ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

সলিম উদ্দীনের ৪৬ বছরেও মুক্তিযোদ্ধার স্বীকৃতি মেলেনি

প্রকাশিত: ০৬:০৩, ৩১ মে ২০১৭

সলিম উদ্দীনের ৪৬ বছরেও মুক্তিযোদ্ধার স্বীকৃতি মেলেনি

সোহেল তানভীর ॥ ‘তিন দিনের তুমুল যুদ্ধ চলছে। কখনও আমরা এগিয়ে যাচ্ছি। আবার কখনও পিছিয়ে। বৃহস্পতিবার দুপুর থেকে পাক সেনারা ভারি অস্ত্রের ব্যবহার শুরু করলে আমাদের টিকে থাকা কঠিন হয়ে পড়ে। অনবরত ফায়ার করে সামনের দিকে এগিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করি। সেদিন বিকেল বেলা আমার ডান পাশে যুদ্ধ করতে থাকা ফতেপুর গ্রামের নবিছদ্দি সামান্য মাথা উঁচু করলেই একটি গুলি এসে তাঁর মাথার খুলি উড়িয়ে নেয়। সে লুটিয়ে পড়ে আমার ডান পাঁজরে। কিছুক্ষণ পরই আমার বাম পাশে যুদ্ধ করতে থাকা কোটচাঁদপুরের আমির আলী গুলিবিদ্ধ হলে সাহায্যের জন্য চিৎকার করতে থাকে। মুহূর্তটিতে পাকসেনাদের শক্তিশালী টিম আমাদের লক্ষ্য করে অনবরত গুলি ছুড়ছিল। আমরাও গুলি করতে করতে এগিয়ে যাচ্ছিলাম। সেদিন মৃত্যুমুখে পতিত হওয়া আমির আলীকে আমরা সাহায্য করতে পারিনি। আমির আলীর সেই শেষ আর্তচিৎকার আজও আমাকে কষ্ট দেয়।’Ñ কথাগুলো বলছিলেন সম্মুখযুদ্ধে অংশ নেয়া সলিম উদ্দীন। ঝিনাইদহের হরিণাকু-ু উপজেলার হরিণাকু- গ্রামের এই বাসিন্দা ৮নং সেক্টরের অধীন বিষয়খালি যুদ্ধে অংশ নেন। জনকণ্ঠের কাছে তুলে ধরেন যুদ্ধদিনের স্মৃতি। তবে স্বাধীনতার ৪৬ বছরেও মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে স্বীকৃতি মেলেনি তার। অভাব অনটনে অনাহারে কাটছে তার শেষ সময়। অর্থাভাবে চিকিৎসাও হচ্ছে না। আক্ষেপের সঙ্গে জনকণ্ঠকে বলেন, যুদ্ধে অংশ নিয়েও আজ আমি অবহেলার শিকার। শরীর ভাল নেই। ওষুধ কেনার টাকা নেই। দেশের জন্য যুদ্ধ করেও আজ আমার এই অসহায়ত্ব! সলিম উদ্দীনের সম্মুখযুদ্ধে অংশ নেয়ার সত্যতা নিশ্চিত করে সহযোদ্ধা মোঃ ইয়াকুব (গেজেট নং ৩০০) জনকণ্ঠকে বলেন, সলিম উদ্দীন বিষয়খালি যুদ্ধে আমাদের সঙ্গে যুদ্ধ করেছেন। যুদ্ধ শেষে যখন মুক্তিযোদ্ধাদের নাম তালিকা করা হচ্ছিল তখন সলিম আবেদন করেনি। সম্প্রতি সে আবেদন করে। কিন্তু তার বিরুদ্ধে একটি মহল তীব্র ষড়যন্ত্র করছে। একজন মুক্তিযোদ্ধার সঙ্গে এ ধরনের ষড়যন্ত্র আমাদের দুঃখ দেয়। একই ধরনের কথা জানান তার আরেক সহযোদ্ধা ইদ্রিস আলীও (গেজেট নং ৩০৪)। জনকণ্ঠকে সলিমের সহ-মুক্তিযোদ্ধা ইদ্রিস বলেন, সলিম উদ্দীন কেবল মুক্তিযোদ্ধাই ছিলেন না, তিনি ছিলেন একজন আনসার। বিষয়খালি যুদ্ধে আমাদের সঙ্গে একই কাতারে যুদ্ধ করেছেন। এই ধরনের ত্যাগী লোকদের যদি স্বীকৃতি দেয়া না হয় তাহলে দুঃখ লাগে। জানতে চাইলে হরিণাকু- থানার মুক্তিযোদ্ধা যাচাই-বাচাই কমিটির চেয়ারম্যান মোঃ নুরুদ্দিন আহম্মে[জঞঋ নড়ড়শসধৎশ ংঃধৎঃ: }থএড়ইধপশ[জঞঋ নড়ড়শসধৎশ বহফ: }থএড়ইধপশদ জনকণ্ঠকে বলেন, এলাকায় প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়েও নানান ষড়যন্ত্র হচ্ছে। কাদা ছোড়াছুড়ি ও গ্রুপিং অনেক বেশি। মুক্তিযোদ্ধাকেও রাজাকার বানিয়ে দেয়া হচ্ছে। সলিম উদ্দীনের ব্যাপারে আমরা তথ্য সংগ্রহ করছি এবং সেসব তথ্য যাচাই-বাচাই করছি। আশা করি কোন মুক্তিযোদ্ধাও বাদ পড়বে না। বিষয়খালি যুদ্ধের ঘটনাপ্রবাহ বর্ণনা করে সলিম উদ্দিন বলেন, সেদিন ৭১ সালের এপ্রিল মাসের মঙ্গলবার। ১০ জন করে সদস্য নিয়ে আমরা মোট ২০টি উপদলে ভাগ হয়ে যশোরের দিকে অগ্রসর হচ্ছি। আমি ছিলাম ১০ জনের একটি দলের কমান্ডার। বিষয়খালি নামক স্থানে এসে পাক সেনাদের মুখোমুখি হলে সেখানে তুমুল যুদ্ধ বেঁধে যায়। তাড়াতাড়ি আমরা রাস্তা থেকে নেমে রাস্তার পাশের গর্তগুলোকে যুদ্ধের বাঙ্কার হিসেবে ব্যবহার করি। এখানে তিনদিন তুমুল যুদ্ধ চলে। পরে বৃহস্পতিবার দুপুর থেকে পাক সেনারা ভারি অস্ত্র ব্যবহার শুরু করলে তাদের সে ভারি অস্ত্রের মুখে আমাদের টিকে থাকা কঠিন হয়ে পড়ে। তারপরও আমরা অনবরত ফায়ার করে সামনে এগিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করি। ওইদিন বিকেল বেলা আমার ডান পাশে যুদ্ধ করতে থাকা ফতেপুর গ্রামের নবিছদ্দি সামান্য মাথা উঁচু করলেই একটি গুলি এসে তাঁর মাথার খুলি উড়িয়ে নেয়। কিছুক্ষণ পরই আমার বাম পাশে যুদ্ধ করতে থাকা কোটচাঁদপুরের আমির আলীর মাথার এক পাশে গুলি লাগলে তিনি সাহায্যের জন্য চিৎকার করতে থাকেন। তখন আমাদের পাক সেনাদের শক্তিশালী টিম অনবরত গুলিবর্ষণ করে যাচ্ছিল। তাই আমরাও অনবরত গুলি করে সামনের দিকে এগিয়ে যাচ্ছিলাম। তাই সেদিন মৃত্যুমুখে পতিত হওয়া আমির আলীকে আমরা সাহায্য করতে পারিনি। আমির আলীর সেই শেষ মুহূর্তের আর্তচিৎকার আজও আমাকে কষ্ট দেয়। পরবর্তী ঘটনাপ্রবাহ বর্ণনা করে তিনি বলেন, তারপর সন্ধ্যার কিছু আগে আমাদের রাইফেলের গুলি ফুরিয়ে যায় বলে আমরা পিছু হটতে বাধ্য হই। তখন আমি শহীদ হওয়া নবিছদ্দির রাইফেলে গুলি থাকতে পারে এই ভেবে তাঁর মৃতদেহের কাছে এগিয়ে যাই। ঠিক সেই মুহূর্তে আমার ডান বগলের ফাঁক দিয়ে একটি গুলি বেরিয়ে যায়। মাত্র দুই ইঞ্চির ব্যবধানে আল্লাহ পাক সেদিন আমাকে রক্ষা করেছিলেন। তারপর আমরা যুদ্ধের কৌশল হিসেবে সম্মুখ যুদ্ধ ছেড়ে গেরিলা যুদ্ধের পথ বেছে নেই। যুদ্ধে জড়িয়ে যাওয়া প্রসঙ্গে তিনি জানান, ১৯৭১ সালের ফেব্রুয়ারি মাস। সদ্য বিবাহ করেছি। বউয়ের হাতের মেহেদি তখনও শুকায়নি। এরই মধ্যে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান স্বাধীনতার ডাক দেন। ৭ মার্চে ভাষণে অনুপ্রাণিত হয়ে স্বদেশ মুক্তির আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়ি। জানা গেছে, মুক্তিযুদ্ধে একজন সক্রিয় অংশগ্রহণকারী বলে তার বাড়ির দিকে পাক-দখলদার বাহিনীর বিশেষ নজর ছিল। যুদ্ধের সময়টিতে সলিমের স্ত্রীকে নানান ভয়-ভীতির মধ্যে থাকতে হয়েছে। সলিমের স্ত্রী থাকতে পারেননি স্বামীর বাড়িতে। লুকিয়ে থেকেছেন আত্মীয়স্বজনের বাড়িতে। নববধূর জীবন কেটেছে অনেকটা এ বাড়ি ও বাড়ি! যুদ্ধের পূর্বে সলিম ছিলেন আনসার বাহিনীতে। তাই যুদ্ধে অংশ নিতে তাকে নতুন করে প্রশিক্ষণ নিতে হয়নি। বরং অস্ত্র চলেছে অনেকটা প্রশিক্ষিত হাতে। তার ছোড়া গুলিতে নিহত হয়েছে পাক হায়েনারা। লুটিয়ে পড়েছে একের পর এক। বিষয়খালি যুদ্ধ ছাড়াও অংশ নিয়েছেন একাধিক গেরিলা যুদ্ধে। নয় মাস যুদ্ধ করেও বেঁচে যান। জনকণ্ঠকে বলেন, বিষয়খালি যুদ্ধের শেষ পর্যায়ে সে যাত্রায় বেঁচে গিয়েছে সৃষ্টিকর্তার অশেষ কৃপায়ে। তবে জীবন বাজি রেখে যুদ্ধে অংশ নিয়েও তিনি অবহেলিত। ঠিক সময়ে আবেদন করেনি। সলিমের মতো অনেক মুক্তিযোদ্ধাই যুদ্ধ পরবর্তী সময়ে করেননি যেমন। আর এই সময়ে এসে সে ভুলই শুধরে উঠতে চান। চান সহযোদ্ধাদের মতো মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে তারও স্বীকৃতি।
×