাই জড়িত থাকুক না কেন, তা যত দ্রুত উদঘাটিত হবে ততই পুলিশের ভাবমূর্তির জন্য ভাল হবে। কেননা, একজন এসপির স্ত্রীর নিরাপত্তার বিষয়টি এ ঘটনা নিয়ে বিঘিœত হয়ে আছে। পুলিশ যেহেতু জনগণের নিরাপত্তা দিয়ে থাকে সেক্ষেত্রে একজন স্ত্রীর ভাগ্য বিপর্যয় যেখানে ঘটে যায় সেখানে সাধারণ মানুষের মাঝে আস্থার ঘাটতি পড়ে। ওইসব পুলিশ সূত্রে এমনও দাবি করা হয়েছে, মিতুর স্বামী অর্থাৎ বাবুল আক্তার যদি এ ঘটনায় জড়িত থাকার প্রমাণ মেলে এবং তাকে যদি অভিযুক্ত করে এতে পুলিশের ভাবমূর্তি উজ্জ্বল হবে। অথচ কোন রহস্যের কারণে এমন চাঞ্চল্যকর ঘটনাটির গতি থমকে আছে তা সকলের কাছে বিস্ময়কর হয়ে আছে। আইনী প্রক্রিয়ায় এ হত্যা তদন্ত বহুদূর এগিয়েছে। শুধু মূল নির্দেশদাতা মুসাকে পাওয়া যাচ্ছে না বলে তদন্তের গতি থমকে যাবে- বিষয়টি মানতে পারছেন না উৎস্যুক সকলেই। এছাড়া এ ঘটনার সঙ্গে সরকার ও পুলিশের প্রেস্টিজ ইস্যুটিও জড়িত। কিন্তু অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে মিতু হত্যাকা-ের বিষয়টি দিন দিন হালকা হয়ে যাচ্ছে। এ ঘটনার সঙ্গে অস্ত্র মামলাটি যে গতিতে এগোচ্ছে হত্যাকা-ের মামলাটি তার চেয়ে বহুগুণে ধীরগতির রূপ নিয়ে আছে। আগামীকাল ৫ জুন এ ঘটনার বছর পূর্তি হবে। এখনও চার্জশীট পর্যন্ত দেয়ার প্রক্রিয়াটি দৃশ্যমান নয়। ফলে প্রশ্ন উঠেছে, বিচার কখন শুরু হবে আর রায়ও বা কখন আসবে। আর চূড়ান্ত রায়ে মূল হোতাদের স্বরূপ উন্মোচিত হবে কিনা তা নিয়েও সন্দেহের দানা বেঁধেছে। কেননা, হত্যাকা-ে নেতৃত্বদানকারী মুসা ছাড়া নাকি আর কারও জানা নেই যে, সে কার নির্দেশে মিতুকে এমন নৃশংস কায়দায় হত্যা করা হয়েছে। তার সঙ্গে মিশনে থাকা অপরাপর সদস্য সকলেই বলেছে তারা মিতুকে হত্যা করেছে মুসার নির্দেশে এবং তারই নেতৃত্বে। কিন্তু মুসা কার নির্দেশে করেছে তা তাদের জানা নেই। সঙ্গত কারণে যেহেতু মুসার অস্তিত্ব নেই তাই মূল নির্দেশদাতার স্বরূপ উন্মোচন আদৌ হবে কিনা তা নিয়ে রহস্যের দানা বেঁধেছে বহু আগে থেকেই।
আরো পড়ুন
শীর্ষ সংবাদ: