ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪৩১

নারী কুস্তিগীর কল্পনা

প্রকাশিত: ০৭:১৯, ২ জুন ২০১৭

নারী কুস্তিগীর কল্পনা

১৯৮৬ সাল। ইংরেজী এই অধিবর্ষটা বাংলাদেশের অখ্যাত এক বালিকার জীবনের মোড় ঘুরে যাবার বছর। নাম তার কল্পনা আক্তার। ওই বছরই সে মাত্র ১২ বছর বয়সে আনসার ও ভিডিপির হয়ে চাকরি জীবন শুরু করে, ওই বছরই তার খেলোয়াড়ি জীবন শুরু এবং ওই বছরেই তার বিয়ে হয়। তারপর পেরিয়ে গেছে সুদীর্ঘ ৩১ বছর। সেদিনের বালিকা কল্পনা আজ ৪৫ বছরের পৌঢ়া। মাত্র ৪১৬ টাকা বেতন দিয়ে চাকরি জীবন শুরু। এখন বেতন পাচ্ছেন সাড়ে ১০ হাজার টাকা। এ টাকায় সংসার চলে না। কারণ স্বামী বেকার। তিনিই সংসারের একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তি। দুই ছেলে ও এক মেয়ে তাঁর। এর মধ্যে অনেক কষ্ট করে বিয়ে দিয়েছেন এক ছেলে ও এক মেয়ের। এখনও চালিয়ে যাচ্ছন খেলোয়াড়ি অধ্যায়। ৩১ বছরে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে বিভিন্ন খেলা খেলে লাভ করেছেন প্রভূত সাফল্য। জুডো ও কুস্তি খেলে অর্জন করেছেন মোট ৬০টির বেশি স্বর্ণপদক! এর ২৫টিই জাতীয় পর্যায়ে। মোট পদকের বেশিরভাগই জিতেছেন জুডোতে। আনসারের এই মহিলা কুস্তিগীরের খেলোয়াড়ি জীবন শুরু হয় হকি দিয়ে! খেলতেন গোলরক্ষক পজিশনে। আনসারের হয়ে অনেক মহিলা হকি প্রতিযোগিতায় অংশ নিয়েছেন। তাকে সবাই নাম দিয়েছিল ‘পঙ্খিরাজ’!’ শুধু তাই নয়, খেলেছেন আরও অনেক খেলাই। তালিকাটা বেশ দীর্ঘইÑ বাস্কেটবল, তায়কোয়ান্দো, উশু, কারাতে, কুস্তি ও জুডো! তখন বয়স কম ছিল। সব খেলাই খেলতেন মনের আনন্দে। ভালই খেলতেন। শেষে স্থির হন জুডো ও কুস্তিতে। প্রথম পছন্দ জুডো। এই ইভেন্টে সর্বশেষ সাফল্য ২০১৩ সালে আনসারের হয়ে বাংলাদেশ গেমসে স্বর্ণজয় (৭৮+ ওজন শ্রেণীতে)। ক্যারিয়ারের প্রথম স্বর্ণ ১৯৮৯ সালে জাতীয় পর্যায়ে ৪৮ কেজি ওজন শ্রেণীতে। তখনকার সেরা জুডোকো নয়না চৌধুরীক হারিয়ে রীতিমতো আলোড়ন সৃষ্টি করেন। এরপর ৫২ কেজিতেও আরেকটি গোল্ড মেডেল পান। কল্পনার এ কৃতিত্বে মহাখুশি হয়ে আনসারের তৎকালীন ডিজি তাকে ২০ হাজার টাকা পুরস্কার দিয়েছিলেন। কুষ্টিয়ার ভবানীপুরের ভেড়ামারার সাতবাড়িয়ার মেয়ে কল্পনা। থাকেন গাজীপুরের শফিপুরে। অনেক বছর ধরে খেললেও এখনও অবসর নেয়ার কথা ভাবছেন না। তার ব্যক্তিগত লক্ষ্যÑ অন্তত আগামী বাংলাদেশ গেমস পর্যন্ত খেলা চালিয়ে যাওয়া। তার শৈশবের গল্প সিনেমার কাহিনীকেও হার মানায়। কল্পনাদের পরিবার খুবই গরিব। বাবা মীরজান আলী দিনমজুরি করেন। এতে সংসার চলে না। কল্পনা করতেন কি, মাঠে যাদের মোষ চড়ে বেড়াত, সেই মহিষের পিঠে চড়ে বসতেন। ওই অবস্থাতেই লেখাপড়া করতেন! শুধু তাই নয়, খিদের জ্বালায় মোষের দুধ পান করতেন! মহিষ তাকে কিছুই বলত না। নাইট স্কুলে প্রাইভেট পড়তেন। পড়ার অনেক শখ ছিল। কিন্তু অর্থের অভাবে মেট্রিক পরীক্ষা দিতে পারিননি। খেলতে খুবই ভালবাসতেন। ইচ্ছে হতো একদিন খেলোয়াড় হবেন, সেটা যে কোন খেলাতেই হোক না কেন। সেটা হতে পেরেছেন। খেলাটা তার কাছে এখনও নেশার মতো। এখনও রাষ্ট্রীয় পুরস্কার পাননি বলে হতাশা-আক্ষেপে পুড়ছেন কল্পনা। ‘জুডোতে চারবার রেকর্ড গড়েছি। খেলা ছাড়ার আগে যদি রাষ্ট্রীয়ভাবে পুরস্কৃত হতাম, তাহলে আমার সব চাওয়া পূরণ হতো। জানি না কপালে তা লেখা আছে কিনা।’ এখনকার মহিলা কুস্তিগীর বা জুডোকারা ফিটনেস নিয়ে মাথা ঘামায় না বলে অভিমত ব্যক্ত করেন কল্পনা। ‘ফিটনেসের জন্য এখনও তো সবাই আমাকে টাইগারের বাচ্চা বলে’- কল্পনার গর্বিত উচ্চারণ। খেলতে গিয়ে তিনবার বাঁ পা, একবার ডান হাত ও দুবার বাঁ হাত ভেঙেছেন। তবুও দমে যাননি কল্পনা। দাঁতে দাঁত চেপে এগিয়ে গেছেন অভীষ্ট লক্ষ্যের পানে। ভারতের লক্ষেèৗ, উড়িষ্যা, ইন্দোর ও কলকাতায় খেলার অভিজ্ঞতাসম্পন্ন কল্পনার রাষ্ট্রীয় পুরস্কার পাবার কল্পনা বাস্তবে ফলবে কি?
×