ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ১৮ এপ্রিল ২০২৪, ৫ বৈশাখ ১৪৩১

নুরুল করিম নাসিম

হারিয়ে যাওয়া দিন

প্রকাশিত: ০৭:২৪, ২ জুন ২০১৭

হারিয়ে যাওয়া দিন

মাসে অন্তত দু’তিন দিন ঠিক ভরদুপুরে কবির সঙ্গে কথাসাহিত্যিক রিজিয়া আপার বাসায় যেতাম। সময়টা ’৭৯ সাল। কোন কোন দিন, তার স্বামী মিজান ভাইও আমাদের সঙ্গে খাবার টেবিলে বসতেন, তিনি ছিলেন আমার দেশের, বিক্রমপুরের সন্তান। বেশ স্বাস্থ্যবান, বড় অমায়িক মানুষ। কবিতা-গল্প ইত্যাদি পড়তেন কিনা জানি না, এসব নিয়ে কোন দিন আমাদের সঙ্গে আলাপ-আলোচনা হয়নি। তবে রিজিয়া আপার লেখালেখির পেছনে তার গভীর অবদান রয়েছে। সেই সব গল্প আপা আমাদের বলতেন। মিজান ভাই ছিলেন পেশায় ভূতত্ত্ববিদ। পেশাগত কারণে বাংলাদেশের অনেক শহরে তাকে থাকতে হয়েছে। আর এসব অভিজ্ঞতায় ঋদ্ধ হয়েছেন রিজিয়া আপা। তিনি অনেক গল্পের এবং উপন্যাসের উৎস খুঁজে পেয়েছেন। রিজিয়া আপার সঙ্গে আমাদের যে মমতার সম্পর্ক গড়ে ওঠে, তা কখনও কখনও ব্যস্ততার কারণে ছেদ পড়লেও কখনও বিলীন হয়ে যায়নি। ১৯৮০ সালে অধ্যাপনার চাকরি নিয়ে আমি ভূ-মধ্যসাগর তীরের একটি দেশে চলে যাই। ছয় বছর পর ফিরে এসে কবির সঙ্গে একদিন তার বাসায় যাই। তাদের একমাত্র পুত্র তপু ততদিনে বেশ বড় হয়ে গেছে। কলেজের সীমানা পেরিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়েছে। দীর্ঘ, সুদর্শন কিন্তু শীর্ণকায় তপুর সঙ্গে কবির বেশি হৃদতা গড়ে ওঠে। কবি ক্রিকেট খেলার ভক্ত। তপুও। আমার বাবা ১৯৭৭ সালে যখন মারা যান, মৃত্যু সংবাদ শুনে কবিকে নিয়ে রিজিয়া আপা তার গাড়িতে আমাদের পুরান ঢাকার নারিন্দার বেগমগঞ্জ লেনে আসেন। তার সমবেদনার কথা আমি কোনদিন ভুলব না। আমার মাকে তিনি সান্ত¡না দেন। আমাকেও। মা ভাল পাঠক ছিলেন। রিজিয়া আপা যে বইগুলো আমাকে উপহার হিসেবে দিতেন, সেগুলো মা গভীর আগ্রহ নিয়ে পড়তেন। ইতোমধ্যে মিজান ভাই মারা গেলেন। আপা উত্তরায় তার নিজের এ্যাপার্টমেন্টে চলে এসেছেন। তপু ততদিনে বিশ্ববিদ্যালয় জীবন শেষ করে চাকরি করছে। আমি ও কবি দু’জনেই জীবিকার প্রয়োজনে ব্যস্ত হয়ে পড়ি। কিন্তু টেলিফোনে মাঝে মধ্যে খোঁজখবর নিতে চেষ্টা করি। সময় সময়ের হাত ধরে এগিয়ে যেতে থাকে। দেশ, রাষ্ট্র এবং মানুষ পরিবর্তনের স্পর্শ পেয়ে বদলে যেতে থাকে। ঢাকা শহর ক্রমশ বদলে যায়। কথাসাহিত্যের অবয়ব বদলে যায়। আর সেই বদলে যাওয়ার প্রবণতাগুলো তার লেখায় মূর্ত হয়ে ওঠে। একদিন মিজান ভাইয়ের মৃত্যুবার্ষিকীতে কবি ও আমি মিলাদে অংশগ্রহণ করতে উত্তরায় তার বাসায় যাই। সেখানে বাংলাদেশের প্রধান-অপ্রধান অনেক লেখকের সঙ্গে আমাদের দেখা হয়। রিজিয়া আপা এত ভিড়ের ভেতর আমাদের খোঁজখবর নিতে এগিয়ে আসেন। একসময় অতিথিরা চলে যান। আবার আমাদের আড্ডা জমে ওঠে। আমাদের মনে হয়, মগবাজারের দিনগুলো ফিরে এসেছে। সত্তর দশকের হারিয়ে যাওয়া সেই মুহূর্তগুলো আমাদের পাশের চেয়ারে বসে থাকে। ২০১৬ সালের সেপ্টেম্বরে আপা কবি ও আমাকে দুপুরে খেতে ডাকেন। তপুও এলো একটু দেরিতে। সেদিন কবি রুবী রহমানও ছিলেন। আগের মতো টেবিল ভর্তি অনেক আয়োজন, কিন্তু আমরা আগের মতো খেতে পারি না। আমরা বুঝতে পারি, আমাদেরও বয়স হয়েছে। সময় তার নিষ্ঠুর ছাপ রেখে যায় সর্বত্র। সময় কাউকে ক্ষমা করে না। রিজিয়া আপা আর আগের মতো নেই। তিনি বলেন, ‘আমার দিন শেষ হয়ে এসেছে, কোন্ দিন পৃথিবী থেকে চলে যাই ঠিক নেই। নাসিম, তোমরা একদিন এসো।’ আমি এখন এলিফ্যান্ট রোডের একটি এ্যাপার্টমেন্টে থাকি। আমাদের পুরান ঢাকার বাড়িটায় আমার ছোটভাই থাকে, আমরা মাঝে মাঝে সেখানে যাই। এলিফ্যান্ট রোড থেকে উত্তরা যেতে দেড়/দুই ঘণ্টা সময় লাগে। তবুও একদিন আপার সঙ্গে দেখা করার জন্য আমি আর কবি উত্তরায় এক ভরদুপুরে গেলাম। আপা বাথরুমে পিছলে পড়ে ব্যথা পেয়েছেন। লাঠিতে ভর দিয়ে হাঁটেন। এই হলো মানুষের জীবন। আমার খুব মন খারাপ হয়ে যায়। তখন থেকে এখন, মাঝখানে চল্লিশটি বছর। কেমন করে হারিয়ে গেল আমাদের জীবন থেকে! আমরা, আমি আর কবি, আমরা এবং রিজিয়া আপা হারিয়ে যাওয়া দিনগুলো আর কোন দিন ফিরে পাব না!
×