ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

ছাপচিত্রের বরপুত্র আক্তারুজ্জামান সিনবাদ

প্রকাশিত: ০৭:২৪, ২ জুন ২০১৭

ছাপচিত্রের বরপুত্র আক্তারুজ্জামান সিনবাদ

অসুন্দরের মধ্য থেকে সুন্দরকে বের করে আনেন একজন শিল্পী। সুন্দরের মধ্যে থেকেও সুন্দরকে দৃষ্টিনন্দন করে মোহনীয় করে তোলেন ক্যানভাসে। পাশাপাশি রং, রেখা ও টেক্সচারে ফুটিয়ে তোলেন বাস্তব-পরাবাস্তব অন্তর্নিহিত রূপকে। দেশের চারুকলা ভুবনে এমনই জনপ্রিয় হয়ে উঠছে ছাপচিত্র। চিত্রকলার অন্যান্য মাধ্যমের মতো এই মাধ্যমেও সঞ্চারিত হয়েছে নতুন গতিধারা। ছাপচিত্রের অন্যতম একটি মাধ্যম হলো উডকাট বা কাঠখোদাই। শিল্পী আনিসুজ্জামান মূলত ছাপচিত্র শিল্পী। ছাপচিত্রাঙ্গনে তার শিল্পকর্ম বেশ প্রশংসনীয় সব সময়ই। কাঠখোদাইয়ে দক্ষ যেসব তরুণ শিল্পীর নাম অগ্রগণ্য আনিসুজ্জামান অবশ্যই তাদের মধ্যে প্রধান সারিতে অবস্থান করেন। যা তার কাজগুলোতে সুস্পষ্টভাবে পরিলক্ষিত হয়। নগরবাসী মানুষ উন্নয়নের পীড়ন অনুভব করছে প্রতিনিয়ত। তার চোখের কাছে প্রতিদিন পুরনো ভূমিলগ্ন আবাস ভাঙছে, নতুন পরিপাটিময় সুউচ্চ দরদালান উঠছে। সমতলে আদিগন্ত দেখার আনন্দ এখন স্মৃতির মধ্যে বিরাজ করছে। আকাশচুম্বিতার আকর্ষণ বেড়েই চলেছে। বিচিত্রভাবে জ্যামিতিময় পরিসরে আমাদের যাতায়াত। আমরা চোখ মেললেই দেখি ত্রিকোণ, চৌকোণ এবং গাণিতিক শুদ্ধতায় টানা কত না ডিজাইন। আমাদের আকাশটাও আজ ছককাটা। মহানগরবাসী দৃষ্টি গলিয়ে ত্রিকোণ, চৌকোণ আকাশ দেখে তার আবাস থেকে। এই অভিজ্ঞতার স্নিগ্ধ প্রকাশ আনিসুজ্জামানের ছাপচিত্রÑ উডকাট। মহানগরের নির্মাণযজ্ঞ নিয়ে অনেকদিন ধরেই ছাপচিত্র করছেন আনিসুজ্জামান। কাঠখোদাই ছাপচিত্রের মাধ্যমে বেশ দক্ষতার পরিচয় দিয়েছেন তিনি। বড় বড় নগর নির্মাণ প্রত্যক্ষ করে তার অনুবাদ করেছেন নিজের কাজে। চিত্রকলাপ্রেমীদের মনে ধরার মতো এমনি বেশ কিছু চিত্রকর্ম নিয়ে গুলশান-২ এর ‘এজ’ গ্যালারিতে চলছে শিল্পী আনিসুজ্জামানের একক ছাপচিত্র প্রদর্শনী ‘আরবান রুমিনেশন্স’। উডকাট মাধ্যমে আঁকা ছবি নিয়ে আয়োজিত এ প্রদর্শনীটি বাংলাদেশে সবচেয়ে বড় প্রদর্শনী। ৭৫টি চিত্রকর্ম স্থান পেয়েছে প্রদর্শনীটিতে। ছাপচিত্রের মুন্সিয়ানায়, টেক্সচারের গভীরতায় ছবিগুলো ফুটিয়ে তুলেছেন শিল্পী। ‘ক্যালাইডোসকপিক কমপ্লেক্সিটি’ ৩১, ৩২’ চিত্রগুলোতে উজ্জ্বল রঙের ব্যবহারে ঢাকা শহরের অর্গানিক ঠিকানা ও তার কাঠমোগত জটিলতার রূপের নান্দনিক প্রকাশ ঘটিয়েছেন শিল্পী। বড় বড় নির্মাণাধীন দালান, তারসহ বৈদ্যুতিক খুঁটি, নির্মাণাধীন দালানের তীর্যকভাবে বের হয়ে থাকা লোহার রড জ্যামিতিক আকারে, রঙের বৈচিত্র্যে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে। রঙের নিরীক্ষায় সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম অতিব্যঞ্জনা চোখে পড়ে। অভিজ্ঞতার তারুণ্য এবং স্বতঃস্ফূর্ততা সুস্পষ্ট তার এ চিত্রগুলোতে। রঙের বৈচিত্র্যময় দীপ্তি শিল্পীর তীক্ষè অনুভূতি ও আবেগকে এবং রেখা ও রঙের উন্মাদনা পুনর্নির্মাণ করে উদ্ভাসিত হয়েছে সামগ্রিক ক্যানভাস। শুরুতে ছেঁড়া-ফাড়া জীবনের জর্জরিত রূপেই আবিষ্ট হয়েছিল আনিসের ধ্যান। তখনও তার কাজে উদ্ভিদ প্রধান প্রকৃতির অনুষঙ্গ ছিল, ছিল মধ্যবিত্তের অনুচ্চ জীর্ণ দালান আর হতদরিদ্র, মানুষের বস্তির কুৎসিত চিৎকৃৎ রূপের কোলাহল। আনিস উডকাটের সম্ভাবনাকে কাজে লাগিয়ে সহস্রভাবে বিকিরণময় বস্তু ও মানুষের জীবন ধরতে চেয়েছেন। কবিখ- নানাভাবে চিড়ে জ্যামিতিক বৈচিত্র্য অন্বেষণ করেছেন এ শিল্পী। প্রথমে আনিস উচ্চগ্রামে বাজিয়েছেন ক্ষয়ে যাওয়া দেয়াল, নতুন সিমেন্টের চাপড় দেয়া দেয়াল, নানা নির্মাণ সামগ্রী, কাঠের তক্তা, লোহার রড, শ্রমিকের বাঁশের ঝুপড়ি ইত্যাদি মিলিয়ে জটিল ফর্মের আবেশ তৈরি করেছেন। নির্মাণাধীন দালানে বাঁশের সিঁড়ি এসবের দিক দিয়ে তাকিয়ে তীর্যক রেখার নির্ভরতায় স্পেসে গভীরতা খুঁজে পেয়ে নতুন কম্পোজিশন রচনা করেছেন আনিস। ‘কমপ্লেক্সিটি’ সিরিজের চিত্রগুলোতে পরিলক্ষিত হয় বেড়ে ওঠা নির্মাণাধীন দালানের সঙ্গে বাঁধা বাঁশের সারি, কাঠের টুকরো, আঁকাবাঁকা লোহার রড, লোহার তৈরি পতির পড়ে থাকা ইটের খ-, এ যেন নিখুঁত নিকোনো পরিবেশনা। মিহি থেকে মিহিতর হয়েছেন তিনি। নিবিষ্ট কানে নিরূপদ্রব সারবত্তার তার কাঠের অন্তর্গত বিচিত্র সরুজালের সঙ্গীত আমরা শুনতে পাই তার এসব ছাপচিত্রে। তার ছবির আবেশ শুধু আমাদের চোখের সামনের বাস্তবতাকে জানান দেয় না, তা মেলে ধরে অন্তর্লোকের বাস্তবতাও। তার চিত্র পরিমার্জনার প্রধান লক্ষণ স্থাপত্য বৈশিষ্ট্য। তবে স্থাপত্য সম্বন্ধে সেই প্রিয় প্রবাদÑ ‘আর্কিটেকচার ইজ ফ্রোজেন মিউজিক’ তা গড়ন ও কাঠামোর মাহাত্ম্য ছাড়িয়ে টেক্সচার বা বিন্দুর বুনটের হিমসঙ্গীত হয়ে পড়েছে আনিসের কাজে। ‘আরবান রুমিনেনান্স’ ‘বিগিনিং অব এ কমপ্লেক্সিটি’ ও রিভিমিং সেপ’ সিরিজের চিত্রগুলো ভারসাম্য, স্নিগ্ধতা, কখনও বা পরিচিত বস্তুর অতীত নিরপেক্ষ জ্যামিতিÑ এ সবই মগ্ন চোখে আনিসুজ্জামানের উডকাট প্রিন্টে দেখার বিষয় হয়ে উঠেছে। তার চিত্রকর্মগুলো একই সঙ্গে উজ্জ্বল ও ধূসর রঙের আমন্ত্রণ জানায়। তার সৃষ্টি বৈচিত্র্যময় মনোগ্রাহী ও উজ্জ্বলতা অর্জন করেছে বিষয়ের গুণে ও রঙের ব্যবহারে। এর মাধ্যমেই সৃষ্ট চিত্রকর্মে সৃজন উৎকর্ষ ও নাগরিক জীবনের নানা অনুষঙ্গ ধরা পড়েছে। একটার পর একটা স্বচ্ছতলে প্রিন্টের পর প্রিন্ট দিয়ে বিষয়ের গহীন থেকে গহীনে বিচরণ করে এক অপরূপ সৃষ্টিশৈলী উদ্ভাবন করেছেন। সহসাই দর্শক তার কাজের গহীনে সাঁতার কেটে অবগাহন করতে পারেন। উপর থেকে নিচে আবার নিচ থেকে উপরে ভেসে বেড়াতে পারেন। ভেতর থেকে বাইরে আবার বাইরে থেকে ভেতরে যাওয়া-আসা এক অনাবিল আনন্দে মুখরিত করে তার কাজ। পরিমিতি আর মিতভাষিতার এক নতুন গন্তব্যে পৌঁছেছেন তিনি। তবে জাপানি নান্দনিকতাকে আলিঙ্গন করতে গিয়ে স্বদেশবিস্মৃত হননি শিল্পী আনিসুজ্জামান। মনে হয় সব বিশৃঙ্খলা ও কোলাহল শান্ত করে নিজের স্বপ্নের স্পেসই ছিল তার কাক্সিক্ষত। শিল্প তো সব মতবাদী মানুষের জন্যই বাঁচার উপায়। আনিস উডকাটের বিচিত্র জাল-জালিকায় সুন্দর আবাস খুঁজে পেয়েছেন। তার ছবি স্পষ্ট ও উজ্জ্বল নানা নাগরিক উপাদানের বর্ণালীতে প্রাণবন্ত, উৎসারিত ও উৎকলিত। তার চিত্রকাব্যে মনোমুগ্ধকর আনন্দধারায় নেচে ওঠে শিল্পের পাঠক। প্রদর্শনী চলবে ২ জুন পর্যন্ত।
×