ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪৩১

তামিম-বাংলাদেশের নির্ভরতার প্রতীক

প্রকাশিত: ০৬:৪৮, ৩১ মে ২০১৭

তামিম-বাংলাদেশের নির্ভরতার প্রতীক

সময়ের বিবর্তন বুঝি এমনই! ২০১৫ সালের শুরুতেও সমালোচনায় বিদ্ধ ছিলেন তামিম ইকবাল। বিশ্বকাপ ক্রিকেটে প্রায় প্রতিটি ম্যাচেই ইনিংসের শুরুতে দলকে ডুবিয়েছিলেন। যে কারণে অনেক বাংলাদেশী ভক্ত বিরক্তি ও আক্রোশের সুরে সে সময় বলেছিলেন, ‘তামিমকে দল থেকে বাদ দেয়া উচিত। মাঠে তার বডি ল্যাঙ্গুয়েজ দেখে মনে হয় খেলার প্রতি সে সিরিয়াস না। প্রায় প্রতিটি ম্যাচেই এমন দেখা যাচ্ছে। অন্য কাউকে তার বদলে সুযোগ দিলে ভাল করবে মনে হয়।’ বিশ্বকাপের হতাশা ভুলতে মোটেও কালক্ষেপণ করেননি তামিম। নিজ দেশে বিশ্বকাপ পরবর্তী ওয়ানডে সিরিজে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে ফিরে পান নিজের চেনা ছন্দ। পাকিদের হোয়াইটওয়াশ করার পথে তিন ইনিংসের দু’টিতে শতক ও অপরটিতে অর্ধশতক হাঁকান। শুরুর প্রসঙ্গটিই তাই বলতে হচ্ছে। সময়ের ব্যবধানে সেই তামিমই এখন বাংলাদেশের অন্যতম প্রধান ভরসার নাম। পাকিদের বিরুদ্ধে দুর্দান্ত ব্যাটিং পারফরমেন্স ভারতের বিরুদ্ধেও অব্যাহত রাখেন। এরপর ইংল্যান্ডের বিরুদ্ধে ওয়ানডে ও টেস্ট সিরিজেও ব্যাট হাতে উজ্জ্বল ছিলেন ২৮ বছর বয়সী এই মহাতারকা। বিশেষ করে টেস্ট সিরিজে ইংলিশ বোলারদের যম হিসেবে আবির্ভূত হন চট্টলার এই তরুণ। মিরপুরে বাংলাদেশের ঐতিহাসিক টেস্ট জয়ের ভীত গড়ে দেন তামিমই। দারুণ এই ধারাবাহিকতা ধরে রেখেছেন তামিম। আয়ারল্যান্ডে ত্রিদেশী সিরিজে তার ব্যাট হেসেছে। আইসিসি চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফির প্রস্তুতি ম্যাচেও টর্নেডো ইনিংস খেলেছেন। এখন মূল আসরে মেলে ধরার পালা। ইংল্যান্ডে চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফিতে বাংলাদেশের ভাল করার বিষয়টি অনেকটাই নির্ভর করছে তামিমের ব্যাটের ওপর। বার্মিংহামের এজবাস্টনে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে প্রস্তুতি ম্যাচে সেঞ্চুরি করেন তামিম। ৯৩ বলে ৯ চার ও ৪ ছক্কায় ১০২ রানের ইনিংস খেলেন। তামিমের এ ইনিংসে বাংলাদেশও বিশাল স্কোর গড়ে। ৯ উইকেট হারিয়ে ৫০ ওভারে ৩৪১ রান করে বাংলাদেশ। তামিমের সেঞ্চুরির সঙ্গে ইমরুল কায়েস ৬১, মুশফিক ৪৬, মাহমুদুল্লাহ ২৯, মোসাদ্দেক হোসেন সৈকত ২৬, সাকিব আল হাসান ২৩ রান করেন। দুর্দান্ত ফর্মটা ধরে রাখেন তামিম। আয়ারল্যান্ডে দারুণ একটা সিরিজ শেষ করার পর চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফির প্রস্তুতি ম্যাচেও অসাধারণ ব্যাটিং করে চলেছেন। পাকিস্তানের বিপক্ষে তার বিস্ফোরক ব্যাটিং দেখা যায়। টস জিতে ব্যাটিংয়ে নেমে দলীয় ২৭ রানে সৌম্য সরকারকে হারালেও তামিম ও ইমরুল কায়েসের ১৪২ রানের জুটিতে ঘুরে দাঁড়ায় বাংলাদেশ। আয়ারল্যান্ডে অনুষ্ঠিত ত্রিদেশীয় সিরিজে স্কোয়াডে থাকলেও একাদশে সুযোগ পাননি ইমরুল। মূলত সৌম্যর সঙ্গে প্রতিযোগিতা করতে হচ্ছে তাকে। সাব্বির রহমান নিয়মিত তিন নম্বরে খেলায় ওপেনিংয়ে জায়গা নিয়ে লড়াই করতে হচ্ছে দুই বাঁ-হাতিকে। ইমরুল ৬১ রান করে সাজঘরে ফেরেন। আয়ারল্যান্ডে ত্রিদেশীয় সিরিজের আগে প্রস্তুতি ম্যাচে করেছিলেন ৮৬ রান। এরপর ত্রিদেশীয় সিরিজে খেলেছিলেন অপরাজিত ৬৪, ২৩, ৪৭ ও ৬৫ রানের ইনিংস। আয়ারল্যান্ড থেকে ইংল্যান্ডে ফিরেই তিনি শতকের আনন্দে বিভোর। ইমরুলের বিদায়ের পর নামা মুশফিকুর রহীমও ঝড় তুলেছিলেন। তবে ৪ রানের জন্য হাফ সেঞ্চুরি পাননি। ৩৫ বলে তিনটি করে চার ও ছক্কায় ৪৬ রান করে ফেরেন মুশফিক। পাকি বোলারদের বেশ ভালভাবেই সামলিয়েছেন তামিম। ওয়াহাব রিয়াজ, হাসান আলি, জুনায়েদ খানদের মতো বোলারদের বেধড়ক পিটিয়েছেন তামিম। ৩৯ বলে হাফ সেঞ্চুরি করার পর ৮৯ বলে শতকও করেন। শতক হওয়ার পরই অবশ্য ফিরে গেছেন তামিম। ৯৩ বলে ১০২ রান করার পর শাদাব খানের বলে জুনায়েদকে ক্যাচ দেন তিনি। গত বছরের শেষভাগে ইংল্যান্ডের বিরুদ্ধে দুই ম্যাচের টেস্ট সিরিজে রানের দিক থেকে শীর্ষে বাংলাদেশী ওপেনার তামিম। শুধু বাংলাদেশের মধ্যেই নয়, পুরো সিরিজেই সবচেয়ে বেশি রান করেছেন তুখোড় এই বাঁ-হাতি ওপেনার। চার ইনিংসে একটি করে সেঞ্চুরি ও হাফ সেঞ্চুরির সাহায্যে তামিম করেন সর্বোচ্চ ২৩১ রান। ওপেনিংয়ে তামিমের এই ধারাবাহিক পারফরমেন্সের ফল পাচ্ছে বাংলাদেশ ক্রিকেট দল। শুরুতে তামিমের গড়ে দেয়া ভীতের ওপর দাঁড়িয়ে দারুণ সব জয় পাচ্ছে দল। ক্রিকেটের জনকদের আভিজাত্যের টেস্টে মাটিতে নামানোর মূল কারিগরই তিনি। দুই ইনিংসেই ব্যাট হাতে তুলোধোনা করেছেন ইংলিশ বোলারদের। ইংল্যান্ডের বিরুদ্ধে এমন জ্বলজ্বলে ব্যাটিং তামিমের চিরায়াত স্বভাব। ম্যাচের ফলাফল যেমনই হোক। দলের ব্যাটিং যত খারাপই হোকÑতামিম সবসময়ই দুর্বার ইংল্যান্ডের বিরুদ্ধে। টেস্ট ক্রিকেটে বরাবরই শক্তিমত্তায় অনেক বেশি এগিয়ে ইংলিশরা। কিন্তু সেই টেস্ট ক্রিকেটে প্রতিপক্ষ হিসেবে তাদের পেলেই যেন ব্যাট হাতে জ্বলে ওঠেন তামিম। বাংলাদেশের পক্ষে তিন ফরমেটের ক্রিকেটেই সর্বাধিক রানের মালিক এ বাঁ-হাতি ওপেনার বারেবারেই এ প্রমাণ দিয়েছেন। ইংলিশ বোলারদের কাছে মাঠের মোকাবেলায় তাই একেবারে চরম শত্রুতে পরিণত হয়েছেন তিনি। মিরপুর শেরেবাংলা জাতীয় ক্রিকেট স্টেডিয়ামেও সেটার প্রমাণ দিয়েছেন তামিম। সিরিজের দ্বিতীয় ও শেষ টেস্টের প্রথমদিনেই ক্যারিয়ারের অষ্টম এবং ইংলিশদের বিরুদ্ধে তৃতীয় সেঞ্চুরি আদায় করে নেন তিনি। ১০৪ রান করার পর বিদায় নেন তামিম। এর মাধ্যমে যে কোন প্রতিপক্ষের চেয়ে ইংল্যান্ডের বিরুদ্ধেই সর্বাধিক রানের রেকর্ড গড়েন তিনি। পরে দ্বিতীয় ইনিংসেও খেলেন ৪০ রানের জ্বলজ্বলে ইনিংস। তামিম এই শুরুটা করেন ২০১০ সালে ‘ক্রিকেট মক্কা’ ঐতিহাসিক লর্ডসে। ইংল্যান্ডের বিরুদ্ধে প্রথম সেঞ্চুরিটা (ক্যারিয়ারের তৃতীয়) হাঁকিয়েছিলেন সেই টেস্টে। ১০৩ রানের ইনিংস উপহার দেয়ার পরের টেস্টে ম্যানচেস্টারেও ১০৮ রানের ইনিংস উপহার দেন তামিম। এরপর আর ইংল্যান্ডের বিরুদ্ধে খেলা হয়নি তামিমের। দীর্ঘ ৬ বছর ৫ মাস পর আবার প্রতিপক্ষ হিসেবে ইংল্যান্ডকে পেলেন তিনি। চট্টগ্রাম টেস্টের প্রথম ইনিংসেই আবার জ্বলে উঠলেন, ৭৮ রানের দারুণ এক ইনিংস খেললেন। টেস্ট ক্রিকেটে সর্বাধিক ৭ সেঞ্চুরির মালিক তামিম বেশ আগেই হয়েছেন। তবে টানা ১৪ মাসেরও বেশি সময় টেস্ট খেলেনি বাংলাদেশ দল। তবে এমন দীর্ঘ বিরতির পরও মধুর প্রতিপক্ষ ইংল্যান্ডের বিরুদ্ধে নৈপুণ্যে হেরফের ঘটেনি তামিমের। চট্টগ্রাম টেস্টের দ্বিতীয় ইনিংসে অবশ্য তেমন সুবিধা করতে পারেননি, ৯ রানেই বিদায় নেন। কিন্তু দ্বিতীয় টেস্টেই আবার জ্বলে উঠেন। প্রথম ইনিংসের শুরুতেই উদ্বোধন সঙ্গী ইমরুল কায়েসকে হারিয়ে ফেলেন। তাতে বিচলিত হননি একটুও। সাবলীল ভঙ্গিমা নিয়েই মোকাবেলা করেন ইংলিশদের বোলিং আক্রমণ। দ্বিতীয় উইকেটে মুমিনুল হক সৌরভের সঙ্গে ১৭০ রানের বড় জুটি গড়েছেন। এটি টেস্টে দ্বিতীয় উইকেটে বাংলাদেশের পক্ষে চতুর্থ সেরা। তবে ইংল্যান্ডের বিরুদ্ধে এটিই সেরা জুটি দ্বিতীয় উইকেটে। এর আগে হান্নান সরকার ও হাবিবুল বাশার ১০৮ রানের জুটি গড়েছিলেন ২০০৩ সালের অক্টোবরে বঙ্গবন্ধু জাতীয় স্টেডিয়ামে। ক্যারিয়ারের অষ্টম সেঞ্চুরি পেয়ে যান তামিম। তবে এরপর বেশিদূর যেতে পারেননি। ১৪৭ বলে ১২ চারে ১০৪ রান করার পর সাজঘরে ফিরে যান। তবে বাংলাদেশকে দারুণ একটা অবস্থান তৈরি করে দিয়ে যান। ইংল্যান্ডের বিরুদ্ধে এটি তামিমের তৃতীয় সেঞ্চুরি। আগের দুটি করেছিলেন টানা দুই টেস্টে ইংল্যান্ডের মাটিতে। এবার তাদের বিরুদ্ধে প্রথম দেশের মাটিতে শতক হাঁকান। যে কোন প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে তার সর্বাধিক। নিউজিল্যান্ড, দক্ষিণ আফ্রিকা ও শ্রীলঙ্কা ব্যতীত বাকি সবগুলো দলের বিরুদ্ধেই টেস্টে শতক হাঁকিয়েছেন। এর মধ্যে জিম্বাবুইয়ের বিরুদ্ধে আছে ২ সেঞ্চুরি। তবে যে কোন প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে মোট রান করার দিক থেকে এখন ইংল্যান্ডের বিরুদ্ধেই সর্বাধিক তামিমের। ইংল্যান্ডের বিরুদ্ধে ৬ টেস্টের ১২ ইনিংসে ৬১.৩৩ গড়ে তিনি করেছেন ৭৩৬ রান। এই ৬ টেস্টেই অন্তত একটি পঞ্চাশোর্ধ ইনিংস আছেই। আর ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিরুদ্ধে ৮ টেস্টে ৪২.৮৭ গড়ে করেছেন ৬৮৬ রান। সবচেয়ে বাজে অবস্থা দক্ষিণ আফ্রিকার বিরুদ্ধে। ৬ টেস্ট খেলে মাত্র ১৬.৬০ গড়ে মাত্র একটি অর্ধশতক হাঁকিয়ে করতে পেরেছেন ১৬৬ রান! ক্যারিয়ারে যত রান করেছেন এর মধ্যে সিংহভাগই করেছেন তিনি ম্যাচের প্রথম ইনিংসে ব্যাট করে। ২১ টেস্টে আগে ব্যাটিংয়ের সুযোগ পেয়ে তিনি ৪৭.৩০ গড়ে ৬ সেঞ্চুরি ও ৯ হাফ সেঞ্চুরিসহ করেন ১৮৪৫ রান। আর ফিল্ডিংয়ের পর ব্যাটিংয়ে নেমে ২৩ টেস্টে ৩৪.০৪ গড়ে করেছেন ১৪৬৪ রান। সবমিলিয়ে এখন ৪৪ টেস্টে ৪০.৩৫ গড়ে তার রান ৮ সেঞ্চুরি ও ১৯ হাফ সেঞ্চুরিসহ ৩৩০৯। এটি ছিল ঘরের মাটিতে তামিমের পঞ্চম সেঞ্চুরি। তবে ইংল্যান্ডের বিরুদ্ধে দেশের মাটিতে এই প্রথম শতক হাঁকালেন তামিম। যাদের বিরুদ্ধে ১১ ইনিংস খেলে ৫টিতেই অর্ধশতক আর ৩টি সেঞ্চুরি এখন তার। বাকি তিন ইনিংসে তিনি করতে পেরেছেন ১৪, ২ ও ৯। ইংল্যান্ডের বিরুদ্ধে মাত্র চারটি সেঞ্চুরি পেয়েছে বাংলাদেশ দল। তামিম ছাড়া আরেকটি শতক পেয়েছেন জুনায়েদ সিদ্দিকী। ২০১০ সালের মার্চে তিনি চট্টগ্রামে ১০৬ রানের একটি ইনিংস খেলেছিলেন।
×