ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

ইলিশের অপেক্ষায় জেলেরা

প্রকাশিত: ০৭:০৮, ৩ জুন ২০১৭

ইলিশের অপেক্ষায় জেলেরা

গত বছর সাগরে ধরা পড়েছে দেদার ইলিশ। বর্ষার পুরোটা সময় জেলেদের ইলিশ শিকারে ব্যস্ততা ছিল তুঙ্গে। দেনা পরিশোধ করে জেলেরা দেখেছে লাভের মুখ। আবারও বছর ঘুরে আসছে বর্ষা। প্রজননের উদ্দেশ্যে গভীর সাগর থেকে ছুটে আসবে ঝাঁকে ঝাঁকে ইলিশ। পানির বুকে ছড়িয়ে পড়বে রূপালি ঝিলিক। শুরু হবে নদী-সাগরে ইলিশ ধরা। চাঙ্গা হয়ে উঠবে ইলিশনির্ভর অর্থনীতি। এমন আশায় পটুয়াখালীর দক্ষিণের জেলেপাড়াগুলো হয়ে উঠেছে কর্মচঞ্চল। ঘাটে ঘাটে পড়ে গেছে নৌকা বানানোর ধুম। কাঠমিস্ত্রি আর কারিগরদের নেই দম ফেলার সময়। রাতদিন তাদের হাতুড়ি-বাটালে উঠছে ঠুক ঠুক আওয়াজ। এমনই এক অন্য রকমের কর্মযজ্ঞে মেতে উঠেছে জেলেপল্লী। এক সময়ে দক্ষিণের জেলা পটুয়াখালী অঞ্চলে ইলিশের তেমন একটা দেখা মিলত না। ইলিশ প্রায় অদৃশ্য হয়ে উঠেছিল। ইলিশের নির্বিঘœ প্রজনন ও জাটকা সংরক্ষণ কর্মসুচীসহ সরকারী-বেসরকারী নানা উদ্যোগ-আয়োজনে গত কয়েক বছর ধরে ইলিশের উৎপাদন ব্যাপকহারে বেড়েছে। বিশেষ করে গত বর্ষা মৌসুমে জেলেদের জালে আশাতীত ইলিশ ধরা পড়ে। দক্ষিণের জেলেদের বিশ্বাস-আসছে বর্ষায় গত বারের চেয়েও বেশি ইলিশ ধরা পড়বে। উপকূলীয় উপজেলা রাঙ্গাবালীর কোড়ালিয়া লঞ্চঘাট সংলগ্ন আগুনমুখা নদীর পাড়ে দেখা গেল কাঠমিস্ত্রীরা ইলিশ শিকারের জন্য নতুন নৌকা ও ট্রলার নির্মাণে ব্যস্ত সময় পার করছে। এসময় কথা হয় ট্রলার নির্মাণের কারিগর গোপাল মিস্ত্রির সঙ্গে। ভোলার দৌলতখান উপজেলার চরপাতা ইউনিয়নের নলগোড়া গ্রাম থেকে গোপাল মিস্ত্রি রাঙ্গাবালীতে এসেছেন শুধুমাত্র নৌকা ও ট্রলার নির্মাণের জন্য। সঙ্গে নিয়ে এসেছেন আরও ১২ সহযোগী। গোপাল মিস্ত্রি জানান, গত বছরের আশ্বিন মাসের শেষ দিকে তারা এ অঞ্চলে এসে ট্রলার নির্মাণের কাজ শুরু করেছেন। যা চলবে আগামী ৩০ জ্যৈষ্ঠ পর্যন্ত। এরমধ্যে নির্মাণ কাজ শেষ করে জেলেরা তাদের ট্রলার বুঝে নেবে। এ বছর এরইমধ্যে তিনি ১১টি ছোট ট্রলার ও একটি বড় ট্রলার নির্মাণ করেছেন। হাতে আরও কয়েকটি নৌকা তৈরির বায়না রয়েছে। নৌকা ও ট্রলার তৈরির কাঠমিস্ত্রিদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেল, বর্তমানে পটুয়াখালীর দক্ষিণের সাগরপারের এলাকাগুলোতে বড় নৌকা ও ট্রলার তৈরির হিড়িক পড়েছে। আগে এ অঞ্চলের জেলেরা ইলিশ শিকারে ছোট নৌকা ব্যবহার করতো। এখন তৈরি হচ্ছে ইঞ্জিনচালিত বড় নৌকা। যা ট্রলার হিসেবে পরিচিতি লাভ করেছে। একটি ৩৮ ফুটের ছোট ট্রলার নির্মাণসহ অন্যান্য সরঞ্জাম নিয়ে নদীতে নামতে অন্তত ১২ থেকে ১৫ লাখ টাকা ব্যয় হয় এবং সাড়ে ৪২ ফুটের সমুদ্রগামী বড় ট্রলার নির্মাণে ব্যয় হয় ২০ থেকে ২২ লাখ টাকা। কাঠমিস্ত্রিরা ছোট ট্রলারে দেড় থেকে দুই লাখ টাকা এবং বড় ট্রলারে আড়াই থেকে তিন লাখ টাকা মজুরি পায়। গোপাল মিস্ত্রি বলেন, কয়েক বছর ধরে এ অঞ্চলে প্রচুর ইলিশ ধরা পড়ছে। তাই এ বছর জেলেরা নতুন ট্রলার নির্মাণে বেশি আগ্রহী। গোপাল মিস্ত্রির কাছে বড় ট্রলার নির্মাণের কাজ দিয়েছেন জাহাঙ্গীর মাঝি। তিনি তাঁর ট্রলারটির নির্মাণ কাজ তদারকি করছিলেন। এক ফাঁকে জাহাঙ্গীর মাঝি বলেন, গত বছর গভীর সাগরে প্রচুর ইলিশ ধরা পড়েছিল। তাই আসন্ন মৌসুমে গভীর সাগরে ইলিশ ধরতে বড় ট্রলার তৈরি করতে দেয়া হয়েছে। ইতোমধ্যে ট্রলার নির্মাণ ৮০ ভাগ কাজ শেষ হয়েছে। শুধু কোড়ালিয়া নয়, মৌডুবির নিজকাটা, কাজীকান্দা, চালিতাবুনিয়ার গরুভাঙ্গা, রাঙ্গাবালী ইউনিয়নের খালগোড়া, গহিনখালী, কাউখালী, ভূঁইয়ারহাওলা, গলাচিপার আমখোলা, পক্ষিয়া, উলানিয়া, বদনাতলীসহ বহু ঘাটেই নৌকা-ট্রলার তৈরির অস্থায়ী ডক গড়ে উঠেছে। এ সমস্ত ডকে শত শত নৌকা ও ট্রলার তৈরি হচ্ছে। ডকগুলোতে কাঠমিস্ত্রিদের এখন ব্যস্ত সময় কাটছে। নৌকা ও ট্রলার তৈরির হিড়িক প্রসঙ্গে মৎস্যবন্দর আলীপুর-কুয়াকাটা মৎস্য ব্যবসায়ী ও ট্রলার মালিক সমিতির সভাপতি আনছার মোল্লা জানান, ইলিশ সম্পদ রক্ষায় সরকারের পদক্ষেপের সুফল জেলে ও ব্যবসায়ীরা পেতে শুরু করেছে। ইলিশের উৎপাদন বেড়ে যাওয়ায় জেলেরাও ইলিশ শিকারের জন্য বড় ট্রলার নির্মাণের দিকে ঝুঁকে পড়েছে। সমিতির হিসাব অনুয়ায়ী জেলায় ইলিশ শিকারে ছোট-বড় মিলিয়ে মোট তিন হাজার ট্রলার ছিল। গত দুই বছরে এ সংখ্যা বেড়ে দ্বিগুণ হয়েছে। এ বছর আরও বাড়বে। মহিপুর মৎস্য বন্দরের মৎস্য ব্যবসায়ী সমিতির সাধারণ সম্পাদক নিমাই চন্দ্র দাস বলেন, ইলিশের নির্বিঘœ প্রজনন ও জাটকা সংরক্ষণের পরিকল্পনা নেয়ায় দেশে ইলিশের উৎপাদন বেড়েছে এবং আসছে মৌসুমেও জেলেদের জালে প্রচুর ইলিশ ধরা পড়বে বলে আশা করা হচ্ছে। তিনি আরও জানান, ইলিশ উৎপাদন বাড়লে শুধু জেলে ও মৎস্য ব্যবসায়ীরাই নয়, ইলিশ রফতানি করেও সরকার প্রচুর বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনে সক্ষম হবে। এ প্রসঙ্গে সিনিয়র মৎস্য কর্মকর্তা অঞ্জন বিশ্বাস জানান, বর্ষা মৌসুম সামনে রেখে নৌকা ও ট্রলার নির্মাণে কেবলমাত্র পটুয়াখালী জেলার রাঙ্গাবালী ও গলাচিপা এলাকায় অন্তত দু’শ’ কোটি টাকা বিনিয়োগ হচ্ছে। সমগ্র জেলায় এর পরিমাণ পাঁচ শ’ কোটি টাকা। যা এ খাতের জন্য আশাব্যঞ্জক। খাতটি যে ক্রমে লাভজনক ও বিনিয়োগযোগ্য হয়ে উঠছে, এটি তার প্রমাণ। মাছের রাজা ইলিশ নিয়ে বাঙালীর গর্ব অন্তহীন। শুধু স্বাদ গন্ধ কিংবা এর অর্থনীতি নয়। ইলিশ ধরা নিয়েও রয়েছে জেলেদের গর্ব। প্রকৃত ইলিশ শিকারী জেলেরা সারা বছর বর্ষা মৌসুমের জন্য অপেক্ষা করে। বর্ষার নতুন পানির ঢেউয়ে গভীর সাগর থেকে উঠে আসে ঝাঁকে ঝাঁকে ইলিশ, অপেক্ষাকৃত মিঠাপানিতে প্রজননের উদ্দেশ্যে। একটা সময়ে দেশের অভ্যন্তরীণ নদ-নদীগুলোতে প্রচুর পরিমাণে ইলিশ ধরা পড়ত। কিন্তু ডুবোচর ও পরিবেশ বিপর্যয়সহ বিভিন্ন কারণে এখন আর আগের মতো অভ্যন্তরীণ নদ-নদীতে তেমন ইলিশ ধরা পড়ে না। বেশিরভাগ ধরা পড়ে সাগর এবং উপকূলের নদ-নদীতে। তাই উপকূলের ইলিশ নির্ভর মানুষের বর্ষার আগ মুহূর্তে ব্যস্ততা থাকে তুঙ্গে। নৌকার পাশাপাশি জাল, রসদ সংগ্রহ, পুঁজির যোগানসহ বিভিন্ন কাজে জেলেরা সময় পার করে ব্যস্ততায়। জেলেদের পাশাপাশি আড়তদার-মহাজন, ফড়িয়া, ব্যবসায়ীসহ বরফমিলের মালিকরাও ব্যস্ত হয়ে পড়ে। বর্ষার চার-পাঁচ মাসে গোটা বছরের আয় নির্ভর করে। তাইতো এ মুহূর্তে উপকূলের কয়েক লাখ মানুষ চোখে অন্য রকমের স্বপ্ন নিয়ে কাটাচ্ছে ব্যস্ততায়। -শংকর লাল দাশ, গলাচিপা থেকে
×