ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

মোতাহার হোসেন

অভিমত ॥ ফুটপাথ সবুজায়নে...

প্রকাশিত: ০৬:১৮, ৩১ মে ২০১৭

অভিমত ॥ ফুটপাথ সবুজায়নে...

রাজধানী ঢাকা ও বন্দরনগী চট্টগ্রামের বিভিন্ন ব্যস্ত রাস্তা তথা রাজপথের দুই ধারের ফুটপাথকে সবুজে সবুজে ঢেকে দেয়ার উদ্যাগ নেয়া হয়েছে। পাশাপাশি চট্টগ্রামে রাস্তার মধ্যখানে আইল্যান্ডে গাছ লাগানো হয়েছে। সম্প্রতি এ ধরনের একটি খবর পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছে। খবরটি নিঃসন্দেহে সুখবর এবং যান্ত্রিক এই নগরীর মানুষের জন্য স্বস্তিদায়ক। পৃথিবীর তাবত উন্নত রাষ্ট্রে এই ব্যবস্থা চালু আছে। রাজধানী ঢাকা ও বন্দরনগরী চট্টগ্রামের রাজপথের দুই ধারে সবুজায়নের উদ্যোগ শুধু উদ্যোগের মধ্যে সীমিত থাকবে না। আশা করছি তা বাস্তবায়িত হবে শত ভাগ এবং একই সঙ্গে এই কর্মসূচী হবে টেকসই এবং দীর্ঘস্থায়ী। একই সঙ্গে এসব বৃক্ষ সংরক্ষণ, পরিচর্যার বিষয়টিও গুরুত্বসহ বিবেচনায় নিতে হবে। ঢাকা সিটি কর্পোরেশন উত্তর ও দক্ষিণের মেয়রদ্বয়ের উদ্যোগে রাজধানীর বিভিন্ন বড় বড় রাস্তার ফুটপাথে দেশী-বিদেশী বিভিন্ন জাতের গাছ লাগানো হচ্ছে। আবার কিছু কিছু সড়কে সড়ক ও জনপথ অধিদফতরের উদ্যোগে বৃক্ষরোপণ করা হচ্ছে। তবে তাদের লাগানো গাছ দেশী নয়, বিদেশী এবং পরিবেশের জন্য উপযোগী নয় বলে সম্প্রতি খবর বেরিয়েছে। তাই এখন থেকে বিষয়টি খতিয়ে দেখা উচিত সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের। এখন মূল কথায় ফিরে আসা যাক, রাজপথের পাশের ফুটপাথের নয়নাভিরাম এই সবুজময় দৃশ্যে প্রকৃতিপ্রেমী, বৃক্ষপ্রেমী যে কাউকে সহজেই আকৃষ্ট করবে। পাশাপাশি পরিবেশ রক্ষা এবং তপ্ত রোদে রাজপথের গরম আবহাওয়াকে কিছুটা হলেও সুশীতল ছায়ায় আর বাতাসে পথচারীকে দোদ- শান্তির পরশ ভুলিয়ে দেবে। নগরজুড়েই ফুটপাথে এ রকম কর্মসূচীর সম্প্রসারণ হবে এমন প্রত্যাশা প্রকৃতি, বৃক্ষপ্রেমীসহ পরিবেশবাদীদের। ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের আওতাধীন সব ক’টি সড়কের দু’পাশে প্রশস্ত ফুটপাথ আছে সেখানেই নিজস্ব খরচে এবং বন অধিদফতরের সহযোগিতায় নানান জাতের বৃক্ষরোপণের কর্মসূচী নেয়া হয়েছে। নগর ভবনের দু’পাশে, মতিঝিল, দৈনিক বাংলা, ফকিরাপুল, প্রেসক্লাব, হাইকোর্ট, সুপ্রীম কোর্ট, টিএসসিসহ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকা, সায়েদাবাদ, যাত্রবাড়ী, বিশ্ব রোডসহ অত্র সিটি কর্পোরেশন আওতাধীন প্রায় ৭০ কিলোমিটারজুড়েই লাগানো হচ্ছে গাছ। ফুটপাথগুলো স্বাচ্ছন্দ্যে চলাচলের উপযোগী হলে নিকট দূরত্বে মানুষ হেঁটে যাতায়াত করতে পারবে। ফুটপাথে বৃক্ষরোপণ করায় খুবই ভাল লাগছে। এখন গুলিস্তানে এলে শহরের মতো মনে হয়। মনে হয় স্মার্ট কোন্ শহরে আছি। সচেতন ব্যবসায়ীদের উদ্যোগও ভাল লাগছে। তারা ইট-বালু-কংক্রিটের এ শহরে একটু সবুজের ছোঁয়া এনে দিয়েছেন। এভাবে ব্যবসায়ীরা যদি নিজ উদ্যোগে ফুটপাথে বাহারি গাছের সমারোহ ঘটান তাহলে শীঘ্রই সবুজ ঢাকায় পরিণত হবে আমাদের প্রিয় এ রাজধানী। এ প্রসঙ্গে মরমী কবি, গবেষক ইবনে সালেহ মুনতাসির রচিত ‘সবুজায়ন’ শীর্ষক লিরিকটি প্রাসঙ্গিক বলে প্রতীয়মান হয়েছে। লিরিকটি হচ্ছে : সবুজায়ন হলে প্রকৃতি তার রূপ ফিরে পায়, মানুষ ফিরে পায় জীবনের গতি, স্বচ্ছন্দ/ গ্রীন শিল্পায়ন কার্বন নিঃসরণ কমাতে হবে/ তাপমাত্রা কমাতে হবে/সমুদ্রতল নামাতে হবে করা যাবে না উষ্ণায়ন/ করতে হবে গ্রীন শিল্প কল-কারখানা/ করতে হবে গ্রীনের অগ্রায়ন ॥ গ্রীন বিপ্লব গ্রীন অর্থনীতি গ্রীন উন্নয়ন পরিকল্পনা/অবসান ঘটাতে হবে অমানিশার জল্পনা-কল্পনা/সবুজ আইন সবুজ শাসন সবুজ ক্ষমতার হাত ধরি/ সবুজ রাষ্ট্র সবুজ সরকার সবুজনীতির অনুসরণ করি। রাজধানীর ফুটপাথগুলোতে হকারদের অবৈধ ব্যবসার কারণে হাঁটা যেত না। স্বাচ্ছন্দ্যে গন্তব্যে পৌঁছাতে সীমাহীন দুর্ভোগ পোহাতে হতো। এ অবস্থা থেকে মুক্তি দিতে নগরীর গুরুত্বপূর্ণ এলাকা গুলিস্তান, মতিঝিল ও নিউমার্কেট হকারমুক্ত করে ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশন (ডিএসসিসি)। বেশ কয়েকবার উচ্ছেদের পর পুরোপুরি হকারমুক্ত করা হয় ফুটপাথ। এ অবস্থায় উন্মুক্ত ফুটপাথের দু’পাশে ফুলের টবসহ বাহারি গাছ-গাছালির সমারোহ ঘটিয়েছেন শৌখিন দোকান মালিকরা। নগরবাসী এখন স্বাচ্ছন্দ্যে এবং নান্দনিক সৌন্দর্য উপভোগের মধ্য দিয়ে ফুটপাথ পার হচ্ছেন। গুলিস্তান জিরো পয়েন্ট থেকে হোটেল ইম্পেরিয়াল হয়ে স্টেডিয়ামের পাশ দিয়ে বঙ্গবন্ধু স্কয়ার পর্যন্ত ফুটপাথের এক পাশে দোকানিরা নিজ উদ্যোগে সিমেন্টে বাঁধাই ফুলদানিতে বাহারি গাছ ও বনসাই স্থাপন করেছেন। হাঁটা সাধারণ যাত্রীরা এতে ভীষণ খুশি। ইট-কংক্রিটের এ রাজপথে সবুজের ছোঁয়াকে না ভালবাসবে? এ কারণে সিটি কর্পোরেশনের এ উদ্যোগ। এতদিন হকারদের ঝুপড়ির কারণে সামনে কিছুই দেখা যেত না। সাধারণ পথচারীরা ফুটপাথও ব্যবহার করতে পারতেন না। কিন্তু এখন হকারদের উৎপাত নেই। নগরবাসীকে একটু সবুজের পরশ দিতে সিমেন্টের তৈরি ফুলের টব বসিয়ে তাতে নানা জাতের গাছ লাগানো হয়েছে। পথচারীরা এ ফুটপাথ ব্যবহার করে যাতে একটু স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলতে পারেন। ব্যক্তি উদ্যোগেও চলছে সবুজায়নের কাজ। রাজধানীর কোথাও কোথাও আবার ব্যতিক্রম দেখা গেছে। বর্জ্যে ভরা খোলা ডাস্টবিন আর স্যুয়ারেজের (পয়োনিষ্কাশন) দুর্গন্ধে যেখানে পথচারীরা নাস্তানাবুদ হতো, সেখানেও সুগন্ধী ফুলের গাছ টবে লাগাচ্ছেন কেউ কেউ। রাজধানীর হকারদের দখলে থাকা স্থানগুলোর মধ্যে গুলিস্তান, বাইতুল মোকাররম, মতিঝিল, দৈনিক বাংলা, নিউমার্কেটসহ বেশ কয়েকটি স্থান অন্যতম। এসব এলাকা হকারদের দখলে থাকায় সাধারণ পথচারীরা নির্বিঘেœ চলাচল করতে পারতেন না। চুরি-ডাকাতিসহ অন্যান্য অপরাধ সংঘটিত হতো। বাধ্য হয়ে ফুটপাথ হকারমুক্ত করতে উদ্যোগ নেয় কর্পোরেশন। হকারমুক্ত করার পর ফুটপাথগুলো পাহারায় স্বেচ্ছাসেবক নিয়োগ দেয়া হয়েছে। যাতে কেউ ফুটপাথ ফের দখল করতে না পারে। পাশাপাশি আশপাশের ব্যবসায়ীদেরও সচেতন করতে নানা উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। ব্যবসায়ীদের ফুটপাথে ফুলের বাগানসহ আকর্ষণীয় দৃষ্টিনন্দন স্থাপত্য বসাতে পরামর্শ দেয়া হয়েছে। এটা অনেকেই জানেন, ফুটপাথগুলো অবৈধভাবে দখল করে কোটি কোটি টাকার ব্যবসা করেছে তথাকথিত রাজনৈতিক নেতা, পুলিশ ও লাইনম্যানরা। হাজার হাজার টাকা দোকান ভাড়া দিয়ে কোন ব্যবসা করতে না পেরে হতাশ হয়ে পড়েছিলাম। পরবর্তীতে সিটি কর্পোরেশন ফুটপাথ দখলমুক্ত করে। এখন ভাল ব্যবসা হচ্ছে। মানুষও দোকানে আসছে। দোকানের সামনে আর কোন হকারকে বসতে দেয়া হবে না। এ জন্য ফুটপাথে বাহারি গাছের টব বসিয়েছে। এমন উদ্যোগে সাধারণ মানুষও অভিনন্দন জানায়। অনেকেই দোকানে এসে বলছেন, খুব সুন্দর হয়েছে, খুবই ভাল উদ্যোগ। ঢাকাকে সবুজে রূপান্তরিত করতে ‘জল সবুজে ঢাকা’ নামে একটি প্রকল্প রয়েছে দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের। এ কাজে নগরবাসীকে উৎসাহিত করতে ১০ শতাংশ হোল্ডিং ট্যাক্স মওকুফ করা হয়েছে। পর্যায়ক্রমে নগরীর সব ক’টি সড়ক, সড়ক বিভাজনকারী আইল্যান্ডসহ পুরো ফুটপাথে ফুলবাগান করার পরিকল্পনা রয়েছে। কাজটি শেষ হলে ঢাকার দৃশ্য পাল্টে যাবে। সবুজ ও দূষণমুক্ত নগর গড়তে সবার সহযোগিতা দরকার। একইভাবে ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশনের আওতাধীন বিমানবন্দর সড়ক থেকে শুরু করের বনানী, নিউ ডিওএইচএস, গুলশান, বারিধারা, বসুন্ধরা, কাওরান বাজার, মহাখালী, মিরপুর, মোহাম্মদপুরের কিছু রাস্তার ফুটপাথকে সাজানো হয়েছে নানা জাতের দেশী-বিদেশী গাছে গাছে। এ দৃশ্য পথচারীসহ রাস্তায় চলাচলকারী যে কোন মানুষের দৃষ্টি কাড়বে। এক কথায় এই সবুজে সবুজে ছেয়ে গেছে রাজধানীর অধিকাংশ রাজপথের দু’পাশের ফুটপাথ। এ নিয়ে ইতোপূর্বে মেয়র সংবাদমাধ্যমকে বলেছিলেন, রাস্তার দু’পাশে বৃক্ষরোপণ করা হচ্ছে। এতে একদিকে পরিবেশ সবুজায়ন হবে, পথচারীরা ফুটপাথ দিয়ে হেঁটে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করবেন। অন্যদিকে সবুজের মনমাতানো সমারোহের নয়নাভিরাম দৃশ্যের নজর কাড়বে নগরবাসীর। আগামী এক বছরের মধ্যে তার নির্বাচনী এলাকার সব কয়টি রাস্তার পাশের ফুটপাথে বৃক্ষরোপণ সম্পন্ন হবে। আমাদের প্রত্যাশা থাকবে শুধু গাছ লাগিয়ে এই মহতী কর্মযজ্ঞ শেষ করলেই হবে না। একই সঙ্গে এসব বৃক্ষের পরিচর্যা, রক্ষণাবেক্ষণ ও করার ওপরও গুরুত্ব দিতে হবে। তবেই এই মহতী উদ্যোগের সুফল পাবেন নগরবাসী এবং ফুটপাথ ব্যবহারকারীরা। পাশাপাশি যন্ত্রনির্ভর নগর জীবনে কিছুটা হলেও আসবে স্বস্তি। লেখক : সাংবাদিক [email protected]
×