ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১

রাজধানীতে বিএনপির কার্যক্রম চাঙ্গা হচ্ছে না

ঢাকা মহানগরে কমিটি পুনর্গঠনে খালেদার নির্দেশ উপেক্ষিত

প্রকাশিত: ০৬:১৬, ৩ জুন ২০১৭

ঢাকা মহানগরে কমিটি পুনর্গঠনে খালেদার নির্দেশ উপেক্ষিত

শরীফুল ইসলাম ॥ ঢাকা মহানগর বিএনপির নতুন কমিটিও দলের চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়ার নির্দেশ মেনে নির্ধারিত সময়ে থানা, ওয়ার্ড ও ইউনিয়ন কমিটি পুনর্গঠন করতে পারেনি। তাই ইউনিট কমিটি পুনর্গঠনে আগের মতো এবারও খালেদা জিয়ার নির্দেশ উপেক্ষিত। আর এখনও ইউনিট কমিটি পুনর্গঠন করতে না পারায় রাজধানীতে বিএনপির কার্যক্রম চাঙ্গা করতে পারছে না দলটি। তবে আসন্ন ঈদের পর ঢাকা মহানগরীর সকল ইউনিট কমিটি পুনর্গঠনের কাজ শেষ করতে দলের দুই সিনিয়র নেতা মির্জা আব্বাস ও সাদেক হোসেনের অনুসারীদের সঙ্গে বর্তমান কমিটির নেতারা ঘন ঘন বৈঠক করছেন। উল্লেখ্য, ১৮ এপ্রিল বিএনপির নির্বাহী কমিটির সদস্য হাবিব-উন-নবী খান সোহেলকে সভাপতি ও কাজী আবুল বাশারকে সাধারণ করে ৭০ সদস্যের ঢাকা মহানগর দক্ষিণ কমিটি অনুমোদন করেন দলের চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়া। আর এম এ কাইয়ুমকে সভাপতি ও আহসানউল্লাহ হাসানকে সাধারণ সম্পাদক করে ৬৬ সদস্যের ঢাকা মহানগর উত্তর কমিটি অনুমোদন করা হয়। দক্ষিণ ও উত্তরের এই কমিটিতে ১ মাসের মধ্যে ঢাকা মহানগরীর প্রতিটি থানা, ওয়ার্ড ও ইউনিয়ন কমিটি গঠন করে এসব কমিটি বিএনপি কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে জমা দিতে বলা হয়। কিন্তু নির্ধারিত এক মাসের জায়গায় দেড় মাস সময় পার হয়ে গেলেও এসব ইউনিট কমিটি গঠন করতে পারেনি ঢাকা মহানগর কমিটি। জানা যায়, ঢাকা মহানগর বিএনপির বর্তমান কমিটিতে আগের মতোই খোকা গ্রুপ প্রাধান্য রয়েছে। প্রথমবারের মতো ঢাকা মহানগর উত্তর ও দক্ষিণ এ ২ ভাগে ভাগ করে দেয়া কমিটির শীর্ষ ৪ পদের সবাই দলের কেন্দ্রীয় ভাইস চেয়ারম্যান সাদেক হোসেন খোকার অনুসারী। আর অন্যান্য পদেও রাজধানীর দলীয় রাজনীতিতে খোকার প্রতিপক্ষ ও দলের স্থায়ী কমিটির সদস্য মির্জা আব্বাসের অনুসারী অপেক্ষাকৃত কম। ঢাকার রাজনীতিতে খোকার প্রতিপক্ষ মির্জা আব্বাস চাইছেন ইউনিট কমিটিগুলোতে নিজের প্রাধান্য ধরে রাখতে। তাই তিনি মহানগরীর বর্তমান কমিটিকে চাপে রেখেছেন। তবে দুই মহানগর কমিটির শীর্ষ নেতারা মির্জা আব্বাস ও সাদেক হোসেন খোকা উভয় পক্ষের নেতাকর্মীদের খুশি রেখে ইউনিট কমিটিগুলো করতে চাচ্ছেন। আর এ জন্যই বেশি সময় লাগছে বলে জানা গেছে। এদিকে অপেক্ষাকৃত তরুণ নেতাদের প্রধান্য দিয়ে গঠিত ঢাকা মহানগর বিএনপির নতুন কমিটিকে দলের সাধারণ নেতাকর্মীরা ইতিবাচক হিসেবে নিলেও এ কমিটির শীর্ষস্থানীয় অধিকাংশ নেতার বিরুদ্ধে মামলা থাকায় তারা সঠিকভাবে দায়িত্ব পালন করতে পারছেন না। বিশেষ করে ২০১৫ সালের টানা ৯২ দিনের অবরোধ কর্মসূচী চলাকালে রাজধানীতে বিভিন্ন নাশকতামূলক ঘটনার পর যেসব মামলা হয়েছে ঢাকা মহানগর বিএনপির নতুন কমিটির অধিকাংশ নেতা সেসব মামলার আসামি। নির্ধারিত সময়ে ইউনিট কমিটি গঠন করতে না পারার এটিও একটি কারণ বলে দলের নেতারা মনে করছেন। এর আগে ২০১৪ সালের ১৮ জুলাই মির্জা আব্বাসকে আহ্বায়ক ও হাবিব-উন-নবী খান সোহেলকে সদস্য সচিব করে ঢাকা মহানগর বিএনপির ৫২ সদস্যের আহ্বায়ক কমিটি গঠন করেন বিএনপি চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়া। এই আহ্বায়ক কমিটিকে এক মাসের মধ্যে ওয়ার্ড ও থানা কমিটি গঠন করে পরবর্তী এক মাসের মধ্যে সম্মেলন করে মহানগরের পূর্ণাঙ্গ কমিটি গঠনের সময়সীমা বেঁধে দেয়া হয়। কিন্তু মির্জা আব্বাস ও সাদেক হোসেন খোকা অনুসারীদের কোন্দলের কারণে ঢাকা মহানগরে অধিকাংশ থানা এবং ওয়ার্ডের কমিটি গঠন করতে পারেনি ওই আহ্বায়ক কমিটি। তাই বাধ্য হয়েই বিএনপি চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়া সম্মেলন ছাড়াই ৩ বছর পর ওই কমিটি বাদ দিয়ে নতুন কমিটি গঠন করা হয়। ঢাকা সিটি কর্পোরেশন উত্তর ও দক্ষিণে বিভক্ত হয়ে পড়ায় এবং ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগ ২ ভাগে বিভক্ত করে কমিটি দেয়ায় বিএনপিও এবার ঢাকা মহানগর উত্তর ও দক্ষিণ এ ২ ভাগে ভাগ করে নতুন কমিটি দেয়। ঢাকা মহানগর দক্ষিণ বিএনপির বর্তমান সভাপতি হাবিব-উন-নবী খান সোহেল মির্জা আব্বাসের ঘোর বিরোধী। তিনি ঢাকা মহানগর বিএনপির সদস্য সচিব থাকাকালে আহ্বায়ক মির্জা আব্বাসের সঙ্গে প্রকাশ্যে বিরোধে জড়িয়ে পড়েন। তবে তিনি ঢাকা মহানগর বিএনপির সাবেক সভাপতি সাদেক হোসেন খোকা ও তাঁর অনুসারীদের সঙ্গে ঠিকই যোগাযোগ রাখেন। তাঁর সভাপতি হওয়ার ব্যাপারে খোকার সায় ছিল বলে জানা যায়। যদিও খোকা চেয়েছিলেন বিএনপি চেয়ারপার্সনের উপদেষ্টা আবদুস সালাম যেন মহানগরের সভাপতি পদ পান। তবে বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্র প্রবাসী খোকা যখন বুঝতে পারেন সালাম সভাপতি হতে পারছেন না তখন তার অনুসারীদের সোহেলের পক্ষে থাকার নির্দেশ দেন। হাবিব-উন-নবী খান সোহেল বিএনপি চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়া ও লন্ডন প্রবাসী সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান তারেক রহমানের প্রিয়ভাজন। তিনি এখন মির্জা আব্বাস ও সাদেক হোসেন খোকা এ ২ নেতারাই প্রিয়ভাজন হওয়ার চেষ্টা করছেন বলে জানা গেছে। ঢাকা মহানগর দক্ষিণ বিএনপির সাধারণ সম্পাদক কাজী আবুল বাসার সাদেক হোসেন খোকার অনুসারী। খোকা মেয়র থাকাকালে কাউন্সিলর আবুল বাশার তাঁর ঘনিষ্ঠজন ছিলেন। তবে নতুন কমিটি ঘোষণার আগে আবুল বাশার মির্জা আব্বাসের আশীর্বাদ নিয়েছেন মূলত কমিটির শীর্ষ পদ পেতে। কার্যত তিনি এখনও খোকারই অনুসারী হলেও ইদানিং মির্জা আব্বাসের সঙ্গে সম্পর্ক উন্নয়ন করেছেন। আর এ কৌশলে থাকলেই বর্তমান কমিটি দ্রুত মহানগরীর ইউনিট কমিটি গঠন করতে পারবে বলে মনে করা হচ্ছে। বিএনপির ঢাকা মহানগর উত্তরের নতুন সভাপতি এম এ কাইয়ুম বরাবরই সাদেক হোসেন খোকার অনুসারী। বর্তমানে তিনি পলাতক রয়েছেন। তবে তাঁকে বিএনপি চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়া ও সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান তারেক রহমান পছন্দ করেন। ঢাকা মহানগর উত্তরের নতুন সাধারণ সম্পাদক আহসান উল্লাহ হাসানও সাদেক হোসেন খোকার অনুসারী। তাই ঢাকা মহানগর উত্তরের কমিটিতে মির্জা আব্বাসের তেমন প্রভাব খাটাতে পারছেন না। তবুও বিভিন্ন কৌশলে তিনি ইউনিট কমিটি গঠনে হস্তক্ষেপ করতে চাচ্ছেন। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ঢাকা মহানগর বিএনপির এক নেতা জানান, ইউনিট কমিটি গঠনে প্রধান অন্তরায় ক’জন কেন্দ্রীয় প্রভাবশালী নেতার হস্তক্ষেপ। কারণ তারা সবাই চান নিজেদের অনুসারীদের প্রাধান্য দিয়ে কমিটি করতে। আর তখনই সমস্যা দেখা দেয়। যারা দীর্ঘদিন দলের জন্য ত্যাগ স্বীকার করেছেন তারাই কমিটিতে প্রাধান্য পাবেন এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু যখনই এতে বিঘœ ঘটে তখনই কমিটি পুনর্গঠন অসম্ভব হয়ে পড়ে। আর এ কারণেই দীর্ঘ এক যুগেও ঢাকা মহানগরীর ইউনিট কমিটিগুলো পুনর্গঠন করা যাচ্ছে না। ঢাকা মহানগর বিএনপির আরেক নেতা জানান, ইতোমধ্যেই সম্মেলন ছাড়া কিছু ইউনিট কমিটি গঠন করে রাখা হয়েছে। ঈদের পর এসব কমিটি কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে জমা দেয়া হবে। কেন্দ্রীয় কমিটি অনুমোদন করলে বাকি কমিটিগুলো সম্মেলন করে করার চেষ্টা করা হবে। তা নাহলে ঈদের পর সকল ইউনিট কমিটিই সম্মেলনের মাধ্যমে দ্রুত পুনর্গঠন করার চেষ্টা করা হবে। তবে যেভাবেই হোক দ্রুত ইউনিট কমিটি পুনর্গঠনের ব্যাপারে কেন্দ্র থেকে প্রবল চাপ রয়েছে। কারণ, আন্দোলন শুরুর আগে ঢাকা মহানগরের সকল স্তরের কমিটি পুনর্গঠন করা না গেলে বিএনপি রাজনৈতিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবে।
×