ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

প্রকৃত রহস্য উদ্্ঘাটনে বিচার বিভাগীয় তদন্ত দাবি

জামিন পেলেন সেই লাঞ্ছিত শিক্ষক শ্যামল কান্তি ভক্ত

প্রকাশিত: ০৬:০৭, ১ জুন ২০১৭

জামিন পেলেন সেই লাঞ্ছিত শিক্ষক শ্যামল কান্তি ভক্ত

স্টাফ রিপোর্টার, নারায়ণগঞ্জ ॥ নারায়ণগঞ্জের বন্দরে ধর্মীয় অবমাননার কটূক্তির অভিযোগ এনে স্থানীয় এমপি সেলিম ওসমানের কান ধরে উঠবস করানো সেই লাঞ্ছিত প্রধান শিক্ষক শ্যামল কান্তি ভক্তের জামিন মঞ্জুর করেছে আদালত। বুধবার দুপুরে নারায়ণগঞ্জ জেলা ও দায়রা জজ সৈয়দ এনায়েত হোসেনের আদালতে আইনজীবীর মাধ্যমে জামিন আবেদন জানালে উভয় পক্ষের শুনানি শেষে আদালত আগামী ২০ জুলাই পর্যন্ত অন্তর্বর্তীকালীন জামিন মঞ্জুর করেছেন। গত ২৪ মে বন্দরের এক শিক্ষিকাকে এমপিওভুক্ত করে দেয়ার আশ্বাস দিয়ে ঘুষ নেয়ার অভিযোগে দায়ের করা মামলায় আদালত গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করলে শ্যামল কান্তি ভক্ত আদালতে আত্মসমর্পণ করেন। পরে আদালত তাকে জেল হাজতে পাঠানোর নির্দেশ দেয়। এদিকে শ্যামল কান্তি ভক্তের বিরুদ্ধে দায়ের করা ঘুষের মামলার প্রকৃত রহস্য উদ্ঘাটন করতে বিচার বিভাগীয় তদন্ত দাবি করেছেন নাগরিক সমাজের নেতৃবৃন্দরা। শ্যামল কান্তি ভক্তের আইনজীবী এ্যাডভোকেট সাখাওয়াত হোসেন সাংবাদিকদের বলেন, আদালত শুনানি শেষে তাদের আবেদন মঞ্জুর করে আগামী ২০ জুলাই পর্যন্ত অন্তর্বর্তীকালীন জামিন মঞ্জুর করে। তিনি বলেন, ওই স্কুল থেকে তাকে তাড়ানোর জন্য তাকে বিভিন্নভাবে হয়রানি করা হচ্ছিল। তাকে কিভাবে নির্যাতন করা হয়েছে তা আপনারা দেখছেন। তিনি কোন মামলার আশ্রয় নেননি। কিন্তু উচ্চ আদালতের নির্দেশে মামলা হওয়ার কারণে প্রভাবশালীদের নির্দেশে এই মিথ্যা ঘটনা সাজিয়ে মামলা দায়ের করা হয়েছে। পুলিশকে দিয়ে মনগড়া একটি প্রতিবেদন দাখিল করা হয়েছে। শ্যামল কান্তি ভক্তের স্ত্রী সবিতা হালদার জানিয়েছেন, ২০১৩ সালের ১৩ মে আমার স্বামীর ওপর অন্যায়-অত্যাচার করা হয়েছে। একটি কুচক্রী মহলের মিথ্যা মামলায় আমার স্বামীকে জেল খাটানো হয়েছে। ওই মামলায় জামিনের মধ্য দিয়ে আমরা কিছুটা হলেও সুবিচার পেলাম। আমার স্বামীর বিরুদ্ধে দায়ের করা মিথ্যা মামলাটি খারিজ করে দেয়ার জন্য প্রধানমন্ত্রীর কাছে আবেদন জানাই। তিনি সাংবাদিকদের আরও জানান, আমার স্বামী স্ট্রোক, ডায়াবেটিসসহ নানাবিধ রোগে আক্রান্ত। গত ১৩ মে অত্যাচারের পর সে আরও নানা রোগে আক্রান্ত হয়েছে। বন্দর থানার এসআই মোখলেছুর রহমান আমাদের সাংসদের সঙ্গে মিলে যাওয়ার জন্য বার বার চাপ দিয়েছেন। ওই এসআই বলেছে, সাংসদ আপনাদের ৫০ লাখ টাকা দিয়ে দেবেন আপনারা নারায়ণগঞ্জ ছেড়ে চলে যান। কিন্তু আমার স্বামী বলেছেন আমি কেন নারায়ণগঞ্জ ছেড়ে চলে যাব। তিনি বলেন, শিক্ষক তো প্রধান শিক্ষক একা নিয়োগ করতে পারে না। এটা করে ম্যানেজিং কমিটি। তাহলে তার বিরুদ্ধে কেন মিথ্যা মামলা দিয়ে তাকে হয়রানি করা হলো। জেলে যাওয়ার আগে প্রধান শিক্ষক শ্যামল কান্তি ভক্ত বলেন, একজন প্রভাবশালী ব্যক্তির কারণে আমাকে ষড়যন্ত্র ও পরিকল্পিতভাবে এই মামলায় ফাঁসানো হয়েছে। আমার বিরুদ্ধে যে ঘুষের অভিযোগ আনা হয়েছে আমি কখনও এ ধরনের ঘটনার সঙ্গে জড়িত নই, আমাকে ফাঁসানো হয়েছে। সকল কাগজপত্র আমার কাছে রয়েছে। তিনি বলেন, যে সময়ে ঘুষ নেয়ার কথা বলা হয়েছে তখন শীতকালীন বন্ধ ছিল স্কুল। আমাকে হয়রানি করার জন্যই এই মামলা দায়ের করা হয়েছে। তিনি বলেন, আমাকে নানাভাবে চাপ সৃষ্টি করা হচ্ছে। মানসিকভাবে টর্চার করা হচ্ছে। তিনি বলেন, হাইকোর্টের নির্দেশে মামলা হয়েছে। ওই মামলার কারণে আমাকে চাপে রাখার জন্যই এই ঘুষের মামলা দায়ের করা হয়েছে। পুলিশ আগে থেকেই প্রভাবশালী ওই ব্যক্তির পক্ষে কাজ করছে বলে তিনি অভিযোগ করেন। ওই মামলায় পুলিশের তদন্ত প্রতিবেদন অন্য রকম হতে পারত। কিন্তু ওই প্রভাবশালী ব্যক্তিকে খুশি করার জন্যই পুলিশ এই ধরনের প্রতিবেদন দাখিল করেছে। কান ধরে উঠবস করানোর দুই মাস পর ঘুষের মামলা দায়ের গত ১৩ মে নারায়ণগঞ্জের বন্দর উপজেলার কল্যানদীতে পিয়ার সাত্তার লফিত উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক শ্যামল কান্তি ভক্তের বিরুদ্ধে ধর্মীয় অবমাননার কটূক্তির অভিযোগ এনে স্থানীয় এমপি সেলিম ওসমান কান ধরে উঠবস করান। এ ঘটনায় সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমসহ ইলেকট্রনিক ও প্রিন্ট মিডিয়ায় প্রকাশ পেলে সারাদেশে তোলপাড় সৃষ্টি হয়। সরকারসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক মহল থেকে স্থানীয় সাংসদ সেলিম ওসমানকে ক্ষমা চাওয়ার দাবি উঠলেও তিনি সংবাদ সম্মেলন করে সেটি নাকচ করেন। শ্যামল কান্তি ভক্তকে লাঞ্ছিত করার দুই মাস পর গত ১৪ জুলাই ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত, শিক্ষার্থী রিফাতকে মারধর ও শিক্ষককে এমপিওভুক্ত করে দেয়ার প্রলোভন দেখিয়ে ১ লাখ ৩৫ হাজার ঘুষ নেয়ার অভিযোগে পৃথক তিনজন বাদী হয়ে শ্যামল কান্তি ভক্তের বিরুদ্ধে নারায়ণগঞ্জ আদালতে তিনটি মামলার আবেদন করেন। আদালত ওই দিন বিকেলে শুনানি শেষে প্রথম দুটি মামলা খারিজ করে দেয়। পিয়ার সাত্তার লতিফ উচ্চ বিদ্যালয়ের ইংরেজী শিক্ষক মোর্শেদা বেগমকে প্রলোভন দেখিয়ে ১ লাখ ৩৫ হাজার টাকা ঘুষ নেয়ার অভিযোগের বিষয়ে বন্দর থানা পুলিশকে তদন্ত প্রতিবেদন জমা দিতে বলা হয়। আদালতের নির্দেশে বন্দর থানা পুলিশ তাকে অভিযুক্ত করে ১৭ এপ্রিল আদালতে তদন্ত প্রতিবেদন দাখিল করেন। তদন্ত প্রতিবেদন দাখিল করলে ২৪ মে শুনানি শেষে শ্যামল কান্তি ভক্তের বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করে আদালত। ওইদিন বিকেলে আইনজীবীর মাধ্যমে আদালতে আত্মসমর্পণ করে জামিন চাইলে আদালত তা না মঞ্জুর করে তাকে কারাগারে প্রেরণ করেন। এদিকে শ্যামল কান্তি ভক্তকে কান ধরে উঠবস করানোর ঘটনায় হাইকোর্টের নির্দেশে বিচার বিভাগীয় তদন্ত কমিটি সাংসদ সেলিম ওসমানের বিরুদ্ধে আদালতে তদন্ত প্রতিবেদন দাখিল করলে গত ২৩ মে মঙ্গলবার ঢাকার সিএমএম আদালত তাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন করেন। এ ঘটনায় সাংসদ সেলিম ওসমান মঙ্গলবার সিএমএম আদালত থেকে জামিন লাভ করেন। বিচার বিভাগীয় তদন্তের দাবি নাগরিক সমাজের নারায়ণগঞ্জ নাগরিক কমিটির সভাপতি এবি সিদ্দিক জানান, শ্যামল কান্তি ভক্তকে জামিন দেয়ায় নাগরিক সমাজ অনেকটা স্বস্তি প্রকাশ করেছে। এখন নাগরিক সমাজের দাবি বিচার বিভাগীয় তদন্তের মাধ্যমে প্রকৃত রহস্য উদ্ঘাটন করা হোক এবং অপরাধী যেই হোক সে যেন শাস্তি পাক। এটাই নাগরিক সমাজের কর্তব্য। আমরা বলি না শ্যামল কান্তিকে ছেড়ে দেয়া হোক। কারামুক্ত শ্যামল কান্তি ভক্ত বন্দরের লাঞ্ছিত প্রধান শিক্ষক শ্যামল কান্তি ভক্ত ঘুষ গ্রহণ মামলায় সন্ধ্যা ৬টায় নারায়ণগঞ্জ জেলা কারাগার থেকে মুক্তি পেয়েছেন। এ সময় জেল গেটে উপস্থিত ছিলেন তার আইনজীবী সাখাওয়াত হোসেন খান ও স্ত্রী সবিতা হালদার। জেল সুপার সুভাষ ঘোষ মুক্তির বিষয়টি নিশ্চিত করেন। বুধবার দুপুরে নারায়ণগঞ্জ জেলা ও দায়রা জজ সৈয়দ এনায়েত হোসেনের আদালতে তার আইনজীবী শিক্ষক শ্যামল কান্তি ভক্তের জামিন চাইলে আদালত দুই পক্ষের শুনানি শেষে আগামী ২০ জুলাই পর্যন্ত অন্তর্বর্তীকালীন জামিন মঞ্জুর করেন। নারায়ণগঞ্জ জেলা কারাগারের জেল সুপার সুভাষ ঘোষ জানান, আদালত জামিন মঞ্জুর করার পর জামিনের কপি আদালতের মাধ্যমে বিকেলে নারায়ণগঞ্জ কারাগারে এসে পৌঁছায়। পরে সেটি যাচাই-বাছাই করে সন্ধ্যায় তাকে মুক্তি দেয়া হয়।
×