ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪৩১

চট্টগ্রাম বন্দর জেটিতে ‘মোরা’য় ক্ষতিগ্রস্তদের জন্য ওষুধ ও ত্রাণসামগ্রী হস্তান্তর করলেন শ্রিংলা

গভীর সমুদ্রে ৩৩ জেলেকে উদ্ধার করল ভারতীয় যুদ্ধ জাহাজ

প্রকাশিত: ০৬:০২, ২ জুন ২০১৭

গভীর সমুদ্রে ৩৩ জেলেকে উদ্ধার করল ভারতীয় যুদ্ধ জাহাজ

হাসান নাসির, চট্টগ্রাম অফিস ॥ ঘূর্ণিঝড় ‘মোরা’র আঘাতে ডুবে যাওয়া দুই ট্রলারের ৩৩ জেলেকে উদ্ধার করে বাংলাদেশের কাছে হস্তান্তর করেছে ভারতীয় নৌবাহিনীর একটি যুদ্ধজাহাজ। বৃহস্পতিবার সকালে চট্টগ্রাম বন্দর জেটিতে জেলা প্রশাসনের কাছে তাদের হস্তান্তর করেন ঢাকায় নিযুক্ত ভারতীয় হাইকমিশনার হর্ষবর্ধন শ্রিংলা। একই সঙ্গে তিনি ঘূর্ণিঝড়ে ক্ষতিগ্রস্তদের জন্য ভারত সরকারের প্রদত্ত ওষুধ এবং ত্রাণসামগ্রীও প্রদান করেন। সরকারের পক্ষে এসব ওষুধ ও ত্রাণসামগ্রী এবং উদ্ধারকৃতদের গ্রহণ করেন চট্টগ্রামের জেলা প্রশাসক জিল্লুর রহমান চৌধুরী। উল্লেখ্য, গত মঙ্গলবার ঘূর্ণিঝড় মোরা বাংলাদেশ উপকূলে আঘাত করলে বাংলাদেশী দুটি ট্রলার ডুবে যায়। হস্তান্তর উপলক্ষে চট্টগ্রাম বন্দরের ৫ নম্বর জেটিতে আয়োজিত অনাড়ম্বর অনুষ্ঠানে ভারতীয় হাইকমিশনার শ্রিংলা ব্রিফিং করেন। তিনি বলেন, প্রতিবেশী বন্ধু বাংলাদেশের যে কোন দুর্যোগে ভারত পাশে দাঁড়াবে। তাৎক্ষণিক সহায়তা হিসেবে নৌবাহিনীর একটি জাহাজে আনা হয়েছে ওষুধ, প্যাকেটজাত শুকনা খাবার, কাপড়-চোপড়, তাঁবু এবং কম্বল। আরও জাহাজ প্রস্তুত রয়েছে, প্রয়োজনে আসবে। অপরদিকে, ভারতীয় নৌবাহিনীর যুদ্ধজাহাজ ‘আইএনএস সুমিত্রা’র কমান্ডিং অফিসার এসপি শ্রিশান বলেন, গভীর সমুদ্রে বিপদাপন্ন ৩৩ জনকে উদ্ধার করতে পেরে আমরা ধন্য হয়েছি। ভারতীয় হাইকমিশনার বলেন, বাংলাদেশ ভারতের নিকটতম প্রতিবেশী বন্ধু রাষ্ট্র। এ দেশের প্রতিটি দুর্যোগে সহায়তার হাত বাড়িয়ে পাশে দাঁড়াতে প্রস্তুত ভারত। তিনি বলেন, আমরা সব সময় বাংলাদেশের পাশে রয়েছি। হাইকমিশনার ঘূর্ণিঝড়ে বাংলাদেশে নিহতদের জন্য শোক ও সমবেদনা জানান। একই ভাবে ক্ষতিগ্রস্তদের প্রতি সহানুভূতি প্রকাশ করেন। ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যকার বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্কের বিভিন্ন দিক উল্লেখ করে তিনি ত্রাণসামগ্রী গ্রহণ এবং ভারতীয় যুদ্ধজাহাজকে সহায়তার জন্য কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেন। বক্তব্যে তিনি এও বলেন, ঘূর্ণিঝড়ে ক্ষয়ক্ষতি আরও বেশি হতে পারত। কিন্তু সরকারের পূর্বপ্রস্তুতি থাকায় তা কম হয়েছে। এক্ষেত্রে তিনি দুর্যোগ মোকাবেলায় বাংলাদেশের উন্নতির প্রশংসাও করেন। ভারতীয় নৌবাহিনীর জাহাজ সুমিত্রার কমান্ডিং অফিসার তার বক্তব্যে মহেশখালীর স্থলভাগ থেকে প্রায় ১শ’ নটিক্যাল মাইল দূরে গভীর সমুদ্রে বিপদগ্রস্ত বাংলাদেশী মৎস্য আহরণকারীদের উদ্ধারের বর্ণনা তুলে ধরেন। তিনি বলেন, ত্রাণসামগ্রী নিয়ে চট্টগ্রাম বন্দরের দিকে চলমান জাহাজ থেকে তারা দেখতে পান কয়েকটি হাত, যে হাতগুলো সাহায্যের আকুতি জানাচ্ছে। এরপর দুরবিনে দেখা যায় বড় একটি গাছ ধরে একদল মানুষ কোন রকমে বেঁচে থাকার সংগ্রাম করছেন। তাৎক্ষণিকভাবে জাহাজের নাবিকদের নির্দেশ দেয়া হয় তাদের উদ্ধারে। লাইফবোট ও লাইফ জ্যাকেট নিয়ে নাবিকরা নেমে পড়ার পর দেখতে পায় ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা এমন আরও কয়েকটি গ্রুপকে। কয়েক ঘণ্টার এ অভিযানে একে একে তুলে আনা হয় মোট ৩৪ জনকে। কিন্তু দুর্ভাগ্য, একজনকে আমরা জীবিত অবস্থায় উদ্ধার করতে পারিনি। বাকি ৩৩ জনকে জাহাজে প্রাথমিক চিকিৎসা প্রদান করা হয়। গভীর সমুদ্রে ৩৩ জন বিপদগ্রস্ত মানুষের জীবন রক্ষা করতে পারায় উচ্ছ্বাস প্রকাশ করেন ভারতীয় নৌবাহিনীর এ কর্মকর্তা। ত্রাণসামগ্রী গ্রহণ করে চট্টগ্রামের জেলা প্রশাসক মোঃ জিল্লুর রহমান চৌধুরী ভারত সরকারের প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেন। তিনি বলেন, ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্ক অত্যন্ত বন্ধুত্বের। দুর্যোগ মুহূর্তে ভারতের এ ত্রাণসামগ্রী এবং বঙ্গোপসাগর থেকে ৩৩ বাংলাদেশীকে উদ্ধারের জন্য তিনি ভারতীয় নৌবাহিনীকে অভিনন্দিত করেন। তিনি বলেন, যে ত্রাণসামগ্রী এসেছে সেগুলো ত্রাণ মন্ত্রণালয় এবং প্রশাসনের সংশ্লিষ্ট বিভাগগুলোর সঙ্গে সমন্বয় করে বিতরণ করা হবে। ঘূর্ণিঝড়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত সেন্টমার্টিন, মহেশখালী, কুতুবদিয়া, সন্দ্বীপ এবং টেকনাফে এ ত্রাণসামগ্রী বিতরণ করা হতে পারে বলে তিনি জানান। এ সময় উপস্থিত ছিলেনÑ চট্টগ্রামে নিযুক্ত ভারতীয় সহকারী হাইকমিশনার সোমনাথ হালদার, বাংলাদেশ নৌবাহিনীর ঈশা খাঁ ঘাঁটির কমান্ডিং অফিসার কমোডর মুসা, চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের সদস্য (প্রকৌশল) ক্যাপ্টেন জুলফিকার আজিজ, পরিচালক (নিরাপত্তা) লে. কর্নেল আবদুল গাফফার, পরিচালক (পরিবহন) গোলাম ছরওয়ার, চট্টগ্রামের অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক মোঃ মমিনুর রশিদ, অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক মাসুকুর রহমান সিকদার, চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের সচিব ওমর ফারুক এবং নৌবাহিনী, বন্দর ও জেলা প্রশাসনের কর্মকর্তাবৃন্দ। গভীর সমুদ্রে ৩৬ ঘণ্টার জীবনযুদ্ধ ভারতীয় নৌবাহিনীর ত্রাণবাহী জাহাজে ৩৩ জন বাংলাদেশী মৎস্য আহরণকারীকে উদ্ধার করে আনার খবরে বেশ ঔৎস্যুক্যের সৃষ্টি হয় চট্টগ্রাম বন্দরে। বৃহস্পতিবার সকাল ৯টার দিকে এদের হস্তান্তর করা হয় চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসনের কাছে। সাগরে প্রায় ৩৬ ঘণ্টার যুদ্ধে জীবন ফিরে পাওয়ার এ মানুষগুলোর চোখে ছিল আনন্দাশ্রু। ভারতীয় নৌবাহিনীর জাহাজ আইএনএস সুমিত্রা তাদের উদ্ধার করে। তাদের সকলেরই বাড়ি কক্সবাজার জেলার মহেশখালী উপজেলায়। মৎস্য আহরণের জন্য দুটি ট্রলারযোগে তারা গিয়েছিলেন ১০ মাইল দূরে। সাগরের উদ্দেশে যখন রওনা হন তখন বিপদ সঙ্কেত ছিল ৪ নম্বর। সঙ্কেত ৭ নম্বরে উন্নীত হওয়ার পর তারা তীরে ফিরতে শুরু করেছিলেন। কিন্তু এত দ্রুত মহাবিপদ সঙ্কেত ১০ হয়ে যায় যে, তারা জানতেনই না। দুটি ট্রলারই নিমজ্জিত হয়। ট্রলার দুটিতে ছিলেন ৫০ জন। এর মধ্যে ৩৩ জনকে জীবিত এবং একজনকে মৃত উদ্ধারের পর বাকি ১৬ জনের ভাগ্যে কী হয়েছে তা এখনও অজানা। মৎস্য আহরণকারী বশির জানান, তাদের ট্রলারে ছিলেন ১৬ জন। এর মধ্যে ১০ জনের কোন খবর নেই। ভারতীয় নৌবাহিনীর জাহাজ উদ্ধার না করলে তাদের বাঁচার কোন সম্ভাবনাই ছিল না। তিনি বলেন, ৩০ ঘণ্টারও বেশি সময় গভীর সমুদ্রে যুদ্ধ করে তাদের জীবন প্রায় শেষ হয়ে গিয়েছিল। আর যদি আধা ঘণ্টা দেরি হতো তাহলে আমরা কেউ বাঁচতাম না। তিনি ভারতীয় নৌবাহিনীর সদস্যদের প্রতি গভীর কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেন। খাইরুল নামের অপর এক মৎস্যজীবী জানান, কক্সবাজার থেকে ১০ মাইল দূরে তারা জাল ফেলেছিলেন। আচমকা আসা ঘূর্ণিঝড়ে ট্রলার ডুবে গেলে তারা অথৈই সমুদ্রে হাবুডুবু খেতে থাকেন। সাগরের স্রোত তাদের ভাসিয়ে নিয়ে যায় অনেক দুরে। হঠাৎ বড় একটি গাছ দেখতে পেয়ে সেটাকে আঁকড়ে ধরেন। কিছুটা দূরে দেখা যায় বড় জাহাজটি। এটি যে ভারতীয় নৌবাহিনীর তা জানার কথা নয়। সহযোগিতা চাইলে জাহাজটির নাবিকরা এগিয়ে আসেন। তিনি বলেন, নয় বছরের মাছ ধরা জীবনে এমন ভয়াবহ বিপদের মুখে আর পড়িনি। একই ধরনের উক্তি মোঃ সফির। তিনি মৎস্য শিকার পেশায় রয়েছেন প্রায় ৩০ বছর। সাংবাদিকদের জানান, ট্রলার উল্টে গেলে আমরা এর মধ্যে থাকা বিভিন্ন ধরনের খালি কন্টেনার, ভাঙ্গা কাঠ ও ভাসমান হালকা জিনিসগুলো ধরে বাঁচার চেষ্টা করি। এমন ভয়ঙ্কর অভিজ্ঞতার মুখোমুখি আর হতে হয়নি। অনেকটা নতুন জীবন ফিরে পাওয়া নাবিকদের স্বজনরা জানতেনই না তাদের ভাগ্য। স্বজনরা ছিলেন চিন্তিত এবং অনিশ্চয়তার মধ্যে। চট্টগ্রাম বন্দর জেটিতে নেমে মৎস্য আহরণকারীরা বিভিন্নজনের মোবাইল ফোন থেকে স্বজনদের সঙ্গে কথা বলতে থাকেন। একজন বলেন, ‘বাঁচি আছি, ন-কাইন্দো।’ স্বজনদের সঙ্গে কথা বলার সময় তাদের দু’চোখ থেকে জল গড়িয়ে পড়ে। ভারতীয় যুদ্ধজাহাজের নাবিকদের অভিযানে উদ্ধার হওয়া এ ৩৩ জনের মধ্যে একজনের অবস্থা বেশ নাজুক। তাকে বাংলাদেশ নৌবাহিনী হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। বাকি ৩২ জনকে চট্টগ্রাম মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে প্রাথমিক চিকিৎসার জন্য নেয়া হয়।
×