ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

সব্যসাচী দাশ

চোখ জুড়ানো কান্তজিউর মন্দির

প্রকাশিত: ০৭:২০, ২ জুন ২০১৭

চোখ জুড়ানো কান্তজিউর মন্দির

সময়টা ছিল ফাগুন মাস। যে কারণে, প্রকৃতি তখনও খুব একটা উত্তপ্ত হয়নি। ভ্রমণের জন্য সময়টা ছিল উত্তম। হঠাৎ করেই সুযোগ হয় দিনাজপুরে যাবার। ছোটবেলা থেকেই উত্তরের সমৃদ্ধ জেলা দিনাজপুরে যাবার একটা শক্ত ইচ্ছা মনের মধ্যে ধারণ করতাম। স্কুলে যখন পড়তাম রাতে বাংলাদেশ টেলিভিশন (বিটিভি) এর বিভিন্ন অনুষ্ঠান দেখতাম। বাংলাদেশের সুন্দর সুন্দর জায়গার জীবন যাপন নিয়ে প্রচারিত হতো প্রামাণ্য অনুষ্ঠান। সেই প্রামাণ্য অনুষ্ঠানে দিনাজপুরকে প্রায়ই দেখতাম। কখনও কান্তজিউর মন্দির, কখনও রামসাগর, কখনও দিনাজপুর রাজবাড়ীর চিত্র টেলিভিশনের ছোট্ট পর্দায়। টিভিতে দিনাজপুরের রূপ দেখে মোহে আচ্ছন্ন হতাম। আর কবে অমন সুন্দর জায়গায় যাব তার দিন গুনতাম। আমার এই অল্প বয়সে বাংলাদেশের বেশিরভাগ অঞ্চল দেখেছি, উত্তরের ষোলো জেলার মধ্যে দিনাজপুরের সৌন্দর্য যে একেবারে অন্যরকম তা চোখে দেখে ঢেড় আঁচ করতে পেরেছি। রাতে হানিফ পরিবহনের গাড়িতে ঢাকা থেকে দিনাজপুরের উদ্দেশে রওনা হই। ভোর ছয়টা নাগাদ শহরে পৌঁছাই। গাড়ি থেকে নেমে রিক্সা নিয়ে মালদাহপট্টি যাই সেখানে অল্প টাকায় হোটেল রুম মেলে। হোটেলে ব্যাগ রেখে ফ্রেশ হয়ে নাস্তার জন্য বাইরে বের হই, নামতেই হাতের বায়ে একটা খাবার হোটেল মেলে। ঘড়িতে তখন সাতটা বাজতে পঁচিশ মিনিট বাকি। হয়ত, সে কারণে হোটেলের সব খাবার রেডি হয়নি। পরোটা মিষ্টি দিয়ে শেষ করলাম সকালের খাবার। নাস্তা শেষে বড় এককাপ চা নিলাম। চা খেতে খেতে সময় গুনতে থাকলাম। কখন বেলা বাড়বে আর শহরের বাইরে বেরুতে পাড়ব। শেষে চা খেয়ে কিছু অলস সময় পার করে রিক্সা নিয়ে বাসস্ট্যাডে গেলাম। আগে থেকেই প্লান করা ছিল, যেহেতু একবারে পুরো জেলা দেখা শেষ করতে পারব না তাই, কান্তজিউর মন্দির, রামসাগর, আর হাতে সময় থাকলে রাজবাড়ীটা চোখ জুড়িয়ে দেখে নেব। এর মধ্যে কান্তজিউর মন্দির আর রামসাগর আমার ভ্রমণ তালিকায় শীর্ষে অর্থাৎ আর যাই হোক এ দুটা দর্শনীয় স্থান কোনভাবেই মিস করা যাবে না। আমি আগেই জানতাম শহর থেকে প্রায় ১২ কিলোমিটার দূরে কান্তনগর সেখানে বাস থেকে নেমে খানিক পথ হেঁটে ভ্যানে চরলে মিলবে আর্শ্চয মন্দিরের দেখা। বাসে ১৫ টাকা ভাড়া দিয়ে বেলা ১১ টার দিকে কান্তনগরে নামলাম। পরিষ্কার আকাশে রবী কিরণ ছিল স্পষ্ট। দিনাজপুর ঠাকুরগাঁও হাইওয়ের ডান পাশে নেমে রাস্তা পাড়ি দিয়ে একটা ছোট পাকা ব্রিজ নিচে আধমরা একটা ছোট খালসদৃশ্য নদী। ব্রিজ শেষে মাটির রাস্তা একজন-দু’জন করে মানুষ চলাচল করছিল। শান্ত নিরিবিলি পরিবেশ মনের মধ্যে একটা চাপা উত্তেজনা উপলদ্ধি করছিলাম। কিছু দূর হেঁটে ফিরতি পথচারীর কাছে জিজ্ঞাসা করলাম মন্দির যেতে কত পথ বাকি। উত্তরে পথিক বলল এই তো সামনেই। মন্দিরের কাছাকাছি আসতেই একটা প্রায় ভাঙ্গা ধ্বংসাবশেষ মন্দির চোখে পড়ল, আমার তখন বুঝতে আর বাকি রইল না আমি চলে এসেছি আমার কাক্সিক্ষত গন্তব্যে। কয়েক পা হাঁটার পর দেখলাম গাছগাছালিতে ঘের বেশ বড় একটা জায়গা তার বাইরে কয়েক জন মানুষ ঢুকছে আর বের হচ্ছে। আরও সামনে এগিয়ে একটা ছোট গেট তার পাশে মিশমিশে কালো গায়ের রং এক সাঁওতাল মহিলা সিঁদূর, আবির ছোট বড় বিভিন্ন দেব দেবীর বিগ্রহ একটা অপরিষ্কার পলিথিনের ওপর ছোট্ট পসরা সাজিয়ে ক্রেতা দর্শনাথীরদের অপেক্ষা করছে। সত্য বলতে মন্দিরে প্রবেশের আগে ওই সাঁওতাল দোকানিকে দেখে আমার মধ্যে এক রকম বিষ্ময় জেগে ছিল রাতের গায়ের রং মহিলাটির কিন্তু চোখ দুটি ভরা পূর্ণিমার চাঁদেও মতো উজ্জ্বল। ভ্রমণের অনেক দিন পর্যন্ত ওই সাঁওতালী মহিলাকে আমার মনে ছিল। বাম দিক থেকে মোড় ঘুরে মন্দিরে প্রবেশ করি, ঢুকেই যা আমি দর্শন করলাম তা এই ছোট্ট জীবনে অমূল্য রতœ দর্শন তুল্য মনে হলো। আহা কী শোভা মন্দিরের! কী কারুকাজ মন্দিরের শরীরে, যেন কোন পৃথিবীখ্যাত চিত্রশিল্পী তার মনের কল্পনার সব রং, সব রস মিশিয়ে মনের মানসপটে মন্দিরের এই চিত্রটি এঁকেছেন। রামায়ণ মহাভারতের পৌরাণিক কাহিনীর সকল দৃশ্যপটই মন্দিরের গায়ে গায়ে টেরাকোটায় অঙ্কিত। ঘুরে ঘুরে একেবারে কাছ থেকে মন্দিরের রূপ রস পান করছিলাম এমন সময় এক পূজারী বলল বাবু ‘যাবার আগে প্রসাদ নিয়ে যাবেন’। প্রসাদ বলতে আমার ধারণা ছিল ফলফলাদি হবে। কিন্তু যখন মূল মন্দিরের পাশে ছোট্ট একটা ঘরে প্রসাদ নেবার জন্য প্রবেশ করলাম আমাকে দেখেই একজন বলল আপনি ওই খানটায় বসেন আমি বসে পড়লে সামনে একটা কলার পাতায় প্রসাদ দেওয়া হলো, পাতায় খেতে দেয়া প্রসাদ দেখে আমি তো তাজ্জব! প্রসাদের নাম এ কী খাবার। পাতার মাঝ খানে ভাত তার চারপাশে একাধিক রকমের সবজি সঙ্গে কচু শাখ, পালং শাখ, কাচা কলার তরকারি সঙ্গে মিষ্টান্ন। প্রসাদের নামে এমন খাবার পেয়ে সত্যই বিমোহিত। প্রসাদ গ্রহণ শেষে ২০ টাকা দক্ষিণা দিয়ে, আর একবার চোখ এবং হাত বুলালাম কান্তজিউর মন্দিরের শরীরে। বিদায় হে শৈশব থেকে লালন করা স্বপ্নের মন্দির। মন্দিরের সংক্ষিপ্ত পরিচিতি : খ্রিস্টীয় সতেরো শতকে এই মন্দিরের নির্মাণ কাজ শুরু করে তৎকালীন জমিদার প্রাণনাথ রায়। তাঁর মৃত্যুর পর পোষ্যপুত্র মহারাজা রামনাথ রায় ১৭৫২ খ্রিস্টাব্দে পিতার শেষ ইচ্ছানুযায়ী নির্মাণ শেষে করেন। মন্দিরের উচ্চতা ৭০ ফুট। মন্দিরের গায়ে হিন্দু পুরাণের কাহিনী টেরাকোটায় অঙ্কিত। ১৮ শতকের ভুমিকম্পের কবলে পড়ে মন্দিরের চূড়া অনেক অংশ ভেঙ্গে পড়ে। মন্দিরটি এখন তিন তলাবিশিষ্ট, নিচের ভিতটা পাথর দিয়ে নির্মত। মন্দির নিচতলায় ২১টি এবং দ্বিতীয় তলায় ২৭টি দরজা, তৃতীয় তলায় রয়েছে ৩টি দরজা, প্রতিদিন দুপুর ১২টা থেকে ১টার মধ্যে পূজা হয়। আপনি এই সময়ের মধ্যে গেলে পূজায় অংশগ্রহণ করতে পারবেন। প্রতিদিন দূর-দূরান্ত থেকে বেশ দর্শনার্থী আসে। বাংলাদেশ পর্যটন কর্পোরেশন এই সুন্দর মন্দিরটির রক্ষণাবেক্ষণ করছে। যাবার বন্দোবস্ত : ঢাকার শ্যামলী থেকে প্রতিদিন হানিফ, শ্যামলী ও নাবিল পরিবহনের একাধিক গাড়ি দিনাজপুর সদরের উদ্দেশ্যে যাচ্ছে। ভাড়া ৫০০ থেকে ৫৫০ টাকা। দিনাজপুর সদর থেকে ঠাকুরগাঁও গাড়িতে উঠলেই আপনি কান্তনগরে নামতে পারবেন। কান্তনগর নেমে মন্দিরে যেতে আপনার সময় লাগবে মাত্র ১০ থেকে ১২ মিনিট হাঁটার পথ। আপনি চাইলে অবশ্য ভ্যানেও চড়তে পারেন। দিনাজপুর সদরে হোটেল ভাড়া সিঙ্গেল (একা থাকার জন্য) রুম পাওয়া যাবে ২০০ থেকে ৪৫০ টাকার মধ্যে। ফ্যামিলি রুমও আছে তার ভাড়া অবশ্য একটু বেশিই পড়বে ৫০০ থেকে ১২০০টাকার মধ্যে। এই ভ্রমণের দ্বিতীয় কিস্তি রামসাগরের অংশ সামনের সংখ্যায় প্রকাশিত হবে।
×