ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

চঞ্চল টাকা ফের আঁচলে বাঁধার দিনে ফিরছে নিম্নবিত্তের মানুষ!

প্রকাশিত: ০৬:১০, ৩ জুন ২০১৭

চঞ্চল টাকা ফের আঁচলে বাঁধার দিনে ফিরছে নিম্নবিত্তের মানুষ!

সমুদ্র হক ॥ ‘চঞ্চল টাকা অঞ্চলে বেঁধো না’ আর বুঝি রইল না। টাকা অঞ্চলেই (আঁচলে) ফিরে যাচ্ছে! নিকট অতীতে সাধারণ মানুষকে ব্যাংকে সঞ্চয়ের মনোভাব গড়ে তুলতে সুন্দর দুটি সেøাগান ছিল। ১. চঞ্চল টাকা অঞ্চলে (আঁচলে) বেঁধো না। ২. সুদিনের সঞ্চয় দুর্দিনের সহায়। একটা সময় বাড়ির কত্রীকে চেনা যেত তার আঁচলে বাঁধা চাবির গোছা দেখে। এই আঁচলেই অনেক নারী টাকা বেঁধে রাখত। গ্রামে একটা সময় বাঁশের খুঁটিতে ছিদ্র করে টাকা ও মুদ্রা (কয়েন) ফেলা হতো। বলা হতো বাঁশের ব্যাংক। মাটির ব্যাংক তো ছিলই। একটা সময় সাধারণ মানুষ ব্যাংকে যেতেও ভয় পেত। কাজ করত দ্বিধা ও সংকোচ। এই সাধারণ মানুষকে নির্ভয়ে নিশ্চিন্তে ব্যাংকে সঞ্চয় রাখতে উৎসাহিত করতে বেতার ও সংবাদপত্রে প্রচার ছাড়াও ব্যাংক কর্মকর্তারা মাঠপর্যায়ে ছুটে বেড়াতেন। ষাটের দশকে সোনালী ব্যাংক (পূর্বের নাম ন্যাশনাল ব্যাংক) স্কুলের শিক্ষার্থীদের কিশোর বেলাতেই সঞ্চয়ী মনোভাব গড়ে তুলতে স্কুল ব্যাংকিং স্কিম চালু করে। তখন মাত্র ২৫ পয়সায় (চার আনা) হিসাব খুলে এক টাকা জমা হলেই লাভ মিলত। সঞ্চয়ী হিসাবে সুদের হারও ছিল বেশি। দিনে দিনে লোকজন ব্যাংকমুখী হতে থাকে। মাঠপর্যাযে সাধারণের মধ্যেই অর্থ বিভাগের সেøাগান দুটি জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। নারীরা আঁচলে টাকা রাখা বন্ধ করে। মুরুব্বীরা বলতে থাকেন- সুদিনে সঞ্চয় কর বাবা দুর্দিনে তোমার সহায় হবে। কারও কাছে হাত পাততে হবে না। টাকা বাড়িতে না রাখাই ভাল। ভয় থাকে চুরির। তারচেয়ে ব্যাংকে রাখাই অনেক ভাল। ইতিহাসের ফিরে আসার পালায় ফের চঞ্চল টাকা আঁচলে রাখার উপক্রম হয়েছে। এবারের বাজেটে অর্থমন্ত্রীর নজর পড়েছে সাধারণের ব্যাংক হিসাবে। আজকাল গরিবও এক লাখ ও তারও বেশি টাকা ব্যাংকে রাখে। সন্তানদের লেখাপড়ার জন্য প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়সহ পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে অভিভাবকদের টাকা পাঠাতে হয়। মধ্যবিত্ত ও গরিব অভিভাবকদের কতটা কষ্ট করে এই টাকা পাঠাতে হয় ভুক্তভোগীরা জানেন। এবারের বাজেটে এসব সাধারণ মানুষের মাথায় বাজ পড়ার উপক্রম। ব্যাংকে সঞ্চয় হিসাবে সুদের হার তো কমানো আছেই। নানা খাতে অর্থ কর্তন অব্যাহত রয়েছে। এবার মরার ওপর খাঁড়ার ঘায়ের মতো আরও চাপল বাড়তি করের বোঝা। এদিকে সুদিনের সঞ্চয় দুর্দিনের সহায় হয়ে এখন ব্যাংকের বদলে সঞ্চয়পত্রের দিকে ধাবিত। লোকজন সঞ্চয়পত্রের দিকে ঝুঁকেছে বেশি। সবচেয়ে মজার বিষয় হলোÑ একমাত্র সঞ্চয়পত্রে যে যত খুশি টাকা সঞ্চয় করতে পারে। কোন হিসাব দিতে হয় না। একমাত্র সঞ্চয়পত্রে টাকার উৎস ও প্রাপ্তি প্রদর্শন করতে হয় না। (অর্থমন্ত্রী তো এদিকে খেয়াল করেন না। তাই বুঝি সঞ্চয়পত্রে সুদের হার খুব বেশি কমান না।) সঞ্চয়পত্রগুলো আছে কয়েক ধরনের। পরিবার সঞ্চয়পত্র, পাঁচ বছর মেয়াদী সঞ্চয়পত্র, তিন বছর মেয়াদী এক ধরনের সঞ্চয়পত্র। যেখানে প্রতি তিন মাস অন্তর অন্তর সুদের টাকা উত্তোলন করা যায়। তিন বছর পর মূল অর্থ ঠিকই থাকে। আছে পেনশনার সঞ্চয়পত্র ইত্যাদি। হালে এই সঞ্চয়পত্র খোলার পর লাভ তুলতেও সময়ক্ষেপণ হচ্ছে বেশি। জাতীয় সঞ্চয় অধিদফতরে লোকবল বাড়ানো হয়নি। ডিজিটাল ই-আধুনিকায়নও হয়নি। কথা ছিল গ্রাহকদের দ্রুত সেবা দিতে ইলেক্ট্রনিক ফান্ড ট্রান্সফার (ইএফটি) প্রোটোকল চালু করা হবে। তা করা হলে সঞ্চয়পত্র কেনার পর গ্রাহকদের লাভ তুলতে কোন বেগ পেতে হবে না। অফিসে গিয়ে কালক্ষেপণও হবে না। কোন ব্যাংকে গ্রাহকদের হিসাব থাকলে অনলাইনে ইএফটির মাধ্যমে সেই হিসাবে সঞ্চয়পত্রের লাভ যোগ হয়ে যাবে। বর্তমানে ইএফটি ব্যবস্থা শুধু বাংলাদেশ ব্যাংকের নিজস্ব সঞ্চয় বিভাগে আছে। উল্লেখ্য, বাংলাদেশ ব্যাংকের শাখা সব জেলায় নেই। বর্তমানে রাষ্ট্রায়াত্ত, বাণিজ্যিক, প্রাইভেট ও আন্তর্জাতিক প্রায় প্রতিটি ব্যাংকে সঞ্চয়পত্র বিক্রির ব্যবস্থা আছে। সেখানেও ইএফটি চালু করা হয়নি। বাজেট প্রস্তাবের পর সাধারণ মানুষের কথা- সুযোগ সুবিধা না বাড়িয়ে যে হারে করের বোঝা বাড়ানো হয়েছে তাতে সাধারণ মানুষের দেয়ালে পিঠ ঠেকার উপক্রম। সাধারণের ওপর করের বোঝা চাপিয়ে অর্থমন্ত্রী কেবল সরকারী কর্মকর্তাদের বেতন কয়েকগুণ বাড়িয়ে দেয়ার ব্যবস্থা করছেন। সিভিল সার্ভিসের কর্মকর্তাদের সাধারণের জন্য কতটা সেবা দিচ্ছেন সেদিকে তো তিনি খেয়াল করেন না। দেশের অর্থমন্ত্রী হয়ে তার সকলের দিকেই খেয়াল রাখা উচিত। এমনটি বলাবলি করছে সাধারণ মানুষ। যাদের বলা হয় ‘আম জনতা’। তাদের আরও কথা- বেশ ক’ বছর ধরে দেশের প্রতিটি এলাকায় বিভিন্ন ধরনের অর্থলগ্নির প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠেছে। এটা ব্যাংকের এক ধরনের বিকল্প ব্যবস্থা। যাদের অধিক পরিচিতি ‘সমিতি’ নামে। প্রতিদিন বা প্রতি সপ্তাহে নানা নামে সমিতিতে নির্দিষ্ট অংকের টাকা জমা করার পর তা পাসবুকে লিপিবদ্ধ করা হয়। জমানো এই অর্থ থেকে প্রয়োজনে ঋণ নেয়া যায়। ব্যাংকে সাধারণের আমানতের ওপর করের বোঝা চাপানোর ফলে এই সমিতিগুলো মাথাচাড়া দিয়ে উঠবে। এই সমিতি নির্ভরযোগ্য নয়। তারপরও সাধারণের হাতের কাছে দিনে রাতে সুবিধা থাকায় লোকজন যদি ব্যাংকের বদলে এই সমিতির দিকেও ধাপিত হয় তাহলে সরকারের ক্ষতি ও লিকুইডিটি ফ্লো নিয়ে বিপাকে পড়তে হতে পারে।
×