ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

অর্থমন্ত্রী সংসদে ২০১৭-১৮ অর্থবছরের জন্য চার লাখ ২৬৬ কোটি টাকার বাজেট পেশ করলেন;###;অনুন্নয়ন ব্যয় ২ লাখ ৪১ হাজার ২৫৩ কোটি টাকা;###;বাজেট বক্তৃতার পূর্ণ বিবরণ পৃষ্ঠা-১০ ও ১১

উন্নয়ন মহাসড়কে দ্রুত চলতে ॥ অর্থ সংগ্রহের বাজেট

প্রকাশিত: ০৫:৫৩, ২ জুন ২০১৭

উন্নয়ন মহাসড়কে দ্রুত চলতে ॥ অর্থ সংগ্রহের বাজেট

বিশেষ প্রতিনিধি ॥ উন্নয়নের মহাসড়কে বাংলাদেশ। আর উন্নয়নের এই মহাসড়ক ধরে দ্রুতগতিতে চলতে হলে অর্থের প্রয়োজন। সেই অর্থ সংগ্রহের জন্য অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত নানা প্রচেষ্টা চালিয়েছেন আগামী অর্থবছরের নতুন বাজেটে। এজন্য অর্থমন্ত্রী ১৫ শতাংশ হার অটুট রেখে নতুন ভ্যাট আইন বাস্তবায়নের ঘোষণা দিয়েছেন। সেই সঙ্গে কর আদায়ের বিদ্যমান খাতগুলোতে কোন ছাড় দেননি। বরং ব্যাংকে রাখা আমানতের ওপরও হাত দিয়েছেন। ব্যাংকে এক লাখ টাকার ওপর যত বেশি আমানত থাকবে তত বেশি আবগারি শুল্ক দিতে হবে গ্রাহককে। তবে অর্থমন্ত্রী কর আহরণে সবচেয়ে বেশি চড়াও হয়েছেন তামাকজাত পণ্য তথা বিড়ি-সিগারেটের ওপর। এ খাতে শুধু বিড়ি-সিগারেটের দাম বাড়িয়ে অর্থমন্ত্রী ক্ষান্ত থাকেননি, তামাকজাত পণ্য প্রস্তুতকারী করদাতার আয়ের ওপর আড়াই শতাংশ সারচার্জও আরোপ করেছেন। সবমিলিয়ে অর্থমন্ত্রী মুহিত বৃহস্পতিবার দুপুরে জাতীয় সংসদে উন্নয়নের জন্য এক ‘করবান্ধব’ বাজেট পেশ করেছেন। আগামী ২০১৭-১৮ অর্থবছরের এই বাজেটের আকার যেমন বেড়েছে তেমনি বেড়েছে বাজেট ঘাটতি। চার লাখ ২৬৬ কোটি টাকার এই বাজেটে অনুন্নয়ন ব্যয় হচ্ছে ২ লাখ ৪১ হাজার ২৫৩ কোটি টাকা। আর উন্নয়ন ব্যয় হচ্ছে এক লাখ ৬৪ হাজার ৮৫ কোটি টাকা। এর মধ্যে বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচীর আকার হচ্ছে ১ লাখ ৫৩ হাজার ৩৩১ কোটি টাকা। প্রস্তাবিত বাজেটে রাজস্ব আদায়ে সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দেয়া হয়েছে ভ্যাটের ওপর। একক খাত হিসাবে মূল্য সংযোজন কর বা ভ্যাট থেকে ৯১ হাজার কোটি টাকা সংগ্রহের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে। দ্বিতীয় সর্বোচ্চ গুরুত্ব দেয়া হয়েছে আয় করের ওপর। আয়কর থেকে আগামী অর্থবছরে আদায় করা হবে ৮৬ হাজার ৮৬৭ কোটি টাকা। সব মিলিয়ে আগামী অর্থবছরে রাজস্ব আদায়ের পরিকল্পনা করা হয়েছে ২ লাখ ৮৭ হাজার ৯৯১ কোটি টাকা। এর মধ্যে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা দেয়া হয়েছে ২ লাখ ৪৮ হাজার ১৯০ কোটি টাকা। এনবিআর বহির্ভূত খাত থেকে রাজস্ব আয় ধরা হয়েছে ৮ হাজার ৬২২ কোটি টাকা এবং কর ব্যতীত প্রাপ্তি ধরা হয়েছে ৩১ হাজার ১৭৯ কোটি টাকা। ফলে বাজেট ঘাটতির পরিমাণ দাঁড়াচ্ছে ১ লাখ ১২ হাজার ২৭৫ কোটি টাকা। যা জিডিপির ৫ শতাংশ। উন্নয়ন কর্মকা- ও সামাজিক নিরাপত্তা খাতে বরাদ্দ বৃদ্ধির কারণে এবার বাজেট ঘাটতি সামান্য বাড়বে, তবে শক্তিশালী জিডিপি প্রবৃদ্ধির ফলে তা সামষ্টিক অর্থনীতিতে কোন নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে না। এই বিশাল ঘাটতি অর্থায়নে বৈদেশিক উৎস থেকে পাওয়া যাবে ৫১ হাজার ৯২৪ কোটি টাকা। অবশিষ্ট ঘাটতি অভ্যন্তরীণ উৎস থেকে ঋণের মাধ্যমে সংগ্রহ করা হবে। এর মধ্যে ব্যাংক থেকে ঋণ নেয়া হবে ২৮ হাজার ২০৩ কোটি টাকা। এছাড়া সঞ্চয়পত্র ও অন্যান্য ব্যাংকবহির্ভূত উৎস থেকে নেয়া হবে ৩২ হাজার ১৪৯ কোটি টাকা। আগামী অর্থবছরে জিডিপি প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ৭.৪ শতাংশ। সেই সঙ্গে আশা করা হচ্ছে বছর শেষে মূল্যস্ফীতি ৫.৫ শতাংশে নেমে আসবে। জিডিপি প্রবৃদ্ধি ইতোমধ্যে ছয় শতাংশের বৃত্ত ভেঙ্গেছে। চলতি অর্থবছরসহ পর পর দুই অর্থবছর সাত শতাংশের ওপর দেশের জিডিপি প্রবৃদ্ধি অর্জিত হয়েছে। তাই আগামী অর্থবছরে প্রবৃদ্ধির সুফল দেশের সব মানুষের কাছে পৌঁছানোর ব্যবস্থা করবেন। সেই সঙ্গে অর্থমন্ত্রী আরও ঘোষণা দিয়েছেন, সরকারের চলতি ব্যয় নির্বাহের জন্য কোন ঋণ গ্রহণ করা হবে না। আর সরকারী ঋণের সমুদয় অর্থ দেশের উন্নয়ন কর্মকা-ে ব্যয় করা হবে। জলবায়ুর ওপর বিরূপ প্রভাব সৃষ্টিকারী উৎপাদন ও ভোগ প্রক্রিয়াকে নিরুৎসাহিত করা হবে। পরিবেশ বিপর্যয়ের শিকার বিপন্ন জনগোষ্ঠীর দুর্দশা লাঘবে দেয়া হবে প্রয়োজনীয় সহায়তা। বাজেট বাস্তবায়নে সরকারের রাজস্ব নীতি হবে সম্প্রসারণমূলক। একটি মধ্যম আয়ের দেশে যেসব হাতিয়ারের মাধ্যমে রাজস্ব আদায় করা হয়, দেশের রাজস্ব আদায়ের বিদ্যমান হাতিয়ারগুলোকেও সেই উপযোগী করার ঘোষণা দিয়েছেন অর্থমন্ত্রী। প্রবৃদ্ধি অর্জনের জন্য বিনিয়োগ প্রয়োজন। অর্থমন্ত্রী তার নতুন বাজেটে বিনিয়োগ বৃদ্ধির জন্য নানা কৌশল গ্রহণ করেছেন। যার মাধ্যমে তিনি আগামী অর্থবছরে বিনিয়োগকে জিডিপির ৩১.৯ শতাংশে নিয়ে যাওয়ার প্রত্যয় ব্যক্ত করেছেন। অর্থমন্ত্রী বলেছেন, ব্যক্তি বিনিয়োগের জন্য সমস্যাসমূহ চিহ্নিত করা হয়েছে। এখন এগুলো কাটিয়ে উঠার জন্য কর্মপরিকল্পনা বাস্তবায়ন করা হবে। দেশী-বিদেশী বিনিয়োগের জন্য জমি প্রাপ্তি বাংলাদেশে একটি বড় চালেঞ্জ। এ চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় সরকার অর্থনৈতিক অঞ্চল প্রতিষ্ঠার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। চলতি অর্থবছরে প্রধানমন্ত্রী ১০টি অর্থনৈতিক অঞ্চলের উদ্বোধন করেছে। আগামী অর্থবছরে আরও ১০টি অর্থনৈতিক অঞ্চল উদ্বোধনের পরিকল্পনা রয়েছে। এসব অর্থনৈতিক অঞ্চলে মধ্যমেয়াদে ৫০০ কোটি ডলার বিনিয়োগ হবে এবং ২ লাখ মানুষের কর্মসংস্থান হবে বলে অর্থমন্ত্রী আশা করছেন। প্রতি বছরই অর্থমন্ত্রী বড় বাজেট দিচ্ছেন। কিন্তু বাজেট বাস্তবায়ন একটি চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে। রাজস্ব আদায় লক্ষ্যমাত্রা অনুযায়ী না হওয়ায় প্রতি বছর বাজেটে বড় ধরনের সংশোধন করতে হচ্ছে। তাই আগামী অর্থবছরের বাজেটে অর্থমন্ত্রী রাজস্ব আহরণের ক্ষেত্রে কোন ছাড় দেননি। নতুন ভ্যাট আইন বাস্তবায়নের সঙ্গে সঙ্গে বিদ্যমান কর হারগুলোও অব্যাহত রেখেছেন। এত বিতর্কের পরও ভ্যাটের হার ১৫ শতাংশে অটুট রেখে অব্যাহতি প্রাপ্ত পণ্যের সংখ্যা বাড়িয়ে দিয়েছেন। অন্যদিকে ব্যাংকের আমানত ও বিমান টিকেটের ওপর আবগারি শুল্ক বাড়িয়েছেন। ব্যাংকে এক লাখ টাকার ওপর আমানত থাকলে বিভিন্ন পরিমাণ টাকার জন্য ভিন্ন হারে আবগারি শুল্ক দিতে হবে। এক্ষেত্রে ব্যাংক আমানতের ওপর আবগারি শুল্ক ৩০০ থেকে ১০ হাজার টাকা পর্যন্ত বেড়েছে। এছাড়া বিমান টিকেটের ওপর আবগারি শুল্ক দ্বিগুণ করা হয়েছে। আমাদের দেশে শিশু-কিশোর ও তরুণ সমাজ ফার্স্ট ফুডের দিকে ঝুঁকছে। তাই ফার্স্ট ফুডের ওপর ১৫ শতাংশ ভ্যাটের পাশাপাশি আরও ১০ শতাংশ সম্পূরক শুল্ক বসানো হয়েছে। তবে এতসব কর বৃদ্ধির পরও ছাড় পেয়েছে তৈরি পোশাক খাত। এ খাতে উৎসে কর হার দশমিক ৭০ শতাংশ অপরিবর্তিত রেখে কর্পোরেট কর হার হ্রাস করেছেন। এক্ষেত্রে কর হার ২০ শতাংশ থেকে ১৫ শতাংশ নামিয়ে আনা হয়েছে। আর সবুজ পোশাক কারখানার জন্য তিনি আরও এক শতাংশ ছাড় দিয়েছেন। অর্থাৎ কোন পোশাক কারখানা আন্তর্জাতিকভাবে গ্রিন বিল্ডিং সার্টিফিকেট পেলে তাকে ১৪ শতাংশ কর্পোরেট কর দিতে হবে। সবশেষে অর্থমন্ত্রী ২০৪১ সালে বাংলাদেশকে একটি সমৃদ্ধ, উন্নত ও সুখী শান্তিময় বাংলাদেশ দেখতে চেয়েছেন। এজন্য তিনি দল মত হিংসা-বিদ্বেষ ভুলে সকলে মিলে এগিয়ে যাওয়ার প্রত্যয় ব্যক্ত করেছেন। সামনে সোনা ছড়ানো সমৃদ্ধি হাতছানি দিয়ে ডাকছে। শেখ হাসিনার নেতৃত্বে সেই সমৃদ্ধির পথে হাঁটছে বাংলাদেশ। সংশোধিত বাজেট ॥ নানামুখী সংস্কার কাজ সম্পন্ন হওয়ায় চলতি অর্থবছর জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের জন্য উচ্চ হারে রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছিল। কিন্তু এনবিআরের রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা কিছুটা কম হবে। এছাড়া ২জি, ৩জি অব্যহৃত স্পেকট্রামের নিলাম সম্পন্ন না হওয়ায় চলতি অর্থবছরে কর ব্যতীত রাজস্ব আদায়ও কম হবে। এ কারণে চলতি অর্থবছর ১০ শতাংশ কম রাজস্ব আদায় হবে। এসব বিবেচনায় চলতি অর্থবছরের বাজেট সংশোধন করা হয়েছে। চলতি অর্থবছরের মূল বাজেটে রাজস্ব প্রাপ্তির লক্ষ্যমাত্রা ছিল ২ লাখ ৪২ হাজার ৭৫২ কোটি টাকা। এ লক্ষ্যমাত্রা হ্রাস করে সংশোধিত বাজেটে তা ২ লাখ ১৮ হাজার ৫০০ কোটি টাকায় পুনর্নির্ধারণ করা হয়েছে। চলতি অর্থবছরের বাজেটে মোট সরকারী ব্যয়ের প্রাক্কলন করা হয় ৩ লাখ ৪০ হাজার ৬০৫ কোটি টাকা। সংশোধিত বাজেটে ব্যয়ের পরিমাণ ২৩ হাজার ৪৩০ কোটি টাকা কমিয়ে ৩ লাখ ১৭ হাজার ১৭৪ কোটি টাকা নির্ধারণ করা হয়েছে। অনুন্নয়নসহ অন্যান্য রাজস্ব ব্যয়ের পরিমাণ ২২ হাজার ৩৯৪ কোটি টাকা কমিয়ে ২ লাখ ১ হাজার ১৮৪ কোটি টাকা নির্ধারণ করা হয়েছে। অন্যদিকে সংশোধিক বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচীর আকার নির্ধারণ করা হয়েছে এক লাখ ১৯ হাজার ২৯৫ কোটি টাকা। ফলে সংশোধিত বাজেটে ঘাটতি দাঁড়িয়েছে ৯৭ হাজার ৮৫৩ কোটি টাকা। মূল বাজেটে বৈদেশিক উৎস থেকে অর্থায়নের পরিমাণ ধরা হয়েছি ৩৬ হাজার ৩০৫ কোটি টাকা। সংশোধিত বাজেটে বৈদেশিক উৎস থেকে অর্থায়নের পরিমাণ নির্ধারণ করা হয়েছে ২৮ হাজার ৭৭১ কোটি টাকা। এছাড়া অভ্যন্তরীণ উৎস থেকে অর্থায়নের পরিমাণ নির্ধারণ করা হয়েছে ৬৯ হাজার ৯০৩ কোটি টাকা। অবশ্য সঞ্চয়পত্র বিক্রি উল্লেখযোগ্য পরিমাণ বৃদ্ধি পাওয়ায় চলতি অর্থবছর ব্যাংক ব্যবস্থা থেকে গ্রহণ হ্রাস পাবে। বৃহস্পতিবার জাতীয় সংসদে বাজেট পেশের আগে তা সংসদ ভবনে অনুষ্ঠিত মন্ত্রিসভা বৈঠকে অনুমোদিত হয়। বাজেট একটি অর্থ বিল হওয়ায় তা সংসদে উপস্থাপনের জন্য রাষ্ট্রপতির অনুমোদন প্রয়োজন। মন্ত্রিসভা বৈঠকে বাজেট প্রস্তাব অনুমোদনের পর তা অনুমোদনের জন্য রাষ্ট্রপতির কাছে নেয়া হয়। রাষ্ট্রপতির অনুমোদনক্রমে অর্থমন্ত্রী তা জাতীয় সংসদে উপস্থাপন করেন। এ সময় জাতীয় সংসদে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, বিরোধী দলীয় নেত্রী রওশন এরশাদ, জাতীয় পার্টির প্রেসিডেন্ট এইচ এম এরশাদসহ সংসদ সদস্যগণ উপস্থিত ছিলেন। আজ শুক্রবার বিকেল ৩টায় ওসমানী স্মৃতি মিলনায়তনে বাজেটোত্তর সংবাদ সম্মেলন অনুষ্ঠিত হবে। আর বাজেটের ওপর আলোচনা শেষে আগামী ২৯ জুন জাতীয় সংসদে পাস হবে নতুন বাজেট।
×