ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

নাজনীন বেগম

নিরাপদ মাতৃত্ব

প্রকাশিত: ০৭:১৮, ২ জুন ২০১৭

নিরাপদ মাতৃত্ব

‘নিরাপদ মাতৃত্ব দিবস’ পালনের মধ্য দিয়ে সারাদেশে মায়ের যে সচেতনতা, সন্তানের প্রতি মায়ের মমতাঘন দায়বদ্ধতা সঙ্গে মা হওয়ার স্বাপ্নিক অনুভূতি সর্বোপরি সন্তান প্রসবের সময় নিরাপত্তা নিশ্চিতকরণের ওপরও বিশেষ জোর দেয়া হয়। সমাজ উন্নয়নের নিরন্তর গতিধারায় এগিয়ে যাচ্ছে। সর্বসাধারণের সার্বিক অংশগ্রহণ এই অগ্রযাত্রাকে আরও বেগবান করছে। সমাজের অর্ধাংশ নারী, তাদের সঙ্গে নিয়েই প্রবৃদ্ধির জয়যাত্রা সুনিশ্চিত করতে হবে। উন্নয়নশীল দেশের মেয়েরা সমাজের অগ্রগতির সঙ্গে তাল মেলালে ও নানা মাত্রিক সমস্যার আবর্তেও পড়ে। আমাদের দেশে নারীরা উন্নয়নের বিভিন্ন সূচক গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখে যাচ্ছে সেটা যেমন ঠিক পাশাপাশি এমন অনেক সামাজিক হুমকির মুখোমুখি হয়ে জীবন চালাতে হয় তারও কোন ইয়াত্তা নেই। বাংলাদেশ এখনও কৃষিনির্ভর গ্রামকেন্দ্রিক। কৃষি অর্থনীতিতে উন্নয়নের ছোঁয়া গ্রামেও সাধারণ মানুষের জীবনযাত্রার মানকে অনেকখানি বাড়িয়ে দিয়েছে। কিন্তু জীবনযাত্রার বৈষয়িক মান সমৃদ্ধ হওয়া এবং মানসিক প্রবৃদ্ধি পেছনে পড়ে থাকা এই অসম টানাপোড়েনে মানুষ সমস্যাকবলিত হয়। সমাজের এই সামনে এগিয়ে যাওয়ার অভিযাত্রায় এখনও কন্যা সন্তান সামাজিক অভিশাপ। সমৃদ্ধ নগর এবং প্রত্যন্ত গ্রামাঞ্চল কোনভাবেই এক নয়। এই ফারাক নারীদের সামাজিক ব্যবধানকেও অনেকখানি এগিয়ে দেয়। যেমন শহরাঞ্চলের নারীরা যে ধরনের সুযোগ-সুবিধা, ক্ষমতা এবং অধিকার পায় পল্লীবালারা ঠিক ততখানি পায় না। এখনও সিংহভাগ নারী বাস করে গ্রামে। একজন কন্যাশিশু জন্ম থেকে যে বৈষম্যের শিকার সে বোঝা তাকে আজীবন বয়ে বেড়াতে হয়। প্রথমেই কন্যা সন্তানটি পড়ে বাল্যবিয়ের জটিলতম পরিস্থিতির মধ্যে। আইনী ব্যবস্থায় যা বলা আছে। তাকে বাদ দিলেও কন্যাদের জীবনে কোন সুষম অবস্থা তৈরি হবে না। কারণ মা বাবা কিংবা অভিভাবক একটি কন্যা যখন বালিকা হতে আরম্ভ করে তখন থেকেই তাকে পাত্রস্থ করার চিন্তা ছাড়া তাদের আর কিছু ভাবার উপায় থাকে না। এখানে সমাজের প্রচলিত কঠোর ব্যবস্থা কোন মেয়ের নাগরিক অধিকার প্রয়োগের বেলায় একেবারে বিপরীত স্থানে। একটা মেয়েকে যদি বালিকা অবস্থায় বিয়ে দেয়া হয় তাহলে তার করুণ পরিণতি অবশ্যই অকাল মাতৃত্ব। যা চিকিৎসকদের মতে জীবনের জন্য বড় ধরনের ঝুঁকিও। যেখানে বাল্যবিয়ে এবং অকাল মাতৃত্বকে ঠেকানো যাচ্ছে না, সেখানে নিরাপদ মাতৃত্ব কোন্ জায়গায় গিয়ে দাঁড়াবে বলা মুশকিল। নিরাপদ মাতৃত্বের সবচেয়ে বড় প্রতিবন্ধক শুধু অকাল মাতৃত্ব নয়Ñ তার ওপর আছে গর্ভবতী মেয়েদের প্রতি সহিংস আচরণ, মাতৃত্বকালীন অবস্থায় কোন নিয়মকানুন মানতে না দেয়া, চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে বাধা দান, পর্যাপ্ত এবং পুষ্টিকর খাবারের ব্যাপারে বৈষম্য তো নিত্যনৈমিত্তিক। গ্রামগঞ্জে, প্রত্যন্ত অঞ্চলে অবোধ বালিকাদের বিয়ে নামের এই প্রহসনের জোর হিসেবে অকাল মাতৃত্বের অভিশাপ থেকে পরিত্রাণ না পেয়ে নিরাপদ মাতৃত্ব কিভাবে কন্যাশিশুদের সুরক্ষা দেবে! এর পরেও নিরাপদ মাতৃত্ব নিয়ে ভাবার অবকাশ শেষ হয়ে যায় না। মা হওয়ার যে প্রত্যাশিত বিষয়টি প্রতিটি মেয়ের জীবনে কাক্সিক্ষত কিংবা অনাকাক্সিক্ষতভাবে ঘটে যাক না কেন এ ব্যাপারে সচেতন হওয়া কোন নারীর জন্য বিশেষ জরুরী। নিজেকে সুস্থ রেখে একটি সুন্দর ফুটফুটে সন্তান উপহার দেয়া প্রতিটি মায়ের বিশেষ দায়বদ্ধতা। একজন সচেতন মা-ই তার আগত সন্তানের সার্বিক সুরক্ষা নিশ্চিত করতে পারে। চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী নিজের এবং জঠরে তিল তিল করে গড়ে ওঠা শিশুটির জন্য একজন মা হিসেবে যা যা করার দরকার সবটাই করা বাঞ্ছনীয় এবং অপরিহার্য। এর অন্যথা হলে নিজের এবং সন্তানের স্বাস্থ্য ঝুঁকি বেড়ে যেতে পারে। প্রয়োজনীয় এবং পর্যাপ্ত খাবার গর্ভবতী মায়েদের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ পর্যায়। পাশাপাশি পারিবারিক এবং সামাজিকভাবে কোন মাকে তার সমস্ত অধিকার ও স্বাধীনতা দিতে হবে যাতে সে নিজে এবং সন্তানকে নিয়ে নিরাময় থাকে। পরবর্তীতে যাতে একটি সুস্থ শিশু পৃথিবীর আলো দেখতে পারে। নিয়মিত চিকিৎসকদের তত্ত্বাবধানে থেকে তার পরামর্শ এবং নিষেধ অনুযায়ী সব ধরনের ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। যে কোন মায়ের গর্ভে থাকে দেশের ভবিষ্যত প্রজন্ম। যারা এক সময় জাতির শ্রেষ্ঠ সন্তান হিসেবে বিবেচিত হয়। সুতরাং মায়ের যতেœর যদি কোন গাফিলতি হয় নতুন প্রজন্মকে পৃথিবীতে আনতে তার দায় ভাগ পরিবার থেকে সমাজ এমনকি রাষ্ট্রেরও। রাষ্ট্র তার সাংগঠনিক বিধিমালা দিয়ে পুরো জাতির জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রের নিরাপত্তা নিশ্চিত করে- মায়েদের জন্যও সেই ধরনের সুরক্ষার প্রয়োজন যেখান থেকে একজন সুস্থ, সরল মা তার অনাগত সন্তানটিকে নির্বিঘেœ, নিরুদ্বেগে নিয়ে আসতে পারে। সুতরাং এই দায় সকলের। আমার মনে হয় এই ধরনের স্পর্শকাতর, প্রতিদিন এবং চিরদিনের বিষয়গুলো নির্দিষ্ট কোন দিনে সীমাবদ্ধ রাখা যায় না। যে কোন মেয়ের মা হওয়ার সম্ভাবনা সব সময়ই। তাই নিত্যদিনের জীবনযাত্রায় মাতৃত্বের অপরিমেয় এবং শুদ্ধ মহিমা যেমন মাকে একইভাবে দেশ ও জাতিকে পরিপূর্ণ করবে, ভরিয়ে দেবে। সে আন্তরিক অনুভবের জায়গাটি শুধু মাকেই উদ্দীপ্ত করে না সে বিকিরণ পুরো সমাজকে আলোকময় করে তোলে। নিরাপদ মাতৃত্ব দিবসের তাৎপর্য তখনই সফল হবে যখন প্রতিদিন, প্রতি ঘরে ভাবী প্রজন্মের জন্মদাত্রীরা নিরাপদে, নিশ্চিতে, নির্বিঘেœ তাদের গর্ভে লালন করা সন্তানকে সুস্থভাবে উপহার দিতে পারবে।
×