ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

উলিপুরে মুক্তিযোদ্ধা যাচাই-বাছাই

তালিকায় ৪ রাজাকার ও শিশু

প্রকাশিত: ০৬:৩০, ১ জুন ২০১৭

তালিকায় ৪ রাজাকার ও শিশু

স্টাফ রিপোর্টার,কুড়িগ্রাম ॥ উলিপুরে মুক্তিযোদ্ধা যাচাই-বাছাইয়ে ৪ রাজাকার, শীর্ষ যুদ্ধাপরাধীর সহযোগী ও অমুক্তিযোদ্ধাদের খসড়া তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। এমনকি সরকারী প্রজ্ঞাপন অনুযায়ী ১৩ বছর বয়সের নিচে কাউকে মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে অন্তর্ভুক্ত করা যাবে না মর্মে নির্দেশনা থাকলেও ৪ জন কম বয়সী ব্যক্তিকে তালিকাভুক্ত করা হয়েছে এমন অভিযোগ পাওয়া গেছে। মুক্তিযোদ্ধা সংসদ উলিপুর কমান্ডের কার্যকরী পরিষদের অধিকাংশ সদস্য জামুকা ও সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ে অভিযোগ দায়ের করেছেন। এ ঘটনায় জেলায় তোলপাড় শুরু হয়েছে। অভিযোগে বলা হয়, অর্থের বিনিময়ে এসব অমুক্তিযোদ্ধাকে তালিকাভুক্ত করা হয়েছে। ফলে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ও মুক্তিযোদ্ধাদের মান-সম্মান ধূলিসাত করা হয়েছে। মুক্তিযোদ্ধা সংসদ উলিপুর কমান্ডের ১১ সদস্যের মধ্যে ৯ জন স্বাক্ষরিত অভিযোগপত্রে বলা হয়, উলিপুর পৌর এলাকার কুখ্যাত রাজাকার মোন্তাজ আলী, রোস্তম আলী, ধামশ্রেণী ইউনিয়নের মোহাম্মদ আলী ও থেতরাই ইউনিয়নের শাহাজাহান আলীকে মোটা অঙ্কের টাকার বিনিময়ে খসড়া তালিকাভুক্ত করেন। উল্লেখিত রাজাকাররা যাচাই-বাছাই কমিটির সামনে জেরার মুখে নিজেদের রাজাকার ছিলেন বলে স্বীকার করেছিলেন। দেলওয়ার হোসেন একজন মুক্তিযুদ্ধবিরোধী ব্যক্তি হিসেবে পরিচিত হলেও তাকে তালিকাভুক্ত করা হয়েছে। তার পিতা ছিলেন সেক্টর কমান্ডার্স ফোরাম ঘোষিত তালিকায় ৫৭তম শীর্ষ যুদ্ধাপরাধী আবুল কাশেম মিয়ার ঘনিষ্ঠ সহচর ও দলদলিয়া ইউনিয়নের শান্তি কমিটির সদস্য। তিনি মুক্তিযুদ্ধের সময় ছিল সপ্তম শ্রেণীর ছাত্র। যাচাই-বাছাই কমিটির সামনে তিনি মুক্তিযুদ্ধ করেননি বলে স্বীকার করেন। বজরা ইউনিয়ন পরিষদের বর্তমান চেয়ারম্যান রেজাউল করিম আমিন মুসলিম লীগ পরিবারের সন্তান। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন বৃহত্তর রংপুর জেলার ১৫১ নম্বর তালিতাভুক্ত কুখ্যাত রাজাকার তার আত্মীয় হামিদুল হককে মুক্তিযোদ্ধারা তার বাড়িতে অভিযান চালিয়ে আটক করেন। এমনকি যাচাই-বাছাই কমিটির সামনে ওই চেয়ারম্যান মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছেন তার সপক্ষে কোন দালিলিক প্রমাণ ও সাক্ষী দিতে পারেন নাই। তার বিরুদ্ধে ওই ইউনিয়নের সকল মুক্তিযোদ্ধা অভিযোগ করেও যাচাই-বাছাই কমিটির কাছে কোন ফল পাননি। একইভাবে দলদলিয়া ইউনিয়নের বর্তমান চেয়ারম্যান আতিয়ার রহমান মুন্সি কোন দালিলিক প্রমাণ ও সহযোদ্ধার সাক্ষ্য দিতে না পারলেও তাকে তালিকাভুক্ত করা হয়। তার বিরুদ্ধে ওই ইউনিয়নের সকল মুক্তিযোদ্ধা অভিযোগ করেও কোন প্রতিকার পাননি। দুর্গাপুর ইউনিয়নের গোড়াই গ্রামের নুরুজ্জামান সরকার যুদ্ধাপরাধী দেলওয়ার হোসাইন সাঈদীর চন্দ্রাভিযানের খবরে আনন্দ বাজারে গাছের গুঁড়ি ফেলে ও টায়ার জ্বালিয়ে সড়ক অবরোধ করে। এ বিষয়ে তার বিরুদ্ধে থানায় মামলা রয়েছে। তিনি যাচাই-বাছাই কমিটির সামনে মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে কোন দালিলিক প্রমাণ দিতে পারেনি। এমনকি কেমন করে রাইফেল থেকে গুলি ছুড়তে হয় তাও বলতে পারেনি নাই। সাবেক উপজেলা মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার গোলাম মোস্তাফা ভুয়া মুক্তিযোদ্ধা মর্মে বিভিন্ন দফতরে লিখিত অভিযোগ করেন, অভিযোগকারী হিসেবে ছিলেন, একটি পৌরসভাসহ ১৩ ইউনিয়ন মুক্তিযোদ্ধা সংসদের কমান্ডার ও ডেপুটি কমান্ডার এবং উপজেলা মুক্তিযোদ্ধা সংসদের কার্যকরী কমিটির ১১ সদস্য। এর মধ্যে যাচাই-বাছাই কমিটির সদস্যও রয়েছেন, এরা হলেন উপজেলা মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার এম ডি ফয়জার রহমান, ডেপুটি কমান্ডর গোলাম হোসেন মন্টু ও পান্ডুল মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার আব্দুল আজিজ। যাচাই-বাছাইয়ের সময় গোলাম মোস্তফা স্বীকার করেন, তিনি বুড়াবুড়ি নদী ঘাট এলাকায় মুক্তিযোদ্ধাদের গুলিতে আহত হন তার চিকিৎসাধীন অবস্থায় দেশ স্বাধীন হয়। কিন্তু তিনি প্রভাব খাঁটিয়ে যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে ভাতা পেয়ে আসছিলেন। অভিযোগ সত্ত্বে তাকেও তালিকাভুক্ত করা হয়। উলিপুর পৌর এলাকার রামদাস ধনিরাম গ্রামের আবুল কাশেম মুক্তিযুদ্ধ ও পরবর্তী সময়ে মুক্তিযুদ্ধের চেতনাবিরোধী রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত। যাচাই-বাছাই কমিটির সামনে তিনি মুক্তিযুদ্ধ করেননি বলে স্বীকার করলেও তাকে মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে তালিকাভুক্ত করা হয়। অভিযোগে বলা হয়, মন্ত্রণালয়ের নির্দেশ উপেক্ষা করে ভারতীয় তালিকাভুক্ত ও লাল মুক্তিবার্তাভুক্ত মুক্তিযোদ্ধাদের উপস্থিতি ছাড়াই গত ৪ ফেব্রুয়ারি উপজেলা নির্বাহী অফিসারের গোপন কক্ষে যাচাই-বাছাই করা হয়। সেখানে বিতর্কিত ব্যক্তিদের তালিকাভুক্ত করা হয়। সভাপতি ও সদস্য সচিবের কাছে বার বার প্রতিবাদ করা সত্ত্বেও কর্ণপাত না করে নিজেদের খেয়াল-খুশিমতো যাচাই-বাছাই করেন। গত ৪ মার্চ যাচাই-বাছাই শেষ হলেও দীর্ঘদিন পর গত ১৬ মে সদস্য সচিব ও উপজেলা নির্বাহী অফিসার শুধু ৬২ জনের তালিকা নোটিস বোর্ডে সাঁটিয়ে দেন। কিন্তু এক ঘণ্টার ব্যবধানে তা আবার তুলে ফেলেন। তালিকা চেয়ে বার বার অনুরোধ করা সত্ত্বেও তিনি তালিকা সরবরাহ করেন নাই। প্রকাশিত তালিকার অধিকাংশই মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বিশ্বাস করেন না, মুক্তিযুদ্ধকে মানেন নাÑ এমন ব্যক্তির সংখ্যা তালিকায় থাকা মোট সংখ্যার অর্ধেকেরও বেশি। অপরদিকে নীতিমালানুযায়ী ১৩ বছরের নিচে কেউ আবেদন করতে পারবে না। কিন্তু এখানে টাকার জোরে ১৩ বছরের নিচে আব্দুল জলিল শেখ, রুহল আমিন, আব্দুল গাফ্ফার ও আব্দুস ছালাম নামের ৪ জনকে খসড়া তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। এ ব্যাপারে মুক্তিযোদ্ধা যাচাই-বাছাই কমিটির সভাপতি মুক্তিযোদ্ধা ওসমান গনি বলেন, আমরা কগজপত্রের ভিত্তিতে কাজটি করেছি। যদি কোন রাজাকার বা কম বয়সী অন্তর্ভুক্ত হয়ে থাকে অভিযোগ পেলে ব্যবস্থা নেয়া হবে। অভিযোগে উল্লেখিত ব্যক্তিদের মধ্যে রেজাউল করিম আমিন বলেন, সমস্ত অভিযোগ মিথ্যা। তবে অভিযোগকারীদের মধ্যে মুক্তিযুদ্ধ চলাকালেন চাঁদ কোম্পানির সেকেন্ড ইন কমান্ড বীর মুক্তিযোদ্ধা রবিউস সামাদ বলেন, অভিযোগে উল্লেখিত ব্যক্তিরা সকলেই মুক্তিযুদ্ধবিরোধী পরিবারের লোক তারা কেউ যুদ্ধ করেনি। অভিযোগে স্বাক্ষর করেন, মুক্তিযোদ্ধা সংসদ উলিপুর কমান্ডের একজন সাংগঠনিক কমান্ডারসহ ৮ জন সহকারী কমান্ডার।
×