ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

ড. মুহম্মদ মাহবুব আলী

প্রস্তাবিত বাজেট নিয়ে সাদাসিধে কথা

প্রকাশিত: ০৪:০৭, ৪ জুন ২০১৭

প্রস্তাবিত বাজেট নিয়ে সাদাসিধে কথা

আমাদের অর্থমন্ত্রী জাতীয় সংসদে আড়ম্বর পরিবেশে চার লাখ দুইশ’ ছেষট্টি কোটি টাকার জাতীয় বাজেট প্রস্তাবনা ২০১৭-১৮ গত ১ জুন পেশ করেনÑ যা চলতি বাজেটের ১৭% বেশি। জাতীয় বাজেটে একটি দেশের রাজস্ব নীতি কিভাবে পরিচালিত হবে সেটির একটি ধারণা থাকে। বাজেটে আগামী অর্থবছরে প্রবৃদ্ধির হার ৭.৪০% এবং মূল্যস্ফীতির হার ৫.৫% নির্ধারণ করা হয়েছে। তবে এবারের বাজেট ঘোষণার পূর্বেই ভ্যাট নিয়ে ব্যবসায়ীদের অনেক বেশি সরব মন্তব্য মানুষকে বেশ চিন্তার মধ্যে ফেলে দিয়েছিল। এমনকি স্বয়ং প্রধানমন্ত্রীকে এ ব্যাপারে হস্তক্ষেপ করতে হয়েছিল। অর্থ উপদেষ্টা যখন ভ্যাট ১২% করার প্রস্তাবনা দিয়েছিলেন, সেটি মেনে নিলে ব্যবসায়ী মহল কেবল নয় ভোক্তা মহলও উপকৃত হতেন। তবে অনেক দ্রব্যের ওপর ছাড় দিয়ে ভ্যাট ১৫% করা হয়েছে। আসলে সাইফুর রহমান যখন ভ্যাট প্রচলন করেন তখনও কিন্তু এটি ১৫% ছিল। ভ্যাটের ক্ষেত্রে আমার সরল প্রস্তাব হচ্ছে পণ্য ভেদে ভ্যাট নির্ধারণ করা। কেননা নেসেসারি প্রোডাক্টসের ক্ষেত্রে যে হারে ভ্যাট হবে, লাক্সারিয়াস দ্রব্যের ক্ষেত্রে ভ্যাট সে হারে হতে পারে না, বরং অনেকগুণ বেশি হবে। ভ্যাটের ক্ষেত্রে আমি মনে করি সø্যাব (ঝষধন) প্রথা প্রণয়ন করাই উত্তম। ভ্যাট সংক্রান্ত নীতি বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে এখন থেকেই আগামী অর্থবছরের পরের বছরের জন্য অর্থ-উপদেষ্টার নেতৃত্বে একটি শক্তিশালী কমিটি থাকা দরকার সেখানে ব্যবসায়ী, আমলা, অর্থনীতিবিদ, কৃষক, শ্রমজীবী, রাজনীতিবিদ, ব্যাংকাররা থাকবেন। আসলে বাজেট প্রণয়নের ব্যাপারটি টপ-ডাউন এ্যাপ্রোচ এবং বটম আপ এ্যাপ্রোচের মধ্যে সমন্বয় সাধন করতে হবে। উপরন্তু বর্তমানে যে হারে ভ্যাট দিচ্ছে অর্থাৎ প্রায় ৮.৫ লাখ ভ্যাট নিবন্ধন থাকলেও দিচ্ছে প্রায় ৩৪ হাজারের মতো। বর্তমান সরকার এ ধরনের ফাঁক-ফোকর বন্ধ করতে চাচ্ছেন ই-ভ্যাট চালু করে। এজন্য অবশ্য এনবিআরের লোকদের যেমন প্রশিক্ষিত করা দরকার, যারা ই-ভ্যাট কিভাবে ব্যবহার করে উপকৃত হবেন সেদিকে দিকনির্দেশনা থাকা দরকার। ব্যক্তিগতভাবে আমি মনে করি, অপ্রত্যক্ষ করের চেয়ে প্রত্যক্ষ কর বেশি থাকাই উত্তম। মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য দুটো উৎসব ভাতা দেয়ার প্রস্তাবনা অভিনন্দনযোগ্য। তাদের জন্য দশ হাজার ফ্ল্যাট নির্মাণ করা হবে। বাংলাদেশে ট্যাক্স-জিডিপি রেইটের হার কম। বিশ্বব্যাংকের অর্থায়নে এনবিআরের ক্যাপাসিটি বিল্ডিং-এর প্রয়াস গ্রহণ করা হয়েছিল। তবে ট্যাক্স-জিডিপি অনুপাত কিন্তু খুব একটা বাড়েনি। পত্রিকান্তরে প্রকাশিত রিপোর্টে দেখা যায়, দেশে প্রায় বাইশ লাখ কোটিপতি রয়েছে। অথচ টিআইএনধারীর সংখ্যা হচ্ছে আটাশ লাখ এবং কর দেয় ১৩ থেকে ১৪ লাখ লোক। এত স্বল্প সংখ্যক প্রত্যক্ষ কর দিলে কি করে বাংলাদেশ চলবে। তাই এনবিআরকে শক্তিশালী করতে হবে। বৃহত্তর স্বার্থে যারা ট্যাক্স আদায় করতে সক্ষম হবেন এবং বহিঃস্থ চাপ মোকাবেলায় সক্ষম হবেন তাদেরকে অবশ্যই কাজে লাগাতে হবে। একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে উপাচার্য থাকাকালীন একজন সহকারী কর কমিশনার আক্ষেপ করে আমাকে বলেছিলেন, ১৭টি বেসরকারী নামী বিশ্ববিদ্যালয়ের কেউই ঠিকমতো কর দিচ্ছেন না। বরং ওপর থেকে চাপ প্রয়োগ করে উনাকে তার স্বীয় কর্তব্য থেকে বিরত রাখেন। আসলে আমাদের মনে রাখতে হবে দেশের উন্নয়নের জন্য সক্ষম প্রতিটি নাগরিককে কর দিতে হবে। কর ফাঁকি দেয়া এক ধরনের জালিয়াতি এবং যারা এ কাজটি করেন তারা প্রকারান্তরে দেশ ও জাতির শত্রু। আমরা এ দেশকে কেউ নিশ্চয়ই গ্রীসের মতো দেউলিয়া বানাতে চাই না। এদিকে যারা কর ঠিকমতো দেবেন তাদের জন্য ইনসেনটিভ দিতে হবে। এজন্য অবশ্যই একটি নীতিগত নিয়ম থাকা দরকার। এদিকে পরিবারের সবাই কর দিলে ‘কর বাহাদুর’ উপাধি দেয়ার যে প্রস্তাবনা সেটিকে সাধুবাদ জানাচ্ছি। এনবিআর যাতে কর আদায়ের ক্ষেত্রে কোন রকমের বিত্তশালীদের দ্বারা ভয়-ভীতি, চাপ কিংবা অনুরাগের বশবর্তী না হোন সে জন্য ব্যবস্থা থাকা দরকার। এ জন্য এনবিআরের খোলনলচে পরিবর্তন এবং একজন দক্ষ কা-ারী থাকা বাঞ্ছনীয়। নচেৎ অপ্রত্যক্ষ কর কমানো যাবে না। বাজেট কর ও বিদেশী অনুদান মিলে দু’লাখ তিরানব্বই হাজার চার শ’ চুরানব্বই কোটি টাকা ধরা হয়েছে। এনবিআরের আওতা থেকে ট্যারিফ কমিশনকে মুক্ত করা বাঞ্ছনীয়। দেখা যাচ্ছে বিএনপি যে সমস্ত ভূত তৈরি করে জগদ্দল পাথরের মতো চাপিয়ে রেখেছিল তা কিন্তু এখনও বহাল আছে। এ অবস্থা থেকে পরিত্রাণের জন্য ট্যারিফ কমিশনকে স্বাধীনভাবে কাজ করতে দিতে হবে। আসলে সামষ্টিক অর্থনীতিকে বেগবান করতে হলে অবশ্যই প্রতিটি প্রতিষ্ঠানকে নিজের দায়িত্ব পালন করতে দিতে হবে। এ দেশে শিল্প-কারখানার জন্য গ্যাস সংযোগের প্রস্তাবনা বাজেটে দেয়া হয়েছে। সরকার দেশের অবকাঠামোগত উন্নয়নে নানামুখী ব্যবস্থা নিয়েছে। যেমন পদ্মা সেতু নির্মাণ একটি সাধুবাদযোগ্য প্রয়াস। আবার পায়রা সমুদ্রবন্দর নির্মাণ, মংলা সমুদ্রবন্দর চালু করা, সড়ক পথ নির্মাণ, বন্ধ হয়ে যাওয়া রেলপথ চালু করা এগুলোসহ ৭টি মেগা প্রকল্প চালুর ব্যবস্থা হয়েছে। নৌ-পথ চালুর ব্যবস্থা আরও সম্প্রসারিত করতে হবে। তবে প্রাতিষ্ঠানিক অবকাঠামো বিনির্মাণের পাশাপাশি বেসরকারী উদ্যোক্তারা যাতে অন্য রাষ্ট্রসমূহে বিনিয়োগে উৎসাহী না হয়ে নিজ দেশে বিনিয়োগে উৎসাহী হোন সে জন্য গ্যাস-বিদ্যুত-জ্বালানি ও সরবরাহজনিত সমস্যাগুলো কাটিয়ে ওঠার পদক্ষেপ থাকলেও তা দ্রুত বাস্তবায়ন করতে হবে। রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুতকেন্দ্র মাতারবাড়ী তাপবিদ্যুত কেন্দ্রসহ ৪২টি বিদ্যুত কেন্দ্রের জন্য বরাদ্দ দেয়া হয়েছে। বিদ্যুত সঞ্চালন লাইনের জন্যও বরাদ্দ রাখা হয়েছে। ব্যাংকিংখাতে যে দুর্নীতি হচ্ছে তার বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা দরকার। ঋণ অবলোপন করার চেয়ে ঋণ আদায়ে ব্যাংকারদের সচেষ্ট হতে হবে। নতুন উদ্যোক্তা তৈরি করা বাঞ্ছনীয়। ব্যক্তিগতভাবে গবেষণা করে দেখেছি, বর্তমানে ব্যাংকাররা গতানুগতিক কর্মকা-ে বেশি আগ্রহী। স্পীড মানি পেলে কেউ কেউ ব্যতিক্রমধর্মী কাজ করে। গবেষণার জন্য সোনালী ব্যাংকে গিয়ে এক অদ্ভুত সেবার নমুনা দেখলাম। শাখায় সাধারণ কাস্টমারদের সঙ্গে ব্যবহারে অনীহা। অনেক কষ্টে যখন একজন কর্মকর্তাকে অনুরোধ করে আলাপ করলাম যে ইন্টারন্যাশনাল ভিসা কার্ড ইস্যুর ব্যাপারেÑ উনি জানালেন যেন, ইন্টারন্যাশনাল ভিসা কার্ড দেয়া হয় শুধু তাদের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের অথবা তাদের ব্যাংকে যাদের সেলারি এ্যাকাউন্ট আছে। ঋণের দুর্বৃত্তায়নে এ ধরনের পাবলিক ব্যাংকের জনগণের কষ্টার্জিত টাকা না দিয়ে বরং তাদেরকে বাজারে বন্ড সংগ্রহ করে ব্যাস হল-৩ অনুযায়ী পর্যাপ্ত ক্যাপিটেল সংগ্রহ করার সুযোগ দিতে হবে। এটি কেবল সোনালী ব্যাংক নয়, জনতা, অগ্রণী, রূপালী ও বেসিক ব্যাংকের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য। ব্যাংকিং সেক্টরের উন্নতি করতে হলে কেবল দুর্নীতি হ্রাস করলেই চলবে না, কাস্টমারদের সঙ্গে হাসিমুখে কথা বলা, বৈধ ও ন্যায্য গ্রাহকরা যাতে দক্ষভাবে পর্যাপ্ত, উদ্ভাবনী ও ধীশক্তিময় ব্যাংকিং সুবিধা পায় সেদিকে লক্ষ্য রাখা দরকার। এদিকে পুঁজিবাজারকে কিভাবে ঢেলে সাজানো হবে তার একটি রূপরেখা প্রত্যাশা করছিলাম। মান্ধাতার আমলের ব্যবস্থাপনায় পুঁজি বাজার পরিচালিত হচ্ছে। এখন পুঁজি বাজারের শেয়ার মার্কেট ব্যাংক কর্তৃক এখন রাজত্ব করছে। আর ব্যাংক সাধারণ মানুষকে ঋণ না দিয়ে ফটকা কারবারীতে লাভবান হতে চেষ্টা করছে। অথচ পুঁজিবাজারকে ঢেলে সাজাতে হলে অবশ্যই ডেরিবেটিভস মার্কেট এবং ডেভট মার্কেট চালু করা প্রয়োজন। এ জন্য পৃথক প্রয়োজনীয় দিকনির্দেশের পাশাপাশি প্রায়োগিক কৌশল প্রয়োজন। আমি আশা করব, বর্তমান সরকারের আমলে বাজেট নিয়ে বিভিন্ন গোষ্ঠীর সঙ্গে যে আলোচনা করে থাকেন তা সম্প্রসারিত হবেÑ তিনি কৃষক ও নিম্নশ্রমজীবী গোষ্ঠীর সঙ্গে বৈঠক করবেন এবং ঋণ খেলাপীদের সঙ্গে বৈঠক করবেন। এ দুটো গ্রুপের কাছ থেকে অনেক তথ্য-উপাত্ত পাওয়া যাবেÑ যা আগামীতে বাজেট প্রণয়নে ও বাস্তবায়নে সহায়তা দেবে। এদিকে অপ্রাতিষ্ঠানিক কাঠামোকে প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামোয় রূপান্তরের জন্য সকল ধরনের তৎপরতা গ্রহণ করা বাঞ্ছনীয়। যেহেতু বর্তমানে জনদরদী সরকার ক্ষমতায় আছে, অপ্রাতিষ্ঠানিক কাঠামো যাতে করে প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামোয় রূপান্তরিত হয় সেজন্যে সুদৃঢ় পদক্ষেপ খুঁজে বের করতে হবে। সিংহভাগ শ্রমজীবী এখনও অপ্রাতিষ্ঠানিক কাঠামোর আওতায় কাজ করেন। অথচ অপ্রাতিষ্ঠানিক কাঠামোকে প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামোয় আনয়ন করা গেলে যারা অপ্রাতিষ্ঠানিক কাঠামোয় চাকরি করেন তাদের চাকরির নিশ্চয়তা বিধান করা এবং কর বাড়তির সম্ভাবনা থাকে। এ লক্ষ্যে গ্রামীণ এলাকায় কমিউনিটি ব্যাংকিং সরকারী তদারকি সংস্থার মাধ্যমে স্থাপন করে ক্ষুদ্র সঞ্চয়কে ক্ষুদ্র বিনিয়োগে রূপান্তর করতে হবে। অর্থমন্ত্রী বাজেট বক্তৃতায় রফতানি এবং প্রবাসীদের আয় অর্জিত হবে বলে মন্তব্য করেছেন। রফতানি বৃদ্ধির জন্য ইপিবি এবং বিদেশ অবস্থানরত দূতাবাসসমূহকে টার্গেট প্রদান করতে হবে। অন্যদিকে অফিসিয়াল চ্যানেলে টাকা পাঠানোর জন্য নিম্নোক্ত ব্যবস্থা গ্রহণ করা যেতে পারে : ১. দূতাবাসসমূহ থেকে প্রতিনিধি পাঠিয়ে অর্থ সংগ্রহ করে অফিসিয়াল চ্যানেলে পাঠানো, ২. পারিবারিক ভরণ পোষণের জন্য যারা মাসে ৫০০ মার্কিন ডলার পর্যন্ত পাঠাবেন তাদের ক্ষেত্রে কোন ধরনের এআইটি এবং ভ্যাট কাটা যাবে না, ৩. বিদেশ থেকে প্রেরিত অর্থের প্রদেয় টাকা ক্যাশ ফরেন কারেন্সির সমতুল্য রাখার জোর নির্দেশনা এবং বাস্তবায়ন করতে হবে। বাজেটে শিক্ষার সম্প্রসারণে সচেষ্ট থাকার অঙ্গীকার করা হয়েছে। অথচ যে সমস্ত শিক্ষক-শিক্ষিকা বেসরকারী বিশ্ববিদ্যালয়ের ট্রাস্টি বোর্ড কর্তৃক ন্যায্য ও প্রাপ্য অর্থ পাচ্ছেন না, যাদের কারণে এ অবস্থার সৃষ্টি হচ্ছে তাদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা এবং অর্থ প্রদানের ব্যবস্থা থাকা দরকার। নচেৎ শিক্ষক-শিক্ষিকারা কেবল সমাজে দিয়ে যাবেন অথচ সুযোগ-সুবিধা বেসরকারী খাতের কারণে বঞ্চিত হবেন এটি মোটেই গ্রহণযোগ্য নয়। বাজেটে সামাজিক নিরাপত্তা খাতকে প্রাধান্য দেয়া হয়েছে। শেখ হাসিনা জনকল্যাণের জন্য বিশেষ গুরুত্ব দিয়ে থাকেন। পশ্চাৎপদ জনগোষ্ঠী, দলিত, তৃতীয় লিঙ্গসহ প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর উন্নয়নের কথা বলা-হয়েছে। আসলে সরকার চায় প্রতিটি মানুষের ভাগ্য উন্নয়ন। তবে পল্লী সঞ্চয় ব্যাংকের কার্যক্রম আরও গতিশীল করার জন্য প্রয়োজনীয় অর্থ বরাদ্দ এবং একটি শক্তিশালী অর্গানোগ্রাম ভিত্তিতে সমতল ও পাহাড়ী উভয় এলাকায় কার্যক্রম পরিচালনার উদ্যোগ নিতে হবে। তারা কমিউনিটি ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে ক্ষুদ্র সঞ্চয়কে ক্ষুদ্র বিনিয়োগে রূপান্তর করতে পারে। বাজেট বক্তৃতায় অর্থমন্ত্রী আশা করছেন, যেভাবে তিনি ব্যয় পরিকল্পনা করেছেন তার ফলে ২০২১ সালের পূর্বেই চরম দারিদ্র্যকে বিদায় জানাবেন। আসলে ধীরে ধীরে দেশে চরম দারিদ্র্য হ্রাস পাচ্ছে। এক্ষেত্রে সরকারের শুভ উদ্যোগের কারণেই বিভিন্ন এনজিও, ব্যাংক এবং অন্যান্য আর্থিক প্রতিষ্ঠান কাজ করছে। এক্ষণে এটিকে একটি ফর্মাল ওয়েতে কাজ করতে দিতে হবে- যাতে করে প্রধানমন্ত্রীর ক্ষুদ্র সঞ্চয় কমিউনিটি ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে ক্ষুদ্র বিনিয়োগে রূপান্তর করা যায়। স্বাস্থ্যখাতের উন্নয়নের জন্য কিছু পদক্ষেপ নেয়া হয়েছে। তবে স্বাস্থ্য খাতকে ঢেলে সাজানো দরকার যাতে করে বিদেশে মানুষ না গিয়ে দেশে চিকিৎসা সেবা পায়। পাশাপাশি ইনবাউন্ড মেডিক্যাল ট্যুরিজম যেন গড়ে ওঠে। উচ্চশিক্ষা ক্ষেত্রে কর্মসংস্থানের ওপর জোর দেয়া হয়েছে। তবে বর্তমান সরকার বেশ উদার হওয়ায় প্রয়োজনীয় সুযোগ-সুবিধা না থাকা সত্ত্বেও এমনকি একখ- জমি না থাকা সত্ত্বেও কূটনৈতিক পাড়া হোক, দোকানের ওপর হোক বেসরকারী বিশ্ববিদ্যালয় চালু রেখেছেন। যদি বেসরকারী বিশ্ববিদ্যালয় আইন-২০১০ পালন করা যেত, তবে প্রশাসনিকভাবে পরিচালনার জন্যে সরকার থেকে কাউকে নিয়োগ দেয়া প্রয়োজন। সর্বশেষ বিবিএস জরিপে দেখা যাচ্ছে, উচ্চতর শিক্ষার্থীদের চাকরির সুযোগ কম। এ জন্য অবশ্য কর্মমুখী শিক্ষার প্রচলনে শিক্ষামন্ত্রী চেষ্টা করছেন-ইউজিসির চেয়ারম্যানও বেশ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছেন। কিন্তু যেসব বিশ্ববিদ্যালয়ের ট্রাস্টিবোর্ড সঠিকভাবে পালন করছে না, তাদের বিরুদ্ধে অবিলম্বে শিক্ষা মন্ত্রণালয় থেকে কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করা দরকার। বেসরকারী মেডিক্যাল কলেজেও শিক্ষার মান যেগুলোতে উন্নত নয় সেগুলোর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া দরকার। যে সমস্ত শিক্ষক, নিজেদের আখের গোছানো বা অবৈধ কর্মকা- করছে তাদের বিরুদ্ধেও ব্যবস্থা দরকার। আর প্রয়োজনে ট্রাস্টি বোর্ডের মালিকরা ঠিকমতো কাজ না করলে কড়া ব্যবস্থা থাকা দরকার। বর্তমান সরকার শেখ হাসিনার স্টেটম্যানসুলভ প্রজ্ঞাগুণে অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা এবং উন্নয়নকে একই সূত্রে গেঁথেছেন। দেশের আপামর কৃষক ও শ্রমিকের কর্মস্পৃহা এবং কর্মোদ্যম দেশকে এগিয়ে নিতে সহায়তা করছে। তবে সরকারের উন্নয়ন কর্মকা-ের ফিরিস্তি তৃণমূল পর্যায় পর্যন্ত পৌঁছাতে হবে। এক্ষেত্রে দলীয় এমপি, বিভিন্ন স্তরের নেতৃবৃন্দের পাশাপাশি আমলাদের বলিষ্ঠ ভূমিকা প্রয়োজন। ছড়িয়ে দিতে হবে গত সাড়ে আট বছরের উন্নয়নের সুফল সমূহ। এ ব্যাপারে কোন ধরনের শৈথিল্য হলে তা আখেরে সরকারেরই ক্ষতি। উন্নয়নের মহাসড়কে যেন গাড়ি সঠিকভাবে চলে সেজন্যে সবাইকে সজাগ থাকতে হবে। বৈদেশিক সহায়তাকে কার্যকর করতে হলে প্রকল্পসমূহ যথাযথভাবে বাস্তবায়ন দরকার। নারীসমতা আনয়নে বাজেটে বেশ কিছু পদক্ষেপ থাকলেও তা যাতে কার্যকর হয় সেদিকে লক্ষ্য রাখা দরকার। এবারের বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচীর আওতায় ৫৭ হাজার কোটি টাকার বৈদেশিক সম্পদ আহরণের প্রস্তাবনা দেয়া হয়েছে। এ প্রকল্পসমূহ যাতে সঠিকভাবে বাস্তবায়িত করা হয় সে জন্য প্রকল্প পরিচালনাকারীদের সতর্ক থাকতে হবে। বাজেটে প্রযুক্তি খাতের উন্নয়নের ওপর গুরুত্ব দেয়া হয়েছে। গ্রামীণ অঞ্চলে গিয়ে দেখেছি ভাল ইংরেজী, অঙ্ক এবং কম্পিউটার প্রশিক্ষিত শিক্ষকের অভাব। এ ব্যবস্থা থেকে উত্তরণের জন্য প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়কে একটি কর্মযজ্ঞ গ্রহণ করতে হবে। কুমিল্লায় আবার যাতে নতুনভাবে বিমান চালু হয় সেটি পিপিপির অধীনে উদ্যোগ নেয়া বাঞ্ছনীয় ছিল। প্রধানমন্ত্রী ময়নামতি বিভাগ ঘোষণা করা সত্ত্বেও লালফিতার দৌরাত্ম্যে কুমিল্লা শহরে বহুল প্রত্যাশিত বিভাগ চালু হতে দেরি হচ্ছে। এক্ষেত্রে বাজেটে বিশেষ বরাদ্দ থাকার প্রত্যাশা ছিল। পেনশন পদ্ধতি সহজ করার কথা বলা হয়েছে। দুদককে শক্তিশালী করতে ১০১ কোটি টাকা দেয়ার কথা বলা হয়েছে- এটি আসলে কতটুকু কাজে লাগবে সে বিষয়ে সংশয়ে না গিয়ে বরং সক্ষমতা বৃদ্ধির জন্যে ১০ কোটি টাকা ব্যয় করা দরকার। রূপরেখা ২০২১ (ভিশন ২০২১)-কে লক্ষ্য রেখে বাজেট প্রণীত হয়েছে। তবে প্রকল্প বাস্তবায়নের অধিকতর সচেতনতা কাম্য। যে প্রকল্পের কাজ শুরু হওয়ার কথা ১ জুলাই বিভিন্ন আমলাতান্ত্রিক জটিলতার কারণে এবং অর্থাভাবে অনেক দেরি হয়। এ অব্যবস্থা যাতে দূর করা যায় সে জন্যে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে সচেতন হতে হবে। আশা করি বাজেট বাস্তবায়নের চ্যালেঞ্জ সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিবর্গ গ্রহণ করে তা বাস্তবায়ন করবেন। লেখক : শিক্ষাবিদ ও অর্থনীতিবিদ [email protected]
×