ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

বেহাল বায়স্কোপ

প্রকাশিত: ০৪:০৩, ৪ জুন ২০১৭

বেহাল বায়স্কোপ

সে এক সময় ছিল ‘বায়স্কোপ’-এর। তারও আগে ‘সিনেটকিজ’ মাতিয়ে রেখেছিল দর্শক। ‘ছায়াচিত্র’ তখন ছিল নির্বাক। ছবি নড়াচড়া করত, কিন্তু সবই নির্বাক। নির্বাক যুগ পেরিয়ে সিনেমা বা চলচ্চিত্র সবাক যুগে পৌঁছে ব্যাপক দর্শকের মধ্যে প্রভাব ফেলতে কসুর করেনি। দর্শক মনোরঞ্জনের কথা মাথায় রেখে নির্মিত হতো ‘টকি’ বা ‘সিনেমা’। প্রেক্ষাগৃহগুলো দর্শকে থাকত ভরপুর। মর্নিং শো, ম্যাটিনী শো, ইভিনিং শো, নাইট শো হত্।ো দর্শক তার সময় ও সুযোগ অনুযায়ী টিকেট কেটে হলে প্রবেশ করত। কারিগরি দুর্বলতা, নির্মাণশৈলীর অদক্ষতা অনেক ক্ষেত্রে থাকলেও মৌলিক গল্পের বিস্তার, কাহিনীতে টানটান উত্তেজনা দর্শককে বিমোহিত করত। গত শতকের পঞ্চাশ-ষাটের দশকে ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে ম্যাটিনী শোয়ে মহিলা দর্শকই হতো বেশি। দুুপুরের আগে খেয়েদেয়ে তারপর দলবেঁধে সিনেমা দর্শনের বিষয়টি অনেকেরই স্মৃতিচারণে মেলে। ছবি জনপ্রিয় হলে টিকেট মিলত কালোবাজারে। তারপর সময় গড়িয়ে সিনেমায় আধুনিক প্রযুক্তির ছোঁয়া লাগতে শুরু করে। দেশজুড়ে বাড়তে থাকে প্রেক্ষাগৃহের সংখ্যা। চলচ্চিত্রের প্রচার পত্রিকার পাতা হয়ে পাঠক দর্শককে টেনে নিত প্রেক্ষাগৃহে। গত শতকের আশির দশকে ভিসিআর চালু হওয়ার পর দর্শক প্রেক্ষাগৃহবিমুখ হতে থাকে। ঘরে বসেই যখন খুশি তখন সিনেমা দেখার মধ্যে আনন্দ-বিনোদন খুঁজে নেয়া হতো। আর দর্শক হ্রাস পেতে থাকায় সিনেমার মানও নামতে থাকে। মৌলিক গল্পের অভাব হয়ে ওঠে তীব্র। নকল চলচ্চিত্রে বাজার ছেয়ে যায়। তার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে অশ্লীলতা। দর্শক আকর্ষণের জন্য সিনেমার কাহিনীর সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ নয় এমন সব ‘কাটপিস’ জুড়ে দেয়া হতো, যা পর্নোগ্রাফির নামান্তর। ক্রমান্বয়ে স্যাটেলাইট টিভি চালু এবং তাতে সিনেমা প্রদর্শনের কারণে প্রেক্ষাগৃহগুলো বন্ধ হয়ে যেতে থাকে দর্শকের অভাবে। অবশ্য প্রেক্ষাগৃহগুলোর পরিস্থিতিরও দিন দিন অবনতি ঘটে। সপরিবারে সিনেমা দেখার পরিবেশও লুপ্তপ্রায় ততদিনে। এই করুণ অবস্থায় বাংলাদেশের চলচ্চিত্র প্রায় মুখ থুবড়ে পড়ে। চলচ্চিত্রের দুর্বল দশায় একে একে বন্ধ হতে থাকে প্রেক্ষাগৃহ। শিল্প হিসেবে চলচ্চিত্রের বিকাশ ঘটার পথটি হয়ে পড়ে ভঙ্গুর। মধ্যবিত্ত হলবিমুখ হওয়ায় লগ্নিকারকরা চলচ্চিত্রে বিনিয়োগে অনাগ্রহী হয়ে পড়ে। আর যেসব সিনেমা নির্মিত হতে থাকে তার মান ক্রমশ নিম্নমুখী হবার কারণে দর্শক মুখ ফিরিয়ে নিতে থাকে। সঙ্কটে আবর্তিত হতে থাকে ঢাকাই সিনেমা। বলা হয়, সিনেমা হলের পরিবেশ ও যথাযথ ব্যবস্থাপনার অভাবে দর্শক হ্রাস পেয়েছে। এটা অবশ্য একদিকে। কিন্তু দুর্বল গল্প, কারিগরি অদক্ষতা, নির্মাণশৈলীর দুর্বলতায় সিনেমার যে হাল দাঁড়ায় তাতে দর্শক বিমুখ হওয়াটাই স্বাভাবিক। আর বর্তমান ডিজিটাল ও নেটের যুগে ঘরে বসেই যেখানে বিশ্বের সব দেশেরই উন্নতমানের সিনেমা দেখার সুযোগ রয়েছে, সেখানে দেশী বস্তাপচা কিংবা রদ্দিমার্কা অথবা কুরুচিপূর্ণ সিনেমা দেখার জন্য দর্শক প্রেক্ষাগৃহে কেন যাবেন? যারা ঢাকাই ছবি দেখতে পছন্দ করত, হল উপচে পড়ত যাদের ভিড়ে, তারাও আর প্রেক্ষাগৃহমুখী হয় না তেমন। তবু মাঝে মাঝে কিছু ভাল মানের ছবি তৈরি হয় তরুণদের হাতে, কিন্তু সেসবের দর্শকও সীমিত। চলচ্চিত্র হচ্ছে গণমাধ্যমের সবচেয়ে বড় মাধ্যম। বিশাল জনগোষ্ঠীকে প্রভাবিত করার সহজ মাধ্যম। দেশ প্রযুক্তিগতভাবে অনেক এগিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু চলচ্চিত্র সেক্ষেত্রে পিছিয়ে আছে। অনেক প্রেক্ষাগৃহ যদিও আধুনিকায়ন হয়েছে, কিন্তু তার দর্শক সীমিত। কোন্ প্রেক্ষাগৃহে কোন্ সিনেমা প্রদর্শিত হচ্ছে তা জানার সহজ উপায় আর নেই। এখন আর সংবাদপত্রে বিজ্ঞাপন ছাপা হয় না। ঘোড়ার গাড়ির প্রচারণাও নেই। আর নেট ঘেঁটেও জানা যায় না কোন্ হলে কি ছবি। বাংলাদেশের চলচ্চিত্র শিল্প এক ধরনের মুমূর্ষু অবস্থায়। এর থেকে উত্তরণ জরুরী। যদিও চলচ্চিত্র নীতিমালা প্রণীত হয়েছে, তা যথাযথ কার্যকর করার উপরই নির্ভর করছে এর ভবিষ্যত।
×