ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১০ বৈশাখ ১৪৩১

প্রশান্ত অধিকারী

তারাকান্দর গণহত্যার ঘটনা আজও উপেক্ষিত

প্রকাশিত: ০৬:২৮, ৩ জুন ২০১৭

তারাকান্দর গণহত্যার ঘটনা আজও উপেক্ষিত

গোপালগঞ্জ জেলার কোটালীপাড়া উপজেলার কান্দি ইউনিয়নের একটি গ্রাম তারাকান্দর। গ্রাম নয় বরং বলা যেতে পারে কোটালীপাড়ার বৃহত্তর বধ্যভূমি। ১৯৭১ সালে কোটালীপাড়ার একাধিক গ্রামে পাকবাহিনীর সঙ্গে মুখোমুখি যুদ্ধ হলেও এ গ্রামের মতো এত মানুষের আত্মাহুতি দিতে হয়নি কোথাও। অথচ স্বাধীনতার ৪৬ বছর পরও এ গ্রামের গণহত্যার ইতিহাস কেউ জানে না। ইতিহাসের পাতায় ঠাঁই পায়নি সে সব ঘটনা। ১৯৭১ সালের মে মাস। বাংলা ১৯ জ্যৈষ্ঠ। মঙ্গলবার। দেশজুড়ে চলছে যুদ্ধের প্রস্তুতি। কান্দি ইউনিয়নের মানুষও বসে নেই। তাই পাকবাহিনী ও তাদের এদেশীয় দোসরদের বিরুদ্ধে প্রস্তুতি নেয় যুদ্ধের। দেশীয় অস্ত্রশস্ত্রে সজ্জিত হয়ে তারা তারাকান্দর বালা বাড়ি প্রতিরোধ শিবির গড়ে তোলে। স্থানীয় লোকের পাশাপাশি বিভিন্ন স্থান থেকে আশ্রয় নিতে আশা নারী-পুরুষ নির্বিশেষে ওই বাড়িতে তাঁবু খাটিয়ে আশ্রয় নেয়। এ খবর যায় পার্শ্ববর্তী গোপালপুর-পূর্ণবতী-কুরপালা-কাকডাঙা গ্রামের রাজাকার আলবদরদের কাছে। তারা জানে যে শুধু তারা এসে এ প্রতিরোধ যুদ্ধে টিকতে পারবে না। তাই পাকবাহিনীকে সঙ্গে নিয়ে তিন দিন বসে পরিকল্পনা করে তারাকান্দর আক্রমণের। ১৯ জ্যৈষ্ঠ মঙ্গলবার সকাল বেলা কোটালীপাড়া থানা থেকে তিনটি গানবোটে ঘাঘর নদী দিয়ে ১১ জন পাক আর্মি গোপালপুর আসে। সেখানে পাকিস্তানের পতাকা উড়িয়ে অপেক্ষা করছিল পাকিদের স্থানীয় দোসর রাজাকার আহমদ চেয়ারম্যান, আফতাব উদ্দিন [আপ্তু মিয়া], বারেক মাস্টার, সোবহানসহ আরও অনেকে। তাদের ইশারায় পাক বাহিনী প্রস্তুতি নেয় তারাকান্দর আক্রমণের। এক পর্যায়ে ভারি মেশিনগানের গুলি ও মর্টার শেল ছুড়তে থাকে তারাকান্দরের দিকে। মাত্র এক কিলোমিটার ব্যবধানে প্রতিরোধ গড়ে তোলা সহস্রজনতা ভারি অস্ত্রশস্ত্রের গুলি ও শব্দে ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে পড়ে। পাকবাহিনীর ভারি অস্ত্রের সামনে আর টিকতে না পেরে পিছু হটতে বাধ্য হয়। এই সুযোগে স্থানীয় রাজাকার, আলবদররা পাকবাহিনীকে সঙ্গে নিয়ে ঢুকে পড়ে তারাকান্দর গ্রামে। সহস্রাধিক মানুষ যে যেভাবে পারে আশ্রয় নেয় ডোবায়, ঝোঁপঝাড়ে, পুকুরে কচুরিপানার মধ্যে। সেখানে পালিয়েও বাঁচতে পারেনি তারা। পাকবাহিনীকে সঙ্গে নিয়ে তাদের নির্মমভাবে কুপিয়ে কুপিয়ে হত্যা করে পাকিদের দোসররা। প্রতিরোধকারী যোদ্ধাদের ফেলে আসা রাম দা, কুড়াল দিয়ে শতাধিক আবালবৃদ্ধবনিতাকে হত্যা করে পাকবাহিনী ও তাদের দোসররা। বেলা ১১টায় শুরু করে সন্ধ্যা পর্যন্ত নারকীয় হত্যাযজ্ঞে শহীদ হন শতাধিক নারী-পুরুষ, শিশু ও বৃদ্ধ। কেউ কেউ মনে করেন সে সংখ্যাটা দু’শ’র অধিক হবে। পাক হানাদারদের সেই নির্মম নৃশংসতার নীরব সাক্ষী পুরো তারাকান্দর গ্রাম, বিস্তীর্ণ ফসলের মাঠ। সেই ঘটনার সাক্ষী ও মৃত্যুর হাত থেকে বেঁচে যাওয়া যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধা জগদীশ বৈদ্য দীর্ঘদিন রোগভোগের পর গত বছর মারা গেছেন। সেই যুদ্ধের একজন অকুতোভয় যোদ্ধা ছিলেন জগদীশ বৈদ্য। তখন ছিলেন ৩০ বছরের টগবগে তরুণ। শত্রুর ভারি অস্ত্রের আঘাতে ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে ঐদিন আশ্রয় নিয়েছিলেন একটা কচুরিপানা ভর্তি ডোবার মধ্যে। তার এক হাতে রাম দা অন্য হাতে কালি। মনে মনে প্রতিজ্ঞায় অবিচল। মরার আগে একটা শত্রু হলেও খতম করবেন। কিন্তু তা পারেননি। তার আগেই শত্রুরা তাকে দেখে ফেলে। সঙ্গে সঙ্গে গুলি করে। কিন্তু গুলি যায় মাথার ওপর দিয়ে। একই সঙ্গে কালি দিয়ে উপর্যুপরী কুপিয়ে, মৃত্যু নিশ্চিত জেনে তারা চলে যায়। কিন্তু সৌভাগ্যক্রমে কালির ৩৪টি কোপ খেয়েও বেঁচে যান জগদীশ বৈদ্য। ভয়াল সেই দিনের কথা কাউকে জানাতে চাননি কখনও। কারণ পঁচাত্তরে বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যার পর পার্শ¦বর্তী এলাকার রাজাকার আলবদররা তাকে নানাভাবে ভয়ভীতি ও হুমকি দিতে শুরু করে। জীবনের নিরাপত্তার জন্য পৈত্রিক ভিটেমাটি ছেড়ে যশোরের বসুন্দিয়া আশ্রয় নেন। দীর্ঘদিন মানবেতর জীবনযাপন করার পর সেখানেই তার মৃত্যু হয়। মৃত্যুর আগের মুক্তিযোদ্ধার স্বীকৃতি চেয়েছিলেন। কিন্তু তা পাননি। তারাকান্দর গ্রামের আরেক প্রত্যক্ষদর্শী সত্তরোর্ধ নটোর রায় তাদের বাড়ির সামনের একটি ঘটনা উল্লেখ করে বলেন, ‘আমাদের বাড়ির সামনে পুকুরের দক্ষিণ-পশ্চিম পাশে পাকিস্তানী আর্মি রাজাকারদের তাড়া খেয়ে একটা ডোবার মধ্যে পালিয়েছিল ৯জন। তাদের কাউকে গুলি করে, কাউকে কুপিয়ে, চোখ তুলে নানাভাবে নির্যাতন করে হত্যা করে পাকবাহিনী ও তাদের দোসররা। তাদের মধ্যে ডহরপাড়া গ্রামের নরেন দাঁড়িয়া [সমদ্দার] , তার স্ত্রী, মা এবং চিন্তা দাঁডিয়া ও তার ছেলে ছিল। এছাড়া ছিল দরশন রায়, তার স্ত্রী ও মেয়ে এবং মনোমোহন রায়ের ছেলে হরলাল রায়।’ সেই ভয়াল দৃশ্যের কথা এখনও মনে পড়লে যেন আঁৎকে ওঠেন তিনি। তারাকান্দর ও পার্শ্ববর্তী গ্রামের প্রত্যক্ষদর্শীদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, তারাকান্দর খালের পশ্চিম পাড়ে বিষ্ণু রায়ের স্ত্রীকে গুলিবিদ্ধ অবস্থায় মৃত পাওয়া যায়। এভাবে তারাকান্দর বৈদ্য বাড়ি, রায় বাড়ি, বিশ্বাস বাড়ির দক্ষিণ পাশে মাঠে ও পুকুর পাড়ে সারি সারি লাশ দেখা যায়। দেশ স্বাধীন হয়েছে ৪৬ বছর। অথচ জগদীশ বৈদ্যরা মুক্তিযোদ্ধার স্বীকৃতি না পেয়ে মারা যাচ্ছেন। এ লজ্জা কার? জগদীশ বৈদ্যর মতো সেই দিনের সেইসব শহীদের কথা কেউ মনে রাখেনি। এই দিনে তাদের স্মরণ করা তো দূরের কথা তারাকান্দর এই গণহত্যার কথা অনেকে জানেনও না। এমনকি তাদের নাম ঠাঁই পায়নি ইতিহাসেও। গোপালগঞ্জ জেলার মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস নিয়ে বিভিন্ন পর্যায়ে ব্যক্তি ও সরকারী প্রতিষ্ঠানের উদ্যোগে বই প্রকাশিত হলেও সেখানে তারাকান্দর গণহত্যার ঘটনা অনেকটা পাশ কাটিয়ে যাওয়া হয়েছে। আজ পর্যন্ত শহীদদের নামে কোন স্মৃতিফলক নির্মিত হয়নি। এমনকি শহীদদের তালিকা প্রণয়ন ও তাদের স্মৃতি সংরক্ষণ করার ব্যাপারেও উদ্যোগ নেয়নি কোন ব্যক্তি, প্রতিষ্ঠান বা স্থানীয় প্রশাসন। স্থানীয় মানুষের দাবি-এসব শহীদের স্মৃতির প্রতি সম্মান জানিয়ে শহীদদের তালিকা খুঁজে বের করে একটি স্মৃতিফলক নির্মাণ করা হোক। মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের সরকার রাষ্ট্রক্ষমতায়। সরকারের প্রধান ব্যক্তি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এই এলাকার সংসদ সদস্য। মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয় বিভিন্ন বধ্যভূমি ও গণকবর সংরক্ষণের উদ্যোগ নিয়েছে। অথচ আজ পর্যন্ত কোটালীপাড়ার বৃহত্তর গণহত্যার স্মৃতি সংরক্ষণে কারও তেমন কোন ভূমিকা চোখে পড়েনি। এই এলাকার মানুষ কোন কিছু হলে তাকিয়ে থাকেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দিকে। প্রধানমন্ত্রী আপনি কি আপনার প্রিয় কান্দি ইউনিয়নের মানুষের এই সামান্য দাবি পূরণ করবেন? লেখক : সাংবাদিক ও সংস্কৃতিকর্মী [email protected]
×