ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

মূল্যস্ফীতি বৃদ্ধির আশঙ্কা সিপিডির

বাজেটে মধ্যবিত্তের ওপর করের বোঝা চাপবে, বাড়বে ভোক্তাব্যয়

প্রকাশিত: ০৬:০৮, ৩ জুন ২০১৭

বাজেটে মধ্যবিত্তের ওপর করের বোঝা চাপবে, বাড়বে ভোক্তাব্যয়

অর্থনৈতিক রিপোর্টার ॥ ২০১৭-১৮ অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেটের আয়-ব্যয়ের লক্ষ্যমাত্রা ও বাস্তবায়নের দিক থেকে অনেক ফারাক রয়েছে বলে মনে করছে বেসরকারী গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ (সিপিডি)। সংস্থাটি বলছে, এমন কিছু অনুমানের ভিত্তিতে বাজেট করা হয়েছে যার সঙ্গে বাস্তবতার মিল নেই। বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচী (এডিপি) বা সামগ্রিক বাজেট বাস্তবায়নের জন্য কোন সুনির্দিষ্ট কর্মপরিকল্পনা বাজেটে দেখা যায়নি। ছড়িয়ে-ছিটিয়ে বিভিন্ন জায়গায় বিভিন্ন মন্তব্য আছে, কিন্তু সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা নেই। ফলে বাজেটে আর্থিক ভ্রমের সৃষ্টি হয়েছে। সিপিডির মতে, নতুন বাজেট দেশের মধ্যবিত্ত শ্রেণীর ওপর করের চাপ বাড়ার পাশাপাশি উৎপাদন ও ভোক্তা ব্যয় বাড়বে। এতে সব ধরনের পণ্যের দাম বেড়ে যাবে। ফলে আগামী অর্থবছরে মূলস্ফীতিও বাড়বে বলে আশঙ্কা করেছে সংস্থাটি। শুক্রবার রাজধানীর গুলশানের লেকশোর হোটেলে আয়োজিত বাজেট পর্যালোচনায় এ আশঙ্কা প্রকাশ করা হয়। এর আগে গত বৃহস্পতিবার জাতীয় সংসদে আগামী ২০১৭-১৮ অর্থবছরের জন্য বাজেট প্রস্তাব উপস্থাপন করেন অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত। এতে ভ্যাট আইন কার্যকর করাসহ বেশ কিছু পণ্যের ওপর কর ও শুল্ক বাড়ানো হয়েছে। শুক্রবার প্রস্তাবিত বাজেট পর্যালোচনায় সংবাদ সম্মেলনের আয়োজন করে সিপিডি। এতে সিপিডির সম্মানীয় ফেলো ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য বলেন, ভ্যাট আইনসহ সামগ্রিক কর কাঠামো বাস্তবায়নের ফলে উৎপাদন ব্যয় ও ভোক্তা ব্যয় বাড়বে। এছাড়া চালের দামও বাড়ছে। গ্যাস ও বিদ্যুতের দাম বেড়েছে। অন্যদিকে রফতানি আয় ও রেমিটেন্স কম আসায় টাকার বিপরীতে ডলারের দাম আরও বেড়ে যাবে। প্রস্তাবিত বাজেটের কারণে মধ্যবিত্ত ও নিম্নমধ্যবিত্তদের ওপর করের চাপ বেশি পড়বে। ফলে সামগ্রিকভাবে আমরা মূল্যস্ফীতি বাড়ার আশঙ্কা করছি। কারণ নতুন ভ্যাট আইন বাস্তবায়ন হলে উৎপাদন খরচ বাড়বে। দেবপ্রিয় বলেন, বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচী (এডিপি) বা সামগ্রিক বাজেট বাস্তবায়নের জন্য কোন সুনির্দিষ্ট কর্মপরিকল্পনা বাজেটে দেখা যায়নি। ছড়িয়ে-ছিটিয়ে বিভিন্ন জায়গায় বিভিন্ন মন্তব্য আছে, কিন্তু সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা নেই। রাজস্ব ব্যয় যে দেড় গুণ বাড়বে, রাজস্ব আয় ৪০ শতাংশ বাড়বে এগুলো করতে হলে একটা কর্মপরিকল্পনা ও ভিত্তি লাগবে। সেটা আমরা দেখতে পাচ্ছি না। তিনি বলেন, বাজেটের আয়-ব্যয়ের লক্ষ্যমাত্রা ও বাস্তবায়নের দিক থেকে অনেক ফারাক রয়েছে। আবার প্রতিবছর বাজেটের আকারও বাড়ছে। এমন কিছু অনুমানের ভিত্তিতে বাজেট করা হয়েছে যার সঙ্গে বাস্তবতার মিল নেই। ফলে বাজেটে আর্থিক ভ্রমের সৃষ্টি হয়েছে। এই অবস্থায় আগামী ২০১৭-১৮ অর্থবছরের বাজেট পুরোপুরি বাস্তবায়ন হলে দেশের সার্বিক মূল্যস্ফীতি বাড়তে পারে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করেন দেবপ্রিয়। সিপিডির বিশেষ ফেলো বলেন, শুধু প্রশাসনিক কাঠামো দিয়ে বাজেটে বাস্তবায়ন সম্ভব নয়। বাজেট বাস্তবায়নের জন্য সংসদীয় কমিটির বাইরে বিভিন্ন পর্যায়ের জনপ্রতিনিধিদের সম্পৃক্ত করতে হবে। কিন্তু আমাদের দেশের বাজেট বাস্তবায়নে বিভিন্ন পর্যায়ের জনপ্রতিনিধি বা রাজনৈতিক নেতাদের অবদান নেই বললেই চলে। তিনি বলেন, দেশের প্রশাসনিক ব্যবস্থায় বাজেট বাস্তবায়নে বিভিন্ন পর্যায়ের জনপ্রতিনিধিদের অবদান রাখার কোন সুযোগ নেই। আবার তাদের পক্ষ থেকেও এই ধরনের কাজে সম্পৃক্ত হওয়ার কোন উদ্যোগ দেখা যায় না। দেবপ্রিয় বলেন, বাজেটে ঘাটতি মেটাতে ৭৬ হাজার কোটি টাকা বৈদেশিক ঋণের সহায়তা আমাদের আশ্চর্য করেছে। ২০১৬ সালে ২৭ হাজার কোটি টাকা বৈদেশিক ঋণ সহায়তা পেয়েছে বাংলাদেশ; যা দেশের ইতিহাসে সর্বোচ্চ। তিনি আরও বলেন, বৈদেশিক ঋণের যথাযথ ব্যবহার হচ্ছে না। তবু আগামী অর্থবছরের জন্য প্রায় ৩ গুণ বৈদেশিক ঋণ সহায়তার কথা বলা হয়েছে প্রস্তাবিত বাজেটে। ঘাটতি পূরণে বৈদেশিক উৎস থেকে অর্থায়নের লক্ষ্যমাত্রা অর্জন নিয়েও সংশয় রয়েছে। দেবপ্রিয় বলেন, অর্থমন্ত্রী আটটি বিষয়ে লক্ষ্য নিয়ে বাজেট পেশ করেছেন। তবে এর মধ্যে পাঁচটি বিষয় বাস্তবায়ন নিয়ে আমাদের সন্দেহ আছে। তিনি সংশয় প্রকাশ করে বলেন, বাজার মূল্য, সুদের হার, বৈদেশিক ঋণ বা অনুদান, বৈশ্বিক অবস্থা এবং রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা এলেই সাধারণ মানুষের অনুকূলে থাকবে কিনা সেটা নিয়ে আমাদের সংশয় আছে। এবারের বাজেটে নতুন কর্মসংস্থান সৃষ্টির বিষয়েও কোন নির্দেশনা বা সুযোগ নেই বলেও উল্লেখ করেন তিনি। নতুন করদাতা না বাড়িয়ে যারা কর দেয় তাদের ওপর ‘নজর বাড়ানোর বিষয়ে ইঙ্গিত’ নৈতিকভাবে ঠিক নয় বলেও উল্লেখ করেন তিনি। বড় বড় প্রকল্পের কথা উল্লেখ করে তিনি বলেন, এই ধরনের প্রকল্পে ২০ শতাংশ বাজেট রাখা হয়েছে। এই ধরনের প্রকল্পে বছরের পর বছর বাজেট রাখা হয়। আবার বাস্তবায়নেও তেমন কোন গতি থাকে না। বাড়ে প্রকল্প বাস্তবায়ন ব্যয়। এর প্রভাব পড়ে সামগ্রিক অর্থনীতিতে। দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য বলেন, বাজেট কাঠামোতে বড় দুর্বলতা দৃশ্যমান। এই অবস্থা থাকলে বাজেট বাস্তবায়ন সম্ভব নয়। তবে প্রস্তাবিত বাজেটের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্যের সঙ্গে আমরা একমত। তিনি আরও বলেন, অর্থনীতির সঙ্গে বাজেটের আকারও বাড়াতে হবে- এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু বাজেটের আকার বাড়ানো জন্য যে সক্ষমতার প্রয়োজন- তাতে ঘাটতি আছে। দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য বলেন, আমাদের দেশের বাজেট বাস্তবায়নে রাজনৈতিক অর্থনীতির কোন ছোঁয়া নেই। বাজেট সুন্দরভাবে বাস্তবায়ন করতে এটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে। রাজনৈতিক অর্থনীতির অংশ হিসেবেই বাজেটে পুঁজিবাজারকে রাখা প্রয়োজন ছিল বলেও মন্তব্য করেন তিনি। দেবপ্রিয় বলেন, প্রাক-বাজেট আলোচনায় পুঁজিবাজার নিয়ে অনেক আশার কথা শুনিয়েছিলেন অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত। কর্পোরেট কর কমানো, ডাবল ট্যাক্সের ফাইনাল সেটেলমেন্টসহ বেশ কয়েকটি বিষয়ে আশ্বাস দিয়েছিলেন তিনি। তবে বাজেট ঘোষণার দিন সব আশা ফিকে হয়ে যায়। সিপিডির সম্মানীয় ফেলো ড. মোস্তাফিজর রহমান বলেন, বাজেটে কিছু কিছু ক্ষেত্রে নির্বাচনমুখী পদক্ষেপ রয়েছে। আবার কিছু ক্ষেত্রে বিপরীতমুখীনতাও রয়েছে। ভ্যাট আইন বাস্তবায়নের মাধ্যমে ১৫ শতাংশ ভ্যাট চালু করা হয়েছে। এটি ১২ শতাংশ করার দাবি ছিল। আবার নিত্যপ্রয়োজনীয় অনেক পণ্যকে ভ্যাটের আওতার বাইরে রাখা হয়েছে। এতে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দাম বাড়ার আশঙ্কা কম। অন্যদিকে প্রায় ১ হাজার ৩০০ পণ্যকে নতুন করে সম্পূরক শুল্কের আওতায় আনা হয়েছে। এতে পণ্যগুলোর দাম বাড়বে। তিনি বলেন, জিডিপি প্রবৃদ্ধি অর্জনের ক্ষেত্রে রফতানি ও রেমিটেন্সের যে লক্ষ্য ধরা হয়েছে তা বাস্তবসম্মত নয়। আগামী দুই মাসে রফতানিী আয় ২০ শতাংশ এবং রেমিটেন্স আয় ৪৫ শতাংশ বাড়ার প্রাক্বলন রয়েছে। এটি একেবারেই অবাস্তব। এর ফলে জিডিপি প্রবৃদ্ধির অর্জন নিয়ে সংশয় রয়েছে। তিনি বলেন, প্রবৃদ্ধি লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে সরকারী বিনিয়োগ বড় ভূমিকা পালন করতে হবে। এমনটি করা হলে বেসরকারী বিনিয়োগকারীরাও এগিয়ে আসবে। সবাই মিলে এই লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করতে হবে। অনুষ্ঠানে স্বাগত বক্তব্য দেন সিপিডির নির্বাহী পরিচালক ফাহমিদা খাতুন। উপস্থিত ছিলেন সিপিডির গবেষণা পরিচালক খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম, জ্যেষ্ঠ গবেষক তৌফিকুল ইসলাম খান প্রমুখ।
×