ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

আকিল জামান ইনু

ইতিহাসের দায়মুক্তি ॥ এ্যালেন ট্যুরিং ॥ দ্য আনসাং হিরো

প্রকাশিত: ০৭:২১, ২ জুন ২০১৭

ইতিহাসের দায়মুক্তি ॥ এ্যালেন ট্যুরিং ॥ দ্য আনসাং হিরো

বিশ্বখ্যাত কম্পিউটার জায়ান্ট ও থিঙ্ক ট্যাঙ্ক এ্যাপেল ইন্কের বিখ্যাত লোগোটির উৎসকে ঘিরে আগ্রহের অন্ত নেই। অন্ত নেই মতামতের। বিশ্বজুড়ে সবচেয়ে প্রচলিত মতটি হচ্ছে এ্যাপেলের লোগোটি এ্যালেন ট্যুরিংয়ের মৃত্যু মুহূর্তটির প্রতীকী প্রকাশ। তবে লোগো ডিজাইনার কিংবা এ্যাপেল কর্তৃপক্ষ কেউই বিষয়টি স্বীকার করেননি। এ মতবাদে বিশ্বাসীদের নিবৃত্ত করতে এ্যাপেল কর্তৃপক্ষ বাধ্য হয়েছেন বিবৃতি দিতে। জানিয়েছেন এ্যালেন ট্যুরিংয়ের সঙ্গে কোনভাবেই সম্পর্কিত নয় তাদের লোগো। তবে বিষয়টি বিবৃতিতে থেমে যায়নি মোটেও। এ্যাপেলের অস্বীকৃতির মুখে স্টিফেন ফ্রাই যখন এ বিষয়ে এ্যাপেলের প্রতিষ্ঠাতা স্টিভ জবসকে চেপে ধরেন। জবসের কৌশলী উত্তর ছিল, ‘ঈশ্বর বিষয়টি যদি সত্যি হতো!’ জবসের এই হেয়ালিভরা উত্তর আর বিশ্বজুড়ে ট্যুরিং অনুরাগীদের বিশ্বাস একটি বিষয় স্পষ্ট করে- কম্পিউটার বিজ্ঞানে এ্যালেন ট্যুরিংয়ের অবদান। এবং সেটি এমন এক সময়ে যখন কম্পিউটার বিষয়টি ছিল ধারণাতীত। এ্যালেন ট্যুরিং যার মূল পরিচয় তিনি থিওরোরিটিক্যাল কম্পিউটার বিজ্ঞান এবং হালের বহুল আলোচিত কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার জনক। তার অবদান এ পর্যন্ত সীমাবদ্ধ থাকলেও তিনি ইতিহাসে ঠাঁই করে নিতেন নিশ্চিতভাবেই। কিন্তু ইতিহাসে তার আরেক অনন্য অবদান স্বদেশের পক্ষে বা বলা যায় মানবতার পক্ষ নিয়ে নাজি জার্মানদের পরাজয়ে নিজ ভূমিকা। খুব সহজ করে বললেও বলা যায়, ইউরোপে তিনি একাই দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধকে সংক্ষিপ্ত করেছেন দুই বছর, রক্ষা করেছেন অন্তত চৌদ্দ মিলিয়ন জীবন। যুদ্ধ পরবর্তী পুনর্গঠন বা অন্যান্য ক্ষয়ক্ষতি না হয় বাদ গেল। সেইসাথে ইতিহাসের কলংক এই যে, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের এই মহানায়ক যুদ্ধ পরবর্তী সময়ে নিজ দেশে হয়েছেন চরম লাঞ্ছিত। আইনের নিষ্ঠুর খড়গ তাকে ঠেলে দিয়েছে মৃত্যু মুখে। অস্বীকার করা হয়েছে তার অবদান। রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তার অজুহাতে লাল ফিতার অন্তরালে চাপা ছিল তার গবেষণা কর্ম। নির্মম হলেও সত্য যে, তাকে অস্বীকার করেও তার গবেষণা কর্মের ফল ভোগ করেছে তার স্বদেশ। কিন্তু তিনি এ্যালেন ট্যুরিং। হারিয়ে যাবার জন্য জন্মাননি। তার কর্ম, তার নিবেদন রাষ্ট্রকে বাধ্য করেছে মৃত্যুর সত্তর বছর পর তার সামনে নতজানু হয়ে ক্ষমা প্রার্থনা করতে। ইতিহাস সাক্ষী এ ক্ষমা প্রার্থনা যথেষ্ট নয়। বড় জোর বলা চলে রাষ্ট্রের পক্ষ থকে এই মহান সাধকের কাছে দায়মুক্তির চেষ্টা। যা প্রকারান্তরে ইতিহাসের দায়মুক্তি বলে চিহ্নিত হবে। এ্যালেন ট্যুরিং। গণিতবিদ, ক্রিপটোএনালিস্ট, যুক্তিবিদ্যা, কম্পিউটার বিজ্ঞান, জীব বিজ্ঞানের গাণিতিক ব্যাখ্যা, তৎকালীন সময়ে অভাবনীয় কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তাসহ বিচিত্র কর্মক্ষেত্রে অবাধ বিচরণ মাত্র একচল্লিশ বছরের জীবনে জন্ম ও বেড়ে ওঠা জন্ম মেডিয়া ভ্যালি, লন্ডন ২৩ জুন ১৯১২। পিতা জুলিয়াস ম্যাথিসন ট্যুরিং ছিলেন ভারতীয় সিভিল সার্ভিসে কর্মরত। মাতা ইথেল সারা। ছয় বছর বয়সে সেন্ট মাইকেল স্কুলে শিক্ষা জীবন শুরু। শৈশবে নিজ মেধায় চমকে দেন শিক্ষকদের যা অব্যাহত ছিল জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত। তেরো বছর বয়সে ভর্তি হন শেরবর্ন স্কুলে। তার স্কুল শুরুর দিনটি ছিল ১৯২৬ এর ব্রিটেনে বিখ্যাত ধর্মঘটের প্রথম দিন। অদম্য মনোবলের অধিকারী ট্যুরিং একা সাতানব্বই কিমি পথ সাইকেল চালিয়ে স্কুলে উপস্থিত হন। গণিত এবং বিজ্ঞান ছিল তার প্রথম প্রেম। এ প্রেমের কারণে স্কুলে তীব্র তিরস্কারের মুখোমুখি হয়েছেন অনেকবার; তবে ভালবাসার বিষয়ে আগ্রহ থেমে থাকেনি। চৌদ্দ বছর বয়সে ক্যালকুলাসের কোন প্রাথমিক ধারণা ছাড়াই এ্যাডভ্যান্স প্রবলেম সমাধান করেছেন অবলীলায়, ষোলো বছর বয়সে প্রশ্ন তুলেন এলবার্ট আইনস্টাইনের কিছু কাজ নিয়ে। প্রথম প্রেম শেরবর্নে ট্যুরিং প্রেমে পড়েন প্রথমবারের মতো ক্রিস্টোফার মরকমের যা তার প্রথম প্রেম বলে বিবেচিত। বলা হয় এই প্রেম তাকে গভীরভাবে অনুপ্রাণিত করেছে পরবর্তী দিনগুলোতে। ১৯৩০ এ মরকমের মৃত্যুর সঙ্গে পরিসমাপ্তি সে প্রেমের। তবে ট্যুরিং তা হৃদয়ে বয়ে বেরিয়েছেন। এমনকি তিনি মরকমের জননীকে এক পত্রে জানান, ‘মরকমের জন্য হলেও আমাকে আরও কঠিন পরিশ্রম করতে হবে। যাতে আমাদের স্বপ্ন পূরণ করতে পারি। আমি নিশ্চিত সেও তা চাইত আর সে আমার সঙ্গেই আছে।’ এ সময় তার মধ্যে ধর্ম আর বস্তুবাদ নিয়ে দ্বন্দ্বের শুরু হয়। আত্মা নিয়ে গভীর ভাবনার শুরুও সে সময় থেকে। যার সমাপ্তি এ সিদ্ধান্তে যে, আত্মা আর শরীর অঙ্গাঙ্গিভাবে সম্পর্কিত কিন্তু শরীর ছেড়ে যাওয়া বা মৃত্যুর পর আত্মা অন্য কোথাও তার ঠিকানা খুঁজে নেয়। ঊচ্চশিক্ষা শেরবর্নে অধ্যয়ন সমাপনান্তে তিনি কিংস কলেজ কেমব্রিজ এ যোগ দেন এবং বাইশ বছর বয়সে গণিত শাস্ত্রে প্রথম শ্রেণীতে সম্মান ডিগ্রী অর্জন করেন। ১৯৩৮ এ প্রিন্সটন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অর্জন করেন পিএইচডি। তার গবেষণাপত্র ‘সিস্টেম অফ লজিক বেসড অন অর্ডিনালস’ যা অর্ডিনাল লজিকের ভিত্তি স্থাপন করে। একই সঙ্গে রিলেটিভ কম্পিউটিংয়ের ধারণা দেয়। উদ্দীপ্ত করে ওরাকল। জন ভন নিউম্যান প্রিন্সটনে তাকে সহকারী হিসেবে চাইলেও তিনি স্বদেশে ফিরে যান। সে সময় তিনি গণিত নিয়ে কিছু উল্লেখযোগ্য কাজ করেন। দিত্বীয় বিশ্বযুদ্ধ ও ট্যুরিং তার জীবনের গৌরবোজ্জ্বল অধ্যায়ের শুরু দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়। সেপ্টেম্বর ১৯৩৮ এ তিনি খ-কালীন কর্মী হিসেবে যোগ দেন ব্রিটিশ কোড ব্রেকিং-অর্গানাইজেশনে। ব্লেচলি পার্কে তার ভূমিকা ছিল জার্মান গোপন বার্তার কোড ভেঙ্গে অর্থ উদ্ধার করা। নিজ মেধায় অচিরেই তিনি উঠে আসেন নেতৃত্বের ভূমিকায়। যুদ্ধকালীন ইতিহাসবিদ এসা ব্রিগস বলেন, ‘ব্লেচলিতে কাজ করতে হলে কেবল মেধাবী হলেই চলত না। হতে হতো ব্যতিক্রমী প্রতিভাবান আর ট্যুরিংয়ের তা ছিল।’ ডিলি নক্স কে সঙ্গে নিয়ে ট্যুরিং মনোযোগ দেন জার্মান ইনিগমা’র ক্রিপটোএনালাইসিসে। পোলিশ সাইফার ব্যুরো ব্রিটিশ কর্তৃপক্ষকে ইনিগমা রোটরস ও ইনিগমা কোড মেসেজ সম্পর্কে ১৯৩৯-এর জুলাইয়ে অবহিত করে। কোড ব্রেকিংয়ে নিরলস পরিশ্রম করে ট্যুরি ক্রিব-বেসড ডিক্রিপশন পদ্ধতির প্রচলন করেন। এবং কোড ব্রেকিংয়ের জন্য বোম্বির কার্যকর নমুনা তৈরি করেন। সেপ্টেম্বর ৪ ১৯৩৯ এ যুক্তরাজ্য জার্মানির বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করলে ট্যুরিং ব্লেচলি পার্কে রিপোর্ট করেন। যুদ্ধ চলাকালীন কোড ব্রেকিং নিয়ে তিনি ধারাবাহিকভাবে পাঁচটি উন্নত প্রযুক্তির উদ্ভাবন করেন, বোম্বি ছিল যার শুরু। যুদ্ধের শেষের দিকে তিনি উদ্ভাবন করেন বহনযোগ্য নিরাপদ ভয়েস স্ক্রাম্বল্যার। বিষয়টি শুনতে যতটা সহজ আদতে তা নয়। শত্রুপক্ষ যখন অনবরত বার্তা প্রেরণের কৌশল পরিবর্তন করছে তখন কয়েক কোটি সম্ভাবনা থেকে নির্দিষ্ট সূত্রটি খুঁজে বের করা আর অসাধ্য সাধন একই কথা। পাশাপাশি নিজেদের বার্তার গোপনীযতা রক্ষার দায়িত্ব তো আছেই। সে অসাধ্য সাধনে ট্যুরিং দুটি গবেষণাপত্র প্রণয়ন করেন। ‘দ্য এপ্লিকেশনস অব প্রোবাবিলিটি টু ত্রিপটোগ্র্যাফি : এবং “পেপার অন স্ট্যাটিসটিকস অব রিপিটেশন’ শিরোনামে। বিষয়টি এতই মূল্যবান যে ব্রিটিশ কর্তৃপক্ষ তার মৃত্যুর প্রায় সত্তর বছর পর ২০১২র এপ্রিলে তা সাধারণের জন্য উন্মুক্ত করে। এ বিষয়ে ব্রিটিশ সরকারের নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক কর্মকর্তা বলেন, ‘তার গবেষণা কর্ম সত্তর বছর ধরে আড়ালে রাখাই তার গুরুত্ব প্রমাণ করে। কেবল যুদ্ধ চলাকালীন নয় বিশ্ব যুদ্ধোত্তর ঠা-াযুদ্ধের সময়ও এর গুরুত্ব ছিল অপরিসীম।’ তিনি আরও বলেন, ‘কর্তৃপক্ষ নীরবে চুষে খেয়েছেন ট্যুরিংয়ের মেধা।’ বিচিত্র ট্যুরিং ব্লেচলি পার্কে ট্যুরিং সহকর্মীদের মধ্যে অভিহিত হতেন প্রফে: সম্বোধনে। আর ইনিগমা নিয়ে তার লেখনী পরিচিত ছিল ‘দ্য প্রফেসরস বুক’ নামে। জ্যাক গুড যিনি ছিলেন ট্যুরিংয়ের সহকর্মী তিনি ট্যুরিংয়ের বিচিত্র মানসিকতা আর মেধার বর্ণনায় বলেন, ‘প্রতি বছর জুনের প্রথম সপ্তাহে তিনি আক্রান্ত হতেন হে ফেভারে। তিনি তখন গ্যাস মাস্ক পরিধান করে সাইকেল চালিয়ে আসতেন অফিসে। তার সাইকেলে সমস্যা ছিল। কিছুটা দূরত্ব পাড়ি দিয়ে চেন পড়ে যেত। এর সমাধান তিনি করেন অন্যভাবে। তিনি গুনে বের করেন ঠিক কতবার প্যাডেলের পর চেইন স্থানচ্যুত হয়। আর সেই নির্দিষ্ট সংখ্যক প্যাডেল করে তিনি নিজে নেমে পড়তেন এবং তা ঠিক করে নিতেন চেইন পড়বার আগেই। আর মগটি রেডিয়েটরের সঙ্গে তালাবদ্ধ করে রাখতেন চুরি যাওয়ার ভয়ে।’ অসাধারণ শারীরিক সামর্থ্যরে অধিকারী ছিলেন। ব্লেচলিতে কাজ করাকালীন লন্ডনে উচ্চপর্যায়ের সভায় উপস্থিত হতেন ৬৪ কি.মি. দৌড়ে। ছিলেন দূরপাল্লার দৌড়বিদ। অলিম্পিক বিজয়ী ম্যারাথনারের সঙ্গে তার সময়ের ব্যবধান ছিল মাত্র ১১ মি.। সরাসরি চার্চিল ১৯৪১ এর শেষে এসে ট্যুরিং ও তার দল কিছুটা হতাশাক্রান্ত হয়ে পড়েন। তারা ততদিনে জার্মান ইনিগমা কোড ব্রেকিংয়ের একটি কার্যকর পদ্ধতি উদ্ভাবন করেছেন কিন্তু লোকবল ও কারিগরি সুবিধা সীমিত। কেবল সে গ্রীষ্মে স্বল্প সুবিধা নিয়ে তারা সমুদ্রে প্রতি মাসে এক লাখ টন মালামাল নিরাপদ করেন বিপক্ষের বার্তা উদ্ধার করে। কিন্তু তখনও তারা তীক্ষè ধার ছুরির ওপর দিয়ে হাঁটছেন। সাফল্য নিশ্চিত কিন্তু প্রয়োজনীয় যোগানের অভাব। নিরুপায় ট্যুরিং ২৮ অক্টোবর সরাসরি চিঠি লিখেন উইনস্টন চার্চিলের কাছে তাদের সমস্যা ও প্রয়োজনের কথা জানিয়ে। ট্যুরিং স্পষ্ট জানান, তাদের প্রয়োজন কতটা সামান্য আর কি অসামান্য অবদান তারা রাখতে পারেন সে প্রয়োজন পূরিত হলে। কেমন ছিল ট্যুরিংয়ের সে চিঠির প্রতিক্রিয়া? এন্ড্রু হগস, ট্যুরিংয়ের আত্মজীবনীকার জানাচ্ছেন ‘এ চিঠির প্রতিক্রিয়া ছিল তড়িৎ। চিঠি পড়ামাত্র চার্চিল জেনারেল ইসমেকে লিখিত নির্দেশ প্রদান করেন এই বলে। আজকেই ব্যবস্থা নিন। সর্বোচ্চ গুরুত্বের সঙ্গে এটি নিশ্চিত করুন তারা যা চাচ্ছে তা যেন পায়। এবং আমাকে জানান যে তা করা হয়েছে।’ ১৮ নবেম্বর সিক্রেট সার্ভিস প্রধান চার্চিলকে নিশ্চিত করেন সাম্ভাব্য সমস্ত সুবিধা নিশ্চিত করা হয়েছে। এর পর ট্যুরিং ও তার দলকে পিছু ফিরে তাকাতে হয়নি। এটি আজ প্রমাণিত যে যুদ্ধ কেবল সৈন্য বা অস্ত্রের বলে জেতা যায় না। শত্রুর যোগাযোগ ব্যবস্থা ভেঙ্গে দেয়া। শত্রুর গতিবিধি ও কর্মতৎপরতা সম্পর্কে আগাম জ্ঞান, শত্রুপক্ষের নিজেদের মধ্যে আদান-প্রদানকৃত তথ্য এবং শত্রুর বার্তায় হস্তক্ষেপ করে তাদের বিভ্রান্ত করাতেই অর্ধেক যুদ্ধ জয় সম্ভব। সেই সঙ্গে শত্রুর গতিবিধি জেনে নিজেদের জানমাল রক্ষা ও ক্ষতি এড়ানোর সুবিধা তো থাকলই। বিশ্বযুদ্ধের সারাটা সময় ট্যুরিং ও তার দল সচেষ্ট ছিলেন সে লক্ষ্যে। নেতৃত্ব দিয়েছেন হাট ৮এর। তিনিই প্রথম যিনি জার্মান নেভাল ইনিগমা মোকাবেলার সিদ্ধান্ত নেন। তার ভাষায় ‘কেউ এ ব্যাপারে কিছু করতে পারছিল না তাই শেষ পর্যন্ত আমাকেই এগিয়ে আসতে হয়।’ আর ডিসেম্বর ১৯৩৯ এ তিনি মূল সমস্যার সমাধান করে ফেলেন। এটি পরিষ্কার যুদ্ধ জয়ে এ্যালেন ট্যুরিংয়ের অবদান কোন জেনারেল কিংবা রাষ্ট্রনায়কের চাইতে বেশি বৈ কম নয়। তিনি দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের অন্যতম মহানায়ক। সে সময় ১৯৪১ এ ট্যুরিং-এর জীবনে প্রেম আসে আবার। তিনি হাট-৮-এ তার সহকর্মী জোয়ান ক্লার্ক কে বিয়ের প্রস্তাব করেন। কিন্তু তাদের এনগেজমেন্ট ভেঙ্গে যায় যখন ট্যুরিং এর ফিয়াসের কাছে সমকামিতার বিষয়টি সামনে আসে । ১৯৪২এ ট্যুরিং যুক্তরাষ্ট্র সফর করেন আমেরিকান নেভীকে সহায়তার জন্য। সে সময় তিনি পরিদর্শন করেন ডেটনস্থ কম্পিউটার মেশিন ল্যাবরেটরি। বেল ল্যাবরেটরিতে নিরাপদ স্পীচ ডিভাইস তৈরিতে ভূমিকা রাখেন। যুদ্ধ পরবর্তী জীবন ১৯৪৬-এ এ্যালেন ট্যুরিং তার যুদ্ধকালীন ভূমিকার জন্য রাজা জর্জ ৬-এর কাছ থেকে লাভ করেন সর্বোচ্চ ব্রিটিশ খেতাব। অর্ডার অব ব্রিটিশ এম্পায়ার বা ও,বি,ই। কিন্তু তার কাজ অন্তরালেই থেকে যায়। ১৯৪৫ থেকে ৪৭ পর্যন্ত ট্যুরিং মনোনিবেশ করেন অটোমেটিক কম্পিউটিং ইঞ্জিনের ডিজাইন তৈরিতে। কাজ করেন ন্যাশনাল ফিজিক্যাল ল্যাবটেরিতে। ১৯ ফেব্রুয়ারি ১৯৪৬ এ বিস্তারিত বর্ণনাসহ উপস্থাপন করেন স্টোরড প্রোগ্রাম কম্পিউটারের ডিজাইন। কিন্তু এসিই নিয়ে তার পূর্বে ব্লেচলি পার্কে যুদ্ধকালীন করা কাজের গোপনীয়তার মুখে পড়ে হতাশ হয়ে কেমব্রিজে ফিরে আসেন। ১৯৪৭ এ যান্ত্রিক বুদ্ধিমত্তা নিয়ে তার প্রবন্ধ উপস্থাপনা করেন যদিও তার জীবদ্দশায় তা প্রকাশিত হয়নি। প্রথম এসিই নির্মিত হয় ১০ মে ১৯৫০ এ। তবে এ.সি,ইর পরিপূর্ন সংস্কারন তৈরি হয় তার মৃত্যুর পর। ১৯৪৮ এ যোগদেন ভিক্টোরিয়া ইউনিভাসিটি অব ম্যানচেস্টারে। ১৯৪৯ এ সেখানকার কম্পিউটিং মেশিন ল্যাবরেটরিতে যে সফটওয়্যার নিয়ে কাজ করেন তা একেবারেই প্রাথমিক স্টোরড কম্পিউটার এর যা আজো পরিচিত ম্যানচেষ্টার মার্ক-১ নামে। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা ম্যানচেষ্টার মার্ক-১ এর পর অ্যালেন ট্যুরিং গনিতের আরও বিমূর্ত দিকের প্রতি ঝুকে পরেন। ১৯৫০ এ তিনি প্রথম কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা বিষয়টি সামনে আনেন। এবং মেশিনের বুদ্ধিমত্তা নির্নয়ে পরীক্ষা উদ্ভাবন করেন। যা ট্যুরিং টেস্ট নামে পরিচিত। ট্যুরিং তার গবেষনা পত্রে প্রথম উল্লেখ করেন মেশিনের বুদ্ধিমত্তার প্রাথমিক ধাপ। এই ট্যুরিং টেস্ট এর আধুনিক রূপ ‘ক্যাপাচা’ যা ব্যবহৃত হয় ইন্টারনেটে রোবট আর মানুষ নির্ধারনে। কম্পিউটার চেস ও ট্যুরিং ১৯৪৮ এ ট্যুরিং কম্পিউটার চেস প্রোগামের উপর কাজে শুরু করেন। যা সমাপ্ত হয় ১৯৫০ এ। ১৯৫২ তে তিনি প্রনয়ন করেন ফেরান্টি মার্ক-১। কিন্তু কম্পিউটারের পর্যাপ্ত সক্ষমতার অভাবে তা সফল হয় নি। তবে ট্যুরিং একটি গেম খেলতে সক্ষম হন। প্রতিটি চালে মেশিন সময় নিয়েছে আধঘন্টা। এটির রের্কড সংরক্ষিত আছে। এই চেস ছিল মেশিনের বুদ্ধিমত্তার অন্যতম সূত্রপাত। আজ এই ২০১৭ তে বিভিন্ন পরাশক্তি বা জায়ন্ট কোম্পানী যখন কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা নিয়ে প্রতিযোগতায় লিপ্ত তখন অ্যালেন ট্যুরিং এর মেধার সামনে সভ্যতার নত হওয়া ছাড়া কোন বিকল্প নেই। গানিতিক জীব বিজ্ঞান ১৯৫১ তে মাত্র ৩৯ বছর বয়সে তিনি জীববিজ্ঞানের গানিতিক ব্যাখ্যায় ঝুঁকে পরেন। তার অমর কৃতি ‘দ্য মেকিক্যাল বেসিস অব মরফোজেনেসিস।’ তবে এ বিষয়ে তখন ব্যাপক ধারনা না থাকায় ও কারিগরী সুবিধার অভাবে বিষয়টি সেভাবে প্রাধান্য পায়নি। আজ এটি স্বীকৃত যে তার দেখানো পথ বিজ্ঞানের এ ক্ষেত্রে ভিত্তি স্থাপন করেছে। জীববিজ্ঞান কে এগিয়ে দিয়েছে একধাপ। আর এটাও প্রমাণিত অ্যালেন ট্যুরিং নিজ সময় থেকে অনেক এগিয়ে থাকা এক বিজ্ঞান সাধকের নাম। এ্যালান ট্যুরিং বির্তক ও সাজা জানুয়ারী ১৯৫২ তে ট্যুরিং তার গৃহে আশ্রয় দেন ১৯ বছর বয়সী বেকার যুবক আনল্ড ম্যুরেকে। এক সাথে বসবাসকালীন ২৩ শে জানুয়ারী ট্যুরিং এর বাড়িতে চুরি হলে তিনি বিষয়টি পুলিশে রির্পোট করেন। তদন্তের এক পর্যায়ে পুলিশ ট্যুরিং এর বিরুদ্ধে সমকামিতার অভিযোগ আনয়ন করে। উল্লেখ্য সে সময়ে ব্রিটেনে সমকামিতা ছিল ফৌজদারী অপরাধ। সে মামলা রোজিনা বনাম ট্যুরিং এন্ড ম্যুরে ৩১ তে মার্চ ১৯৫২ তে বিচারের জন্য আসে। তার আইন জীবীর নিস্পৃহতা ও ভাইয়ের সাক্ষ্যে ট্যুরিং কে সাজা প্রদান করা হয়। তাকে কারাগার অথবা রাসায়নিক চিকিৎসা দুটির একটি বেছে নিতে বলা হয়। তিনি দীর্ঘ যন্ত্রনাদায়ক রাসায়নিক চিকিৎসা বেছে নেন যার পরিনতি ছিল ভয়াবহ, পুরুষত্বহীনতা। রাষ্ট্রীয় নির্যাতন সাজা প্রাপ্তির পর দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের এই বীর চরম অবহেলার শিকার হন নিজ রাষ্ট্রে। সাজার কারনে তার রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তা অনুমোদন প্রত্যাহার করা হয়। দীর্ঘদিনের কর্মস্থল জিসিএইচকিউ এ কাজ করার অধিকার হারান। তার উদ্ভাবিত সমস্ত কর্ম নিয়ে আলোচনা পর্যন্ত রাষ্ট্রীয় নিষেধাজ্ঞার বেড়াজালে আটকে যায়। যে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে তিনি দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সাহায্য করেন সেখানে তার প্রবেশ নিষিদ্ধ হয়। ব্লেচলি পার্কে কর্মরত সবার বিরুদ্ধে এসপিত্তনাজ এর অভিযোগ থাকলেও ট্যুরিং তা থেকে মুক্ত ছিলেন বরাবর। যা সত্যি অবাক করার মত। তবে তা থেকে এটিও প্রমাণিত হয় তিনি ছিলেন একনিষ্ট বিজ্ঞান সাধক অন্য কিছুতে তার আগ্রহ ছিল না। আবার চেস অ্যালগারিদম ১৯৫০ এ তার চেস প্রোগ্রাম কম্পিউটারের সক্ষমতার অভাবে সফল হয়নি। ১৯৫৩ তে তিনি আবার প্রণয়ন করেন কম্পিউটার চেস প্রোগ্রাম। সে প্রোগ্রামকে গ্যারি ক্যাসপারভ বর্ণনা করেছেন, ‘একটি প্রকৃত চেস গেম’ বলে। রহস্যাবৃত মৃত্যু ৮ জুন ১৯৫৪ তাকে নিজ গৃহে মৃত দেখতে পান তার গৃহ পরিচারিকা। ধারণা করা হয় আগের দিন মৃত্যু হয়েছে তার । তার মাথার কাছে পাওয়া যায় আধখাওয়া আপেল। পোস্টমর্টেম এ বলা হয় মৃত্যুর কারণ সায়ানাইড বিষক্রিয়া। যদিও আপেলটি পরীক্ষা করা হয়নি। অনেকেই বলে থাকেন রাষ্ট্রীয় সাজা হিসেবে যে ইনজেকশন তিনি গ্রহণ করেছেন তার মৃত্যুর কারণ সেটাই। অনেকে বলে এটি সরাসরি হত্যাকা- এবং দায়ী তার রাষ্ট্র। রাষ্ট্র বলছে আত্মহত্যা! যদি আত্মহত্যাও হয় তার মত অদম্য মনোবলের মানুষ কেন এ পথ বেছে নিলেন সে প্রশ্ন উঠতেই পারে। রাষ্ট্রীয় নিপীড়ন তার প্রধান কারণ। তার মৃত্যু রহস্য উদঘাটনে রাষ্ট্রীয় অবহেলা কিন্তু ভিন্ন বার্তা দেয়। যাই ঘটুক বিজ্ঞানের, সভ্যতার ইতিহাসে এ মৃত্য রহস্যাবৃত হয়েই রইবে। মৃত্যু ও ইতিহাসের দায়মুক্তি চরম অবহেলায় মৃত্যুর পর ধ্বংসস্তূপ থেকে ফিনিক্স পাখির মতই জেগে উঠেন অ্যালেন টুরিং। রয়েল সোসাইটি প্রকাশ করে তার আত্মজীবনী। ১৯৬৬ তে ‘এ্যাসোসিয়েশন ফর কম্পিউটিং মেশিনারি’ প্রচলন করে ‘ট্যুরিং এওয়ার্ড’ যা আজ কম্পিউটার বিশ্বে নোবেল পুরস্কার বিবেচিত। তার জন্ম ও কর্মস্থল ‘ইংলিশ হেরিটেজ ব্লু প্লাঙ্ক’ দ্বারা চিহ্নিত। বিবিসি যে চারজন গনিতবিদকে বিপদজনক জ্ঞানের অধিকারী বলে চিহ্নিত করে ডকুমেন্টরী তৈরি করে তার একজন অ্যালেন ট্যুরিং। আর প্রিন্সটন বিশ্ববিদ্যালয় তাকে দ্বিতীয় সেরা প্রাক্তন ছাত্রর মর্যাদা দিয়েছে তাদের ইতিহাসে। যার প্রথম স্থানটি প্রেসিডেন্ট জেমস ম্যাডিসনের। ২০০২ এ গণভোটে ঠাঁই করে নেন সেরা ১০০ ব্রিটিশ নাগরিকের তালিকায়। সরকারী ক্ষমাপ্রার্থনা ও মার্জনা ২০০৯ এ সারা ব্রিটেন জুড়ে ব্যাপক দাবি উচ্চারিত হয় সমকামিতার অভিযোগে অ্যালেন ট্যুরিং এর বিচার ও সাজার বিরুদ্ধে। বাধ্য হয়ে প্রধানমন্ত্রী গর্ডন ব্রাউন বিবৃতি দিয়ে ক্ষমা প্রার্থনা করেন এবং তার সাজাকে বেদনাদায়ক নৃশংস আখ্যা দেন। তিনি বলেন, ‘অ্যালেন ট্যুরিংকে যে আইনের আওতায় বিচার করা হয়েছে, আমরা ঘড়ির কাটা পেছনে নিয়ে সে সময়ে ফিরতে পারব না। নিঃসন্দেহে তার সাথে যা করা হয়েছে তা অনুচিত। আমি অন্তত দুঃখ প্রকাশের সুযোগ পেয়ে আনন্দিত।. . . কাজেই ব্রিটিশ সরকার ও সকল মুক্ত মানুষের পক্ষ থেকে আমি বলছি অ্যালেন তোমার অবদানের জন্য ধন্যবাদ। এ কথা বলতে পেরে আমি গর্বিত : আমরা দুঃখিত অ্যালেন এ আচরণ তোমার প্রাপ্য ছিল না।’ কিন্তু ক্ষমা প্রার্থনা যথেষ্ট ছিল না। দাবি ছিল মৃত্যু পরবর্তী হলেও ট্যুরিং এর দায় মুক্তির। সে দাবিতে উত্তাল ব্রিটেন। দাবির পক্ষে স্টিফেন হকিং পর্যন্ত মাঠে নামেন। বহু জল গড়িয়ে ২৪ ডিসেম্বর রানী এলিজাবেথ-১১ অ্যালেন ট্যুরি এর অপরাধ মার্জনা করে আদেশ জারি করেন। দায়মুক্ত হয় সভ্যতা, ইতিহাস। ১৯৯৯ এ টাইম ম্যাগাজিন অ্যালেন ট্যুরিংকে বিংশ শতাব্দীর প্রভাবশালী-১০০ তালিকায় ঠাঁই দিয়ে বলে, ‘আজ আমরা যারা কম্পিউটার কি-বোর্ডে ট্যাপ করে স্প্রেডসিট বা ওয়ার্ড প্রসেসিং প্রোগ্রাম খুলছি নিঃসন্দেহে তারা ক্রশবিদ্ধ ট্যুরিং এর হৃদয়ে পেরেক ঠুকছি।’ উল্লেখ্য তখনও রাষ্ট্র ক্ষমা প্রার্থনা করেনি। টাইমের এই মন্তব্য প্রমাণ করে কম্পিউটার বিশ্বে ট্যুরিং কতটা প্রাসঙ্গিক আর ক্ষমা প্রার্থনা কতটা জরুরী ছিল।
×