ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১

ড. মিহির কুমার রায়

শিক্ষকের মান-অপমান

প্রকাশিত: ০৪:০৭, ৪ জুন ২০১৭

শিক্ষকের মান-অপমান

শিক্ষকের মর্যাদা নাকি পিতা-মাতার পরেই যা ইতিহাস স্বীকৃত। এর অনেক প্রমাণও আছে কালের পাতায়। ছোটবেলায় বাল্যশিক্ষায় পড়েছিলামÑ ‘সকালে উঠিয়া আমি মনে মনে বলি, সারাদিন আমি যেন ভাল হয়ে চলি।’ এখনকার ছেলে-মেয়েরা এ ধরনের নৈতিক মূল্যবোধের কথাগুলো আর শুনতে পায় না। কারণ, বই-পুস্তকগুলো এমনভাবে রচিত হচ্ছে যেখানে নৈতিকতার বিষয়গুলোর চেয়ে আধুনিকতার বিষয়গুলো স্থান পায়। যা অনেক ক্ষেত্রে আদর্শিক দৃষ্টিভঙ্গির সঙ্গে সাংঘর্ষিক। কেবল সিলেবাস ধরে বাসায় বসে পাঠ্য সম্পন্ন করে নির্দিষ্ট স্থানে বসে পরীক্ষা দিয়ে যদি জ্ঞানের পূর্ণতা আসত তা হলে স্কুল-কলেজ কিংবা বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠদান কিংবা শিক্ষকের প্রয়োজন হতো না। এই জায়গাটিতে রয়েছে জ্ঞান বিতরণে শিক্ষকের অবদান যা সর্বজন স্বীকৃত। কিন্তু সময় সময় কিছু ঘটনা ঘটে যেখানে এই বিষয়টি ম্লান হয় যা সমাজ অগ্রগতির পথে বাধা। যার মূল কারণ শিক্ষা বিস্তারে রাজনীতির অনুপ্রবেশ ও সাম্প্রদায়িকতার ছোবল যা বিশেষ সম্প্রদায়কে করে অবাঞ্ছিত। ধর্ম নিয়ে রাজনীতি এখন দেশের একটি বিশেষ ক্ষেত্র, যার বলি হচ্ছে দেশের দুর্বল শ্রেণীর অংশবিশেষ। এতে বহির্বিশ্বে নষ্ট হচ্ছে দেশের ইমেজ। গত ১৩ মে, ২০১৬ তারিখে একটি ঘটনা ঘটে শ্যামল কান্তি ভক্তকে নিয়ে, যিনি নারায়ণগঞ্জের বন্দর উপজেলার একটি উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক, যা দৃশ্যমান হয় ১৬ মে, বিভিন্ন টেলিভিশন চ্যানেলের পর্দায়। তা দেখে আমরা বিস্মিত হই যে, একজন শিক্ষককে কানে ধরে ওঠানো বসানো হচ্ছে স্থানীয় সংসদ সদস্য ও উপজেলা শিক্ষা কর্মকর্তার সম্মুখে। ঘটনার বিবরণটি হলো ওই তারিখে শুক্রবার কে বা কারা পাশের মসজিদে মাইকে ঘোষণা দেয়, মিস্টার ভক্ত ধর্মের অবমাননা করে বক্তব্য দিয়েছে। যার ফলে পরবর্তী ঘটনাগুলোর মধ্যে রয়েছে শারীরিক নির্যাতন ইত্যাদি। পরবর্তীতে খবর আসে মসজিদের ইমাম সাহেব জানে না কে বা কারা এই মসজিদের মাইক ব্যবহার করে এই ঘোষণা দিয়ে গেছে। সার্বিক পরিস্থিতি থেকে প্রতীয়মান হয় যে, বিষয়টি ষড়যন্ত্রমূলক, যা দেশের সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বিনাশের আরও একটি অজুহাত ছাড়া কিছুই না। এই ঘটনাগুলো বার বার আসছে আমাদের সম্মুখে কেবল ধর্ম অবমাননা নামক অতি জনপ্রিয় সেøøাগানটিকে সামনে রেখে, যার বলি হয়েছে বাগেরহাটের কৃষ্ণপদ মাহালি ও অশোক কুমার ঘোষ, টাঙ্গাইলের নিখিল জোয়ারদার, দিনাজপুরের যজ্ঞেশ্বর দাস অধিকারী, বান্দরবনের এক বৌদ্ধ ভিক্ষু প্রমুখ। বর্তমান ধারাবাহিকতায় আগামী দিনগুলোতে এ ধরনের ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটবে না তা জোর দিয়ে কেউ বলতে পারবে না। কারণ, সমস্যাটি রাজনৈতিক, সামাজিক কিংবা অর্থনৈতিক নয়। যেমন গত ২৪ মে শ্যামল কান্তি ভক্ত একটি মামলার হাজিরা দিতে যান যে মামলাটি করেছিলেন একই স্কুলের ইংরেজী বিভাগের শিক্ষিকা মোর্শেদা বেগম ২০১৪ সালের ২৮ ডিসেম্বর বিশেষত তার চাকরির এমপিওভুক্ত করার ব্যাপারে ঘুষ নেয়ায়। আদালত তার জামিন নামঞ্জুর করে তাকে জেল হাজতে প্রেরণ করেন। এখানে উল্লেখ্য, ঘুষ গ্রহণের দু’বছর পর ২০১৬ সালের ২৭ জুলাই মোর্শেদা বেগম বাদী হয়ে এ মামলাটি করেন। এরই মধ্যে শ্যামল কান্তি ভক্তের ঘটনা নিয়ে সারাদেশের শিক্ষক সমাজ সোচ্চার হয়ে উঠেছে এবং সরকার তৎক্ষণাত অনেক পদক্ষেপ নিয়েছে। তারপরও এর জের শেষ হয়ে যায়নি। কারণ ঘটনাটি সামষ্টিক পরিস্থিতির বহিঃপ্রকাশ মাত্র এবং সাধারণ সংখ্যালঘু সম্প্রদায়কে টার্গেট করে একটি ধর্মীয় উপাদান ‘ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত’ বিষয়টিকে ঢিল ছুড়ে দিয়ে দেশে অস্থিতিশীল পরিবেশ সৃষ্টির যে চেষ্টা তা বর্তমানে ভাল বাজার করে নিয়েছে। তাহলে কি বিষয়টি ব্যবসায়ের পণ্যে রূপান্তরিত হলো? যদি তাই হয়, তবে এর সুদূরপ্রসারী প্রভাব পড়বে তা নিশ্চিত। দেশের মোট সংখ্যার প্রায় দশ শতাংশ লোক সংখ্যালঘু কিভাবে মুক্তি পাবে তার একটি সামাজিক সমাধানের পথ খুঁজে পাওয়া একান্তই জরুরী। বিশেষত টেকসই গণতন্ত্রের স্বার্থে। শ্যামল কান্তির ঘটনায় বলা যায়, ধর্মীয় সংবেদনশীলতাকে কাজে লাগিয়ে যারা রাজনৈতিক স্বার্থ হাসিল করতে চায় আমাদের জনপ্রতিনিধিরা কি প্রত্যক্ষভাবে তাদের মদদ জোগাচ্ছে না? গুজব আর মিথ্যাচার কি আমাদের ঘাড়ে চেপে বসছে না, যার সুযোগ কাজে লাগিয়ে অপশক্তিগুলো এই ধরনের ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটিয়ে চলছে। তা না হলে ১৭ বছর প্রধান শিক্ষক পদে অধিষ্ঠিত শ্যামলের জীবনে কি ঘটল যা তার সারাজীবনের সাধনাকে ম্লান করে দিল। বিভিন্ন টকশোর আলোচনায় জানা যায় স্কুল ম্যানেজিং কমিটির সদস্যের এক আত্মীয়কে প্রধান শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ দিতে চেয়েছিল স্কুল কমিটি। এই প্রক্রিয়ার অংশ হিসেবে এ সকল ঘটনা। বিষয়টি যদি সত্যি হয় তবে নিয়মতান্ত্রিক উপায়েই তা হতে পারত। এই নাটক সাজানোর কোন প্রয়োজন ছিল না। আবার ঘটনা সাজিয়ে অপদস্থ করে মানহানিকরভাবে তাকে চাকরিচ্যুত করারও দরকার ছিল না। এই ধরনের একটা পরিস্থিতিতে সারাদেশ যখন উত্তাল তখনই সরকার এগিয়ে আসে এবং তাদের তদন্তে যে সকল অভিযোগে প্রধান শিক্ষককে সরিয়ে দেয়া হলো তার কোন আলামত মিলেনি। তাই শিক্ষা মন্ত্রণালয় প্রশাসনিক আদেশবলে বর্তমান স্কুল কমিটিকে বাতিল করে দিয়েছিল এবং শ্যামল কান্তি ভক্তকে প্রধান শিক্ষক হিসেবে পুনর্বহালের নির্দেশ দেয়। এখন প্রশ্ন হলোÑ এই সকল ঘটনার পর প্রধান শিক্ষক তার পদে থেকে কাজ করতে পারবে কি-না সে নিয়ে সংশয় রয়েই গেল। এ লজ্জা জাতির যা একজনের বয়ে বেড়ানোর মতো বিষয় নয়। সংসদ সদস্য জানে না তার অবস্থানে থেকে কত বড় কাজটি করেছেন তিনি যার জন্য তার বিন্দুমাত্র আক্ষেপ নেই। দেশে একটি গণতান্ত্রিক সরকার প্রতিষ্ঠিত, একটি কার্যকর সংসদ রয়েছে, অর্থনৈতিক ও সামাজিক সূচকগুলো অগ্রগামী কিন্তু মানবীয় সূচকগুলো নি¤œমুখী রয়েছে, যা নিয়ে বিভিন্ন পর্যায়ে অসন্তুষ্টি কম নয়। মার্কিন পররাষ্ট্র দফতরের মুখপাত্র ওয়াশিংটন ডিসিতে বলেছেন, সংখ্যালঘুদের ওপর হামলাগুলো কোন একটা ছোট সন্ত্রাসী গোষ্ঠী ঘটাচ্ছেন যা বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর প্রতিনিধিত্ব করে না। বাংলাদেশের বিভিন্ন ধরনের মূল্যবোধের একটি বহুবাদী সমাজের গৌরবোজ্জ্বল ঐতিহ্য রয়েছে যা যে কোন মূল্যে সমন্বিত রাখতে হবে। আমরা দু-হাজার একুশ শতকে একটি মধ্য আয়ের দেশে উপনীত হওয়ার স্বপ্ন দেখছি। সেই লক্ষ্য বাস্তবায়নে বৈষম্যহীন অসাম্প্রদায়িক সমাজচিন্তা যার অনুশীলনে থাকবে মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় উদ্ভাসিত প্রগতিশীল সুশীল সমাজ, বুদ্ধিজীবী, শিক্ষক, পেশাজীবীসহ সরকারী পৃষ্ঠপোষকতা। তার জন্য দরকার এই ধরনের ঘটনার মধ্য দিয়ে যারা হীন রাজনৈতিক স্বার্থ হাসিল করতে চায় তা রোধ করা। লেখক : অর্থনীতিবিদ ও ডিন, সিটি ইউনিভার্সিটি
×