ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১

৩ হাজার এনজিওর নিবন্ধন বাতিলের জন্য মন্ত্রণালয়ে সুপারিশ

সরকার ও রাষ্ট্রবিরোধী কাজে জড়িত অনেক এনজিও

প্রকাশিত: ০৫:৫৯, ১ জুন ২০১৭

সরকার ও রাষ্ট্রবিরোধী কাজে জড়িত অনেক এনজিও

রহিম শেখ ॥ দারিদ্র্য বিমোচনের নামে কিছু এনজিওর বিরুদ্ধে ব্যাপক অনিয়ম, দুর্নীতি এবং সরকার ও রাষ্ট্রবিরোধী কাজে লিপ্ত থাকার অভিযোগ উঠেছে। অভিযোগে বলা হচ্ছে, সম্প্রতি কিছু কিছু এনজিও নিবন্ধন আইন লঙ্ঘন করে জঙ্গী অর্থায়ন, অর্থের বিনিময়ে ধর্ম পরিবর্তন, রাজনৈতিক কর্মসূচীতে অর্থব্যয় ও ব্যাপক দুর্নীতি-অনিয়মসহ নানাবিধ কর্মকা-ে লিপ্ত। নিবন্ধনকৃত এনজিওর মধ্যে এসব কর্মকা- মূল্যায়ন করে এনজিও ব্যুরো এবং সমাজ সেবা অধিদফতর ইতোমধ্যে ৭ হাজার ৮০০ এনজিওর নিবন্ধন বাতিল করেছে। সমাজসেবা অধিদফতর গঠনতন্ত্র পরিপন্থী ও বেআইনী কাজের সঙ্গে সম্পৃক্ত আরও ৩ হাজার এনজিওর নিবন্ধন বাতিলের জন্য মন্ত্রণালয়ে সুপারিশও পাঠানো হয়েছে বলে বিশ্বস্ত সূত্রে জানা গেছে। জানা গেছে, বাংলাদেশকে বলা হয় বেসরকারী সংস্থার (এনজিও) মডেল। ১৯৭১ সালে যুদ্ধপরবর্তী বিপর্যস্ত অর্থনৈতিক পরিস্থিতি মোকাবেলায় বিভিন্ন আন্তর্জাতিক ও বিদেশী সংস্থা ত্রাণ পুনর্বাসন ও চিকিৎসা-স্বাস্থ্যসেবাসহ নানা ক্ষেত্রে বাংলাদেশ সরকারকে সাহায্য করতে এগিয়ে আসে। এর পর থেকে দেশে অসংখ্য এনজিও হয়েছে। এনজিওর নামেও নিবন্ধন পেয়েছে অসংখ্য সংগঠন। সরকারের একটি হিসাব অনুযায়ী, বর্তমানে দুই লাখের মতো রয়েছে এনিজও। এর মধ্যে সমাজসেবা অধিদফতরের অধীনে ৫৩ হাজার ২৩২, সমবায় অধিদফতরের অধীনে দেড় লাখ, মহিলাবিষয়ক অধিদফতরের অধীনে ১৬ হাজার এবং এনজিও ব্যুরোতে ২ হাজার ৩০৫ এনজিও দেখানো হয়েছে। দুই লাখের মধ্যে ৫৫ হাজার এনজিও নিষ্ক্রিয় এবং ৪৮ হাজার ৮০৩টিকে সক্রিয় বলা হয়েছে। এক পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, গত ২৩ বছরে প্রায় ৫৬ হাজার কোটি টাকা বিদেশ থেকে এনে খরচ করেছে এনজিওগুলো। কিন্তু অধিকাংশ অর্থ ব্যয়ের কোন সঠিক হিসাব নেই। কোন্ খাতে কীভাবে এই অর্থ ব্যয় হচ্ছে সরকারের কাছেও তার কোন রেকর্ড নেই। বিশ্বব্যাংকের সাম্প্রতিক এক মূল্যায়নে বাংলাদেশে এনজিও খাতের দুর্বলতা, অর্থিক অসচ্ছতা, মনিটরিংয়ে দুর্বলতা, জবাবদিহিতার অভাব ও নানা অনিয়মের কথা উল্লেখ করা হয়েছে। একইভাবে পিকেএসএফ (পল্লী কর্মসহায়ক ফাউন্ডেশন)এর মূল্যায়নেও দারিদ্র্য বিমোচন এবং ক্ষুদ্র ঋণ কর্মসূচীতে এনজিওর ভূমিকা নানাভাবে প্রশ্নবিদ্ধ। এনজিও খাত নিয়ে টিআইবির (ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ) এক গবেষণায় ব্যাপক অনিয়ম, দুর্নীতি, নিবন্ধন আইন ভঙ্গ, অর্থের অপব্যবহার, দারিদ্র্য বিমোচনের নামে ব্যক্তির ও প্রতিষ্ঠানের ব্যাপক উন্নতি, প্রাচুর্য, গাড়ি-বাড়িসহ বহু নেতিবাচক বিষয় উঠে এসেছে। সূত্রে জানা গেছে, এনজিওগুলো বেশি অনিয়ম করছে ক্ষুদ্র ঋণ বিতরণের ক্ষেত্রে। বিশেষ করে ক্ষুদ্র ঋণ বিতরণের ক্ষেত্রে অধিক পরিমাণ সুদ নিচ্ছে গ্রাহকদের কাছ থেকে। কোন কোন এনজিও গ্রাহকের টাকা নিয়ে পালিয়ে যাচ্ছে। অন্য এনিজওগুলো কোন্ খাতে অর্থ কত ব্যয় করছে, কীভাবে ব্যয় করছে এর জবাবদিহি না থাকায় অধিকাংশ টাকা ব্যয়ের ক্ষেত্রে নয়ছয় করা হচ্ছে বলে অভিযোগ রয়েছে। পিকেএসএফের চেয়ারম্যান বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ ড. কাজী খলীকুজ্জমান আহমদের এক গবেষণায় দেখা গেছে, ক্ষুদ্র ঋণের নামে এনজিওগুলো ১৫ শতাংশ হারে সুদের কথা বলে ঋণ দিলেও সাপ্তাহিক কিস্তিসহ নানা খাতে সুদের হার দাঁড়ায় ৪০ থেকে ৫০ শতাংশ। দরিদ্র পরিবারগুলোর মধ্যে যারা এনজিও থেকে ক্ষুদ্র ঋণ নিয়েছে তাদের মাত্র ৭ শতাংশ দারিদ্র্যসীমার উপরে উঠতে পেরেছে। আর বাকি ৯৩ শতাংশ এখনও দারিদ্র্য সীমার নিচেই ঘুরপাক খাচ্ছে। ওয়াশিংটনভিত্তিক গ্লোবাল মাইক্রো ক্রেডিট ক্যাম্পেনের গবেষণা জরিপেও বাংলাদেশে ৯ দশমিক ৪ শতাংশ অর্থাৎ ২ মিলিয়ন পরিবার ক্ষুদ্র ঋণ নিয়ে দারিদ্র্য সীমার উপরে উঠে আসতে পেরেছে বলে উল্লেখ করা হয়েছে। এই জরিপ অনুযায়ী ৯০ দশমিক ৬ শতাংশ পরিবার অর্থাৎ প্রায় ২৪ মিলিয়ন পরিবার এনজিও থেকে ক্ষুদ্র ঋণ নিয়ে দারিদ্র্য সীমার নিচে অমানবিক জীবন যাপন করছে। টিআইবির ‘এনজিও খাতের সুশাসনের সমস্যা : উত্তরণের উপায়’ এবং বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক ড. আনু মাহমুদের ‘বাংলাদেশের এনজিও :দারিদ্র্য বিমোচন ও উন্নয়ন’ শীর্ষক এক গবেষণাপত্রে বাংলাদেশের এনজিও খাতের হতাশাজনক চিত্র পাওয়া যায়। ওই গবেষণায় বলা হয়েছে, এনজিও গঠন থেকে শুরু করে প্রকল্প অনুমোদন, বাস্তবায়ন, কর্মী নিয়োগ, প্রশিক্ষণ, অর্থ ব্যয়, গাড়ি-বাড়ি ক্রয়, সম্পদ বৃদ্ধি তথা প্রতিটি ক্ষেত্রেই রয়েছে ব্যাপকহারে অনিয়ম-দুর্নীতি। নেই তাদের সঠিক মনিটরিং, মূল্যায়ন, আর্থিক খাতের নিরপেক্ষ অডিট। কোন খাতের অর্থ কোন কোন খাতে ব্যয় হচ্ছে, ওই টাকা কোথায় যাচ্ছে, ক্ষুদ্র ঋণের টাকা নিয়ে ঋণ গ্রহীতারা কী করছে, ১৫ শতাংশ আরোপিত সুদ কিভাবে কিস্তির নামে ৪০/৫০ শতাংশ হারে আদায় করা হচ্ছে, বেকার থেকে এনজিও গঠন করে কিভাবে একজন মানুষ কোটি কোটি টাকার অর্থ-সম্পদের মালিক হচ্ছেন, এনজিও নামে কিভাবে কতিপয় মানুষ প্রচুর সম্পদ, বিলাসবহুল ভবন, প্রাচুর্য ও ধন সম্পদের মালিক হচ্ছেন এসব দেখার কেউ নেই। সূত্রে জানা গেছে, দেশের এনজিওগুলো বিগত ২৩ বছরে বিদেশ থেকে প্রায় ৫৬ হাজার কোটি টাকা এনে খরচ করা হয়েছে। ২০১২-১৩ অর্থবছরের মে পর্যন্ত এনজিওগুলো টাকা ছাড় করেছে ৪ হাজার ৪২৮ কোটি টাকা। ওই বছরে দাতা সংস্থাগুলোর প্রতিশ্রুতি হচ্ছে ৪ হাজার ৭৭ কোটি টাকা। প্রতিশ্রুতির চেয়ে বেশি অর্থ এ বছর এনজিও খাতে এসেছে। এছাড়া গত অর্থবছরে প্রতিশ্রুতি ছিল ৭ হাজার ৪৪ কোটি টাকা। ওই বছর এনজিওগুলোর অনুকূলে অর্থ ছাড় করা হয়েছে ৪ হাজার ৩৪৭ কোটি টাকা। প্রতিবছর গড়ে ৪ হাজার কোটি টাকার ওপরে বিদেশ থেকে এনজিওগুলো অর্থ নিয়ে এসেছে। এসব অর্থ ব্যয় করার কথা হচ্ছে সমাজ উন্নয়ন, দারিদ্র্য বিমোচন, শিক্ষা ও শিশু কল্যাণে। বিচ্ছিন্নভাবে এসব অর্থ আনা হলেও ব্যয় করার সঠিক হিসাব থাকছে না। যে কারণে এ খাত দুর্নীতি ও অনিয়মে জড়িয়ে পড়েছে। সমাজসেবা অধিদফতরের মহাপরিচালক গাজী মোহাম্মদ নূরুল কবীর জানান, স্বেচ্ছাসেবা সমাজকল্যাণ সংস্থাসমূহ (নিবন্ধন ও নিয়ন্ত্রণ) অধ্যাদেশ ১৯৬২ অনুযায়ী দেশের ৬৪ জেলায় এ পর্যন্ত স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন হিসেবে ৫৩ হাজার ২৩২ টি সংস্থাকে নিবন্ধন দেয়া হয়েছে। এসব নিবন্ধনকৃত সংস্থা যুব কল্যাণ, মানসিক অসমর্থ ব্যক্তিদের সহায়তা, চিত্তবিনোদন, দুঃস্থদের সহায়তা, কল্যাণ ও পুনর্বাসনসহ নানাবিধ কল্যাণকর কাজ করার কথা থাকলেও অনেক সংস্থাই তা ঠিকমত করছে না। ফলে সম্প্রতি প্রায় ৮ হাজার এনজিওর নিবন্ধন বাতিল করা হয়েছে। সমাজসেবা অধিদফতর গঠনতন্ত্র পরিপন্থী ও বেআইনী কাজের সঙ্গে সম্পৃক্ত আরও ৩ হাজার এনজিওর নিবন্ধন বাতিলের জন্য মন্ত্রণালয়ে সুপারিশও পাঠানো হয়েছে বলে বিশ্বস্ত সূত্রে জানা গেছে। এ প্রসঙ্গে এনজিও ব্যুরোর এক পরিচালক নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, ব্যুরো থেকে এ পর্যন্ত দেশী-বিদেশী ২ হাজার ৩০৫ টি এনজিওকে নিবন্ধন দেয়া হয়েছে। তারা প্রায় ১১ হাজার প্রকল্পের মাধ্যমে ব্যয় করেছে ৫ হাজার ১০০ কোটি টাকারও বেশি। তিনি বলেন, এনজিও বু্যুরো থেকে সারা দেশে এনজিও কার্যক্রম মনিটরিং করা সম্ভব নয়। এ জন্য বিভাগীয় কমিশনার, জেলা প্রশাসক ও ইউএনওদের মনিটরিংয়ের দায়িত্ব দেয়া হয়েছে। তাদের মাসিক সভা করে এনজিও কার্যক্রম পর্যবেক্ষণ করার জন্যও বলা হয়েছে। কিন্তু নিয়ম অনুযায়ী তা হচ্ছে না। এটি প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় তথা এনজিও ব্যুরোর নির্দেশনা হলেও মফস্বলে যথেষ্ট গাফিলতি করা হচ্ছে। আর এই সুযোগে বহু এনজিও যথেচ্ছভাবে লুটপাট, দুর্নীতি, অনিয়ম, রাজনীতি, অপকর্ম, স্বেচ্ছাচার, প্রতারণাসহ অবৈধ প্রভাব খাটিয়ে যাচ্ছে।
×