ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

কারিগরি প্রশিক্ষণে বদলে যাচ্ছে লাইলীর মতো বর্জ্যজীবীদের জীবন ধারা

প্রকাশিত: ০৬:১৫, ৩ জুন ২০১৭

কারিগরি প্রশিক্ষণে বদলে যাচ্ছে লাইলীর মতো বর্জ্যজীবীদের জীবন ধারা

জান্নাতুল মাওয়া সুইটি ॥ ১৫ বছরের লাইলী ছোটবেলা থেকে বর্জ্যজীবী শিশু হিসেবে বেড়ে উঠেছে। বাবা-মায়ের দ্বিতীয় সন্তান লাইলী। সে তার বাবা-মা, বড় ভাই ও ছোট বোনের সঙ্গে পাঁচ বছর ধরে মাতুয়াইল ডাম্পিং স্টেশনের পাশে একটি বাড়িতে ভাড়া থাকছে। দারিদ্র্যের কষাঘাতে সে প্রাথমিকের গ-ি পার হলেও পরবর্তীতে আর লেখাপড়া চালিয়ে যাওয়া সম্ভব হয়নি। লাইলীর পরিবার ঢাকা আসার আগে গাইবান্ধা জেলায় বসবাস করত। কিন্তু নদী ভাঙ্গনের ফলে উদ্বাস্তু হয়ে কাজের সন্ধানে ঢাকায় আসতে বাধ্য হয় তারা। ঢাকায় আসার পর লাইলীর বাবা মাতুয়াইল ডাম্পিং স্টেশনে বর্জ্যজীবী হিসেবে ময়লা সংগ্রহ করে জীবিকা নির্বাহ করা শুরু করে। লাইলী ও তার ছোট বোনকে নিয়ে তার মা ঘরেই থাকতেন। তবে, লাইলীর বাবা তাকে মাঝে মধ্যেই ডাম্প সাইটে ময়লা কুড়াতে নিয়ে যেতেন। লাইলীর বয়স যখন ১২, অর্থনৈতিকভাবে পরিবারকে সাহায্য করতে লাইলী বর্জ্যজীবী হিসেবে কাজ শুরু করে। কারণ, এই বয়সে অন্য কোন কাজ খুঁজে পাওয়া তার পক্ষে সম্ভব ছিল না। ময়লা সংগ্রহ করার এই কাজে লাইলী প্রতিদিন ১০ ঘণ্টা খাটত। দিন শেষে তার হাতে আসত ১০০-১৫০ টাকা। লাইলী জনকণ্ঠকে জানায়, ২০১৫ সালে গ্রামবাংলা উন্নয়ন কমিটির মাঠকর্মীরা তাদের বাড়িতে আসে। তাদের কাছ থেকে জানতে পারে গ্রামবাংলা টেকনিক্যাল ট্রেনিং সেন্টারের মাধ্যমে ১৪-১৮ বয়সী বর্জ্যজীবী কিশোরীদের দর্জির কাজ ও মোবাইল সার্ভিসিংয়ের কাজ বিনামূল্যে শেখানো হবে। এর পর সেখানে টেলরিংয়ের প্রশিক্ষণে যোগ দেয়। তার বড় ভাই একটি টেইলার্সে কাজ করত। তখন সে দেখেছে মাত্র একটি কামিজ বানানোর মাধ্যমেই ২০০ টাকা উপার্জন করা যায়। তাই সে সিদ্ধান্ত নেয় দর্জির কাজ শেখার। গ্রামবাংলা টেকনিক্যাল ট্রেনিং সেন্টারে প্রশিক্ষণ নিয়ে লাইলী এখন কামিজ, সালোয়ার, বেবি ফ্রক, প্যান্ট, শার্ট বানাতে পারে। প্রশিক্ষণ শেষে, ২০১৬ সালে গ্রামবাংলা টেকনিক্যাল ট্রেনিং সেন্টারের সহায়তায় লাইলী মাতুয়াইলে বাটা জুতার কারখানায় কাজ শুরু করে। বর্তমানে লাইলী সপ্তাহে ছয় দিন নয় ঘণ্টা করে কাজ করে মাসে উপার্জন করছে ৯ হাজার টাকা। লাইলীর মতে, এখন আমি খুব ভাল আছি। চাকরিটা খুব ভাল। আমি আর কখনও বর্জ্য সংগ্রহের কাজ করতে চাই না। কারণ, আমি জানি বর্জ্যজীবীরা কতটা অস্বাস্থ্যকর পরিবেশের মধ্যে সময় কাটায়। এছাড়া, যারা এই কাজ করে তাদের কেউ সম্মান করে না। আমি এখন কিছু কিছু টাকা জমা করছি। এই টাকা দিয়ে আমি পাঁচটি সেলাই মেশিন কিনব এবং একটি দোকান ভাড়া নেব। আমার স্বপ্ন একটি টেইলার্সের দোকান দেব। যেখানে আমার মতো কয়েকজন কর্মসংস্থানের সুযোগ পাবে। এভাবেই আমি ভাল উপার্জন করে আমার পরিবার নিয়ে সুখে থাকতে চাই। লাইলীর মতো অনেক বর্জ্যজীবী ১৪-১৮ বছর বয়সী কিশোর-কিশোরীকে স্বাবলম্বী করে তুলতে সাহায্য করছে গ্রামবাংলা টেকনিক্যাল ট্রেনিং সেন্টার। এখান থেকে প্রশিক্ষণ নিয়ে এসব কিশোর-কিশোরী অস্বাস্থ্যকর পরিবেশ থেকে মুক্ত হয়ে অন্য যেকোন কাজে যুক্ত হতে পারছে। ৬ মাসের এই টেকনিক্যাল এ্যান্ড ভোকেশনাল এডুকেশন এ্যান্ড ট্রেনিং কোর্সের মাধ্যমে কাগজের ব্যাগ তৈরি, রান্না শেখানো, দর্জির কাজ ও অ্যাম্ব্রয়ডারি, মোটরসাইকেল রিপেয়ারিং এবং সার্ভিসিং, বিউটি পার্লারের কাজসহ মোবাইল ফোন সার্ভিসিংয়ের কাজ শেখানো হয়। ইতোমধ্যেই, ১৫০ কিশোর-কিশোরী এই ট্রেনিং সেন্টার থেকে প্রশিক্ষণ গ্রহণ করে সুস্থ- স্বাভাবিক পরিবেশে কাজ করে তাদের জীবিকা নির্বাহ করতে সক্ষম হচ্ছে। গ্রামবাংলা উন্নয়ন কমিটির নির্বাহী পরিচালক এ কে এম মাকসুদ জনকণ্ঠকে বলেন, মাতুয়াইল ডাম্পিং সাইটে কর্মরত বেশিরভাগ বর্জ্যজীবী পরিবারের সন্তানরা ছোটবেলা থেকে বাবা-মায়ের দেখাদেখি ময়লা সংগ্রহের কাজে যুক্ত হয়। ২০০৮ সাল থেকে আমরা গ্রামবাংলা উন্নয়ন কমিটির মাধ্যমে এসব মানুষের জীবনমান উন্নয়নে কাজ শুরু করি। বর্জ্যজীবী কিশোর-কিশোরীদের সুস্থ পেশায় যুক্ত করার লক্ষ্যে ২০১৫ সাল থেকে গ্রামবাংলা টেকনিক্যাল ট্রেনিং সেন্টার কাজ শুরু করে। ২০১৬ সাল পর্যন্ত ‘চাইল্ড হোপ ইউকে’ এবং বর্তমানে ‘কমিক রিলিফ আইএসএ’র ফান্ডে কাজ করছে গ্রামবাংলা উন্নয়ন কমিটি। শিশুদের ময়লা-আবর্জনা থেকে সরিয়ে অন্য পেশায় যুক্ত করাই আমাদের মূল লক্ষ্য। এজন্য প্রশিক্ষণ শেষের পর আমরা নিজ উদ্যোগেই তাদের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে কথা বলে তাদেরকে কাজে যুক্ত করি।
×