ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১

বগুড়ার গ্রামে টার্কি মুরগি

ময়ূরীর মতো পেখম মেলে নাচে, হাসি ফুটিয়েছে গ্রামবাসীর মুখে

প্রকাশিত: ০৬:১৫, ৩ জুন ২০১৭

ময়ূরীর মতো পেখম মেলে নাচে, হাসি ফুটিয়েছে গ্রামবাসীর মুখে

সমুদ্র হক ॥ প্রত্যন্ত গ্রামে গেরস্ত বাড়ির উঠানে ময়ূরী (!) পেখম মেলেছে। আকাশে মেঘ দেখলে একটু নেচেও উঠছে। দূর থেকে দেখে এমনই মনে হবে। অবাকও হতে হয়-যাক তাহলে বনের ময়ূর গেরস্ত বাড়ির উঠানে এসেছে। কাছে গিয়ে দেখা গেল আসলে তা নয়। ময়ূরীর মতোই ছোট করে পেখম তুলতে পারে এমন এক পাখি। নাম তার টার্কি মুরগি।‘সোনার ডিম’ দেয় এই টার্কি, যা গ্রামের মানুষের মুখে হাসি ফুটিয়েছে। সাধারণ মুরগি থেকে অনেকটা বড় আকৃতির। লালচে ন্যাড়া গলা। একটু উঁচু করে মিটি মিটি তাকায়। নানা রঙের। এই টার্কি মুরগি লালনপালন করে বগুড়ার ধুনটের একটি গ্রামের অন্তত ১০০ পরিবার স্বাবলম্বী হয়েছে। তাদের ঘরে এখন আর অভাব নেই। একজন মাস্টার্স পাস করে চাকরির পেছনে আর না ঘুরে এই টার্কি মুরগি পালন করছেন। একজন গৃহবধূ টার্কি মুরগি পালন করে খামার গড়েছেন। তার খামারে এখন ছোট-বড় দুই লাখ টাকার টার্কি মুরগি আছে। গ্রামের একের দেখাদেখি আরেকজন পালন শুরু করেছে। এভাবে ধুনটের শাকদহ গ্রাম টার্কি মুরগির গ্রাম নামে পরিচিতি পেয়েছে। টার্কি মুরগির বাংলাদেশে আগমন অতিথি হয়ে। বাংলাদেশের মানুষের মন জয় করেছে। অর্থনীতিকে আরও সজীব করেছে। দারিদ্র্যের হার যেটুকু আছে তাও কমিয়ে দিতে পাশে দাঁড়িয়েছে। টার্কি মুরগির ইতিহাস বেশ মজার। এই পাখি ছিল বনে। যখন ইউরোপিয়ানরা প্রথম এই মুরগি দেখলো তখন ভাবলো এক ধরনের বন্য গিনিয়া পাখি। পরে তারা তুরস্ক থেকে মধ্য ইউরোপে এই পাখিটি আনে। আমেরিকাতেও নিয়ে যায়। ১৫৫০ সালে ব্রিটিশ নাবিক উইলিয়াম স্ট্রিক ল্যান্ড তুরস্ক থেকে পাখিটি ইংল্যান্ডে আনেন। পরে দেখা যায় এই পাখিটি হাঁস, মুরগি গোত্রের। তখন লালনপালন করে বংশ বৃদ্ধি ঘটাতে থাকে। সেই থেকে পাখিটি তুরস্কের মুরগি বা টার্কি ফাউল হিসেবে পরিচিতি পায়। এক প্রজাতির বুনো টার্কি উত্তর ও মধ্য আমেরিকার। আদিবাস ইউকাতন উপদ্বীপে। বর্তমানে সারা বিশ্বে এই টার্কি মুরগি গৃহপালিত। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও ব্রিটেনে থ্যাংকস গিভিং ডে ও ছুটির দিনে ডিলিশিয়াস ফুড হিসেবে টার্কি মুরগি ভোজন করা হয়। বন্য টার্কি মেলিয়াগ্রিস গ্যালাপাভো এবং চোখের আকৃতির চিহ্নে টার্কি মেলিয়গ্রীস ওসেলাটা। পুরুষ টার্কি স্ত্রী টার্কির চেয়ে বড় এবং আকর্ষণীয়। পুরুষ জাতীয় টার্কির মাথা ন্যাড়া উজ্জ্বল লাল। কখনও সাদা ও উজ্জ্বল নীলাভ হয়। এই মুরগির গোশতও খাওয়া যায়। এই টার্কি গবলার বা টম নামেও পরিচিতি। লম্বার ১৩০ সেন্টিমিটার বা ৫০ ইঞ্চি। ওজন ৭ থেকে ১০ কেজি। স্ত্রী টার্কি পুরুষের তুলনায় ওজনে কম। প্রতিটি স্ত্রী টার্কি ৮ থেকে ১৫টি ছোট ছোট দাগের বাদামী রঙের ডিম দেয়। চার সপ্তাহ অন্তর ডিম ফুটে ছানা জন্মায়। এরা সাধারণত বনভূমিতে পানির কাছাকাছি থাকতে পছন্দ করে। ফসলের পোকামাড় মাঝে মধ্যে ব্যাঙ খেয়ে থাকে। এরা স্বল্প দূরত্বে উড়তেও পারে। তখন কোয়ার্টর মাইল দূরত্ব অতিক্রম করে। বগুড়ার ধুনটের শাকদহ গ্রামের রেজাউল করিম বছর দুয়েক আগে নরসিংদী থেকে এক জোড়া টার্কি মুরগি কিনে আনেন ৮ হাজার টাকায়। গ্রামে এই টার্কি মুরগি এনে লালনপালন করার ছয় মাস পর ডিম দেয়। প্রতিটি ডিম বিক্রি করেন ৫০০ টাকায়। এই ডিম থেকে বাচ্চা ফুটিয়ে প্রতিটি বাচ্চা বিক্রি করেন ১ হাজার টাকায়। এভাবে ব্রিডিং হতে থাকে। গ্রামের অনেকে তার কাছ থেকে বাচ্চা কিনে নিয়ে পালন করতে থাকেন। গ্রামের গেরস্ত বধূ চম্পা কয়েকটি টার্কি মুরগির ছানা নিয়ে লালনপালন করেন। মাস ছয়েক আগে ৭০টি টার্কি মুরগি ৩ লাখ টাকায় বিক্রি করেন। বর্তমানে চম্পার উঠানে ছোট-বড় যে কয়টি মুরগি আছে তার দাম অন্তত দুই লাখ টাকা। গ্রামের স্কুলের এক দফতরি আজিজুর রহমান সঞ্চিত অর্থে কয়েকটি টার্কি মুরগি পালন করছেন। তাকে আর দফতরির কাজ করতে হয় না। বগুড়া সরকারী আজিজুল হক কলেজ থেকে মাস্টার্স করার পর হাসানুজ্জামান চাকরির জন্য হন্যে হয়ে ঘুরে যখন ক্লান্ত তখন গ্রামের টার্কি মুরগি দেখে পালন করেন। বর্তমানে তার অধীনেই লোকজন চাকরি করছেন। একটি বাড়িতে ১০টি টার্কি মুরগি থাকলে প্রতিমাসে অন্তত ৪০ হাজার টাকা আয়ের পথ খুলে যাবে, এমনটি বলেন তিনি। টার্কি মুরগি পালন অনেকটা দেশী মুরগি পালনের মতো। সময়মতো খাবার দিতে হয়। এই মুরগির খাবারের দাম বেশি। রোগ-প্রতিরোধে ওষুধ খাওয়াতে হয়। এরা জোটবদ্ধ হয়ে থাকে। ময়ূরীর মতো আকাশে মেঘ দেখলেই পেখম মেলে নেচে ওঠে। টার্কি মুরগির এই নাচনে গেরস্তের মন নেচে ওঠে।
×