ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪৩১

মাহমুদুল বাসার

হেফাজতের অপকৌশল

প্রকাশিত: ০৬:২০, ৩১ মে ২০১৭

হেফাজতের অপকৌশল

মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের রাজনৈতিক শক্তির দুর্বলতার সুযোগ নিচ্ছে হেফাজত। হেফাজত জামায়াতের আদর্শ থেকে বিচ্ছিন্ন কোন সংগঠন নয়। বাংলাদেশের দুর্ভাগ্য, বিএনপির মতো একটি বড় দল মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বিশ্বাস করে না। তারা ১৯৭২ সালে প্রণীত সংবিধানটি তছনছ করে সাম্প্রদায়িক সংবিধানে রূপদান করেছিল। জামায়াতের মতো একটি শক্তিশালী শত্রু দলকে রাজনীতির মাঠে নামিয়েছিল বিএনপি দলীয় স্বার্থে। রাজনীতিকে বিপজ্জনক পর্যায়ে নিয়ে গিয়েছিলেন জিয়াউর রহমান। রাজনীতি নিয়ে এমন খেলা আর কেউ খেলেননি। বেগম খালেদা জিয়াও কম খেলেননি। ২০০১ সালের নির্বাচনের সময় বেগম জিয়া ভোলায় নির্বাচনী বক্তৃতা দেয়ার সময় জনগণকে বলেছিলেন তোফায়েল আহমেদের মুখে থুথু ছিটিয়ে দিতে। পত্রিকায় খবরটি পড়ে বুকের মধ্যে মোচড় দিয়ে উঠেছিল। এ দেশের সুশীল, প্রগতিশীল, বামপন্থী কোন পক্ষ থেকে এমন একটি সাংঘাতিক কথার প্রতিবাদ করা হয়নি। ২০০১ সালে ক্ষমতায় গিয়ে ৪ দলীয় জোট সরকার স্বাধীনতার পক্ষের গণমানুষের মুখে থুথু ছিটিয়ে দেয়ার কাজই করেছে জামায়াতের দুর্ধর্ষ নেতাদের গাড়িতে জাতীয় পতাকা উড়াবার সুযোগ দিয়ে। বেগম জিয়া বলেছিলেন, ‘আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসলে মসজিদে উলুধ্বনি বাজবে।’ এমন ন্যক্কারজনক কথার প্রতিবাদ কয়জন করেছিলেন তখন? এ কথা মানতে হবে বিএনপি একটি বড় দল। এই দলের পেছনে দেশের সমস্ত পাকিস্তানপন্থী এবং সাবেক চীনপন্থীরা ঐক্যবদ্ধভাবে আছে। এ কথাটা কোন মামুলি কথা নয় যে, আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসলে মসজিদে উলুধ্বনি বাজবে। এই কথা এদেশের সম্প্রীতিমূলক অসাম্প্রদায়িক চেতনার মূলে কুঠারাঘাত করার মতো। দেশের মাত্র ১০ ভাগ সংখ্যালঘু সম্প্রদায়কে কোণঠাসা করাই এই ধরনের কথার মূল লক্ষ্য। মওলানা ভাসানীর মতো নেতা দেশ স্বাধীনের পর সরাসরি সাম্প্রদায়িক রাজনীতি করেছেন। জিয়াউর রহমানকে স্বাগত জানিয়েছেন। ড. ওয়াজেদ তার বইতে দেখিয়েছেন, এমন উস্কানিমূলক, সাম্প্রদায়িক রাজনীতিতে ইন্ধন দেননি কমরেড মণি সিংহ এবং অধ্যাপক মোজাফফর আহমদ। অথচ স্বাধীন দেশে সেøাগান উঠেছিল, ‘মুজিব-মণি-মোজাফফর বাংলার মীর জাফর।’ তখন কারা দিয়েছিল এই সেøাগান? স্বাধীন বাংলাদেশের মাটিতে মুজিব-মণি-মোজাফফরের রাজনীতিই আসল রাজনীতি। কমরেড মণি সিংহের মতো সর্বজন শ্রদ্ধেয় নেতাকে এক চীনপন্থী তাত্ত্বিক ‘গ্রাম্যবর্বর’ বলেছিলেন। ওই তাত্ত্বিক আবার তথাকথিত বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদের পক্ষে সার্টিফিকেট দিয়েছেন। এই ধারাবাহিকতার সুযোগ নিচ্ছে হেফাজত। বার বার আওয়ামী লীগকে ধর্মের অস্ত্র দিয়ে ঘায়েল করা হয়েছে, তখন প্রগতিশীল, সুশীল বা বামেরা ধর্ম দিয়ে আওয়ামী লীগকে ঘায়েল করার বিপক্ষে একটা কথাও বলেননি। কী করে নির্বিঘেœ রাজাকার শাহ আজিজুর রহমান স্বাধীন দেশের প্রধানমন্ত্রী হতে পারলেন? তিনি বলেছিলেন, ‘আওয়ামী লীগের শাসনামলে কোন মুসলমান মাথায় টুপি দিতে পারতেন না।’ এমন জঘন্য মিথ্যা কথার কোন প্রতিবাদ হয়নি তখন। তখন আওয়ামী লীগের ঘোর দুর্দিন। ঘর থেকে বের হতে পারে না কর্মীরা। মাথায় তাদের ‘ভারতের দালাল’ আর ‘ইসলামর শত্রু’-র বদনাম। শেখ হাসিনা নাকি কলকাতা গিয়ে ১৯৯৬ সালে মন্দিরে পূজা দিয়েছিলেন, কপালে সিঁদুর পরেছিলেন। এ অপবাদ উঠিয়েছিল বিএনপি। এই অপবাদের অস্ত্র দিয়ে ২০০১ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগকে পরাজিত করা হয়েছিল। চিন্তাশীল লেখক আহমদ ছফা আওয়ামী লীগ করতেন না, কিন্তু একটা সাড়া জাগানো কথা বলেছিলেন, ‘আওয়ামী লীগ যখন হারে তখন গোটা দেশটা হারে আর আওয়ামী লীগ যখন জেতে তখন একাই জিতে।’ এ কথাটা অনেকে মনে রাখেন না, বিপদটা এখানে। সুপ্রীমকোর্ট প্রাঙ্গণে একটি ভাস্কর্য স্থাপন করা হয়েছিল। ধান্দাবাজ হেফাজত এই সুযোগটি নিয়েছে। শ্রেষ্ঠ আইনজীবীরা প্রধান বিচারপতিকে এই ভাস্কর্য সরানোর পক্ষে মত দিয়েছেন। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা কেবল ভোটের লোভে এই ভাস্কর্য সরানোর সিদ্ধান্ত দিয়েছেনÑ এ কথা মোটেও সত্য নয়। পরাজয় মোকাবেলা করার অভ্যাস শেখ হাসিনার আছে। ক্ষমতার তখত তাউশে বসে আওয়ামী লীগের জন্ম হয়নি। এই ঐতিহ্যবাহী দলটির জন্ম হয়েছে খোলা আকাশের নিচে। ১৬/৫/১৭ তারিখের দৈনিক সংবাদে প্রতিবেদন ছাপা হয়েছে ‘হেফাজত কি রাজনৈতিক দল হচ্ছে?’ এই শিরোনামে। এই দীর্ঘ প্রতিবেদনে দেখানো হয়েছে, হেফাজত শক্তিশালী একটি সংগঠন। এই অপশক্তি রোধ করতে হলে আওয়ামী লীগকে বিপক্ষে ফেলে, বিএনপিকে স্পেস দিয়ে সম্ভব নয়। আওয়ামী লীগের সমর্থন ছাড়া ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটি গঠিত হয়নি। আওয়ামী লীগের সমর্থনে গণজাগরণ মঞ্চ ইতিহাস সৃষ্টি করছে। তরুণ ব্লগারদের তাজা প্রাণ রক্ষার তাগিদে শেখ হাসিনা গণজাগরণ মঞ্চের তৎপরতা স্তিমিত করে দিয়েছেন। ‘মুজিব-মণি-মোজাফফরের’ লোকেরাই গণজাগরণ মঞ্চের আন্দোলন সমর্থন করেছিলেন। এর বাইরের লোকেরা করেননি। এর বাইরের লোকেরা শিক্ষামন্ত্রী নূরুল ইমলাম নাহিদকে বলেন ‘নাস্তিক’। গণজাগরণ মঞ্চের বিরুদ্ধে হেফাজতের ভূমিকা ছিল ভয়ঙ্কর। তখন কিন্তু ‘মুজিব-মণি-মোজাফফরের লোকজন ছাড়া অন্যরা সরবে ও নীরবে হেফাজতকে সমর্থন দিয়ে যাচ্ছিলেন। হেফাজত অপকৌশলের আশ্রয় নিয়েছে। হেফাজতের হুজুররা মিথ্যাচারে দক্ষ। পত্রিকায় হেফাজতের বিবৃতি দেখলাম, ‘সুপ্রীমকোর্ট চত্বর থেকে ভাস্কর্য সরানোয় দেশবাসী ও প্রধানমন্ত্রীর প্রতি সন্তুষ্টি প্রকাশ করেছে। শুক্রবার বাদ জুমা বায়তুল মোকাররম জাতীয় মসজিদের তিন নম্বর ফটকের সামনে এক সংক্ষিপ্ত সমাবেশে দলটির নেতারা এ দাবি জানান। এই সঙ্গে তারা সারাদেশে স্থাপিত সব মূর্তি সরানোর দাবি জানান।’ (যায়যায় দিন)। হেফাজতের ধূর্তরা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ভাবমূর্তি বিকৃত করার জন্য এই বিবৃতি দিয়েছে। অন্যদিকে ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদ এক বিবৃতি দিয়ে বলেছেন, ‘প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশে নয়, প্রধান বিচারপতি নিজেই সুপ্রীমকোর্টের মূল প্রাঙ্গণ থেকে ভাস্কর্য অপসারণের সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। তাদের সিদ্ধান্তেই ভাস্কর্যটি সরানো হয়েছে। এতে প্রধানমন্ত্রীর কোন কৃতিত্ব নেই। প্রধানমন্ত্রীর কৃতিত্ব না থাকলে কি হবে দোষ ঠিই থাকবে। অন্যদিকে দৈনিক জনকণ্ঠের এক প্রতিবেদনে উল্লেখ আছে, ‘সুপ্রীমকোর্টের ভাস্কর্যটি সরানোতে স্পষ্ট হলো পেছনে ঢেকে যাওয়া বাংলাদেশের মানচিত্র। লেডি জাস্টিসের আদলে ভাস্কর্যটি স্থাপনের পর সুপ্রীমকোর্টের দেয়ালে আগে থেকে স্থাপিত মানচিত্রটি আড়ালে পড়ে যায়। ভাস্কর্য স্থাপনে মানচিত্র আড়ালে পড়ে যাওয়ার ঘটনাটিকে অনিচ্ছাকৃত ভুল হিসেবে দেখতে চান অনেকে।’ (২৭/৫/১৭)। এসব উপাদানের সমীকরণে ভাস্কর্য সরানো অপিরহার্য ছিল। আর এ কথা স্পষ্টতই বলা দরকার যে, ধর্মান্ধ-মৌলবাদীদের কিছু না বলে শুধুু সরকারকে দোষারোপ করার ফলাফল হবে শূন্য। লেখক : শিক্ষাবিদ
×