ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১

ষোড়শ সংশোধনী মামলায় প্রধান বিচারপতির বক্তব্যের উত্তরে এ্যাটর্নি জেনারেল

‘আপনারা পার্টি হবেন না’

প্রকাশিত: ০৫:৫৫, ৩১ মে ২০১৭

‘আপনারা পার্টি হবেন না’

আরাফাত মুন্না ॥ ভারতে মহাত্মা গান্ধীকে সব দল সমানভাবে শ্রদ্ধা করলেও বাংলাদেশে একটি দল (বিএনপি-জামায়াত জোট) বঙ্গবন্ধুর নাম মুখেও আনে না বলে মন্তব্য করেছেন এ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম। সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনী হাইকোর্টের বাতিলের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রপক্ষের করা আপীল শুনানিতে এ্যাটর্নি জেনারেল এমন মন্তব্য করেন। ভারতের উদাহরণ টেনে প্রধান বিচারপতি বাংলাদেশের রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে সব বিষয়েই বিভক্তির কথা বললে এ্যাটর্নি জেনারেল বলেন, ‘আপনারা পার্টি হবেন না। এভাবে বললে একটি দল মনে করবে এই রায়ে তাদের জয় হয়েছে।’ বুধবার প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহা (এসকে সিনহা) নেতৃত্বাধীন আপীল বিভাগের সাত বিচারপতির বেঞ্চে সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনী বাতিল সংক্রান্ত আপীলের দশম দিনের শুনানিতে এ্যামিকাস কিউরিদের বক্তব্য উপস্থাপন শেষ হয়েছে। পরে বৃহস্পতিবার পর্যন্ত এ আপীলের শুনানি মুলতবি করেছেন সুপ্রীমকোর্ট। ওইদিন রাষ্ট্রপক্ষকে তাদের বক্তব্য উপস্থাপনের মাধ্যমে শুনানি শেষ করতেও নির্দেশ দেন আপীল বিভাগ। এ সময় আদালতে রাষ্ট্রপক্ষে উপস্থিত ছিলেন এ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম ও অতিরিক্ত এ্যাটর্নি জেনারেল মুরাদ রেজা। রিটকারীদের পক্ষে উপস্থিত ছিলেন এ্যাডভোকেট মনজিল মোরসেদ। এ মামলায় সুপ্রীমকোর্টের নিযুক্ত ১২ জন এ্যামিকাস কিউরির (আদালতকে সহায়তা দানকারী) মধ্যে ১০ জন বক্তব্য উপস্থাপন করেন। বাকি দুইজন বক্তব্য উপস্থাপন থেকে বিরত থাকেন। বক্তব্য প্রদান করা ১০ জনের মধ্যে শুধু জ্যেষ্ঠ আইনজীবী আজমালুল হোসেন কিউসি ষোড়শ সংশোধনী রাখার পক্ষে মত দেন। বাকিরা এ সংশোধনী বাতিলের পক্ষে নিজেদের যুক্তি তুলে ধরেন। সংশোধনী বাতিলের পক্ষে মত দেয়া ৯ আইনজীবী হলেনÑ ব্যারিস্টার এম আমীর-উল ইসলাম, বিচারপতি টি এইচ খান, ড. কামাল হোসেন, এ এফ হাসান আরিফ, ব্যারিস্টার রোকন উদ্দিন মাহমুদ, আবদুল ওয়াদুদ ভূঁইয়া, এম আই ফারুকী এবং এ জে মোহাম্মদ আলী। এ্যাডভোকেট মতিন খসরু এ্যামিকাস কিউরি হিসেবে নিযুক্ত না হলেও ব্যাখ্যাকারী হিসেবে আদালতের অনুমতি নিয়ে বক্তব্য উপস্থাপন করেন। তিনি আজমালুল হোসেন কিউসির বক্তব্যকে সমর্থন করে সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনী রাখার পক্ষে মত দেন। প্রধান বিচারপতি ছাড়া বেঞ্চের অন্য সদস্যরা হলেনÑ বিচারপতি মোঃ আবদুল ওয়াহ্হাব মিঞা, বিচারপতি নাজমুন আরা সুলতানা, বিচারপতি সৈয়দ মাহমুদ হোসেন, বিচারপতি মোহাম্মদ ইমান আলী, বিচারপতি হাসান ফয়েজ সিদ্দিকী ও বিচারপতি মির্জা হোসেইন হায়দার। মঙ্গলবার শুনানির শুরুতেই আদালতে আগের দিনের অসমাপ্ত বক্তব্য উপস্থাপন করেন জ্যেষ্ঠ আইনজীবী আজমালুল হোসেন কিউসি। তিনি সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনীর মাধ্যমে সংসদের হাতে বিচারক অপসারণের যে ক্ষমতা দেয়া হয়েছে তাকে সমর্থন করে যুক্তি উপস্থাপন করেন। শুনানির এ পর্যায়ে বিচার বিভাগের অবকাঠামোগত নানা সমস্যার কথা উল্লেখ করেন প্রধান বিচারপতি। পরে বিভিন্ন মামলায় উচ্চ আদালতের বিচারকদের দৃষ্টান্তুমূলক ভূমিকার কথা উল্লেখ করে প্রধান বিচারপতি বলেন, আমি হাজারটা উদাহরণ দিতে পারি যে, দৃষ্টান্ত রেখে চলেছে আমাদের সুপ্রীমকোর্ট। এই যে নারায়ণগঞ্জের সাত খুন মামলা; সারা পৃথিবীতে চাঞ্চল্যের সৃষ্টি করলো। সারাদেশের মানুষ যখন ন্যায়বিচারের প্রত্যাশা করলো তখন এ সুপ্রীমকোর্টের ইন্টারফেয়ারেই ওই মামলার জট খুলে গেল। আমি যদি হাজারিবাগের ট্যানারির কথা বলি, তাহলেও বলব, এই সুপ্রীমকোর্টের ইন্টারফেয়ারেই ট্যানারি স্থানান্তরিত হয়েছে। প্রধান বিচারপতি আরও বলেন, এ শহরও দূষণের হাত থেকে রক্ষা পেয়েছে। গুলশান, বারিধারা লেক আর শীতলক্ষ্যা, বুড়িগঙ্গাও সুপ্রীমকোর্টের ইন্টারফেয়ারেই রক্ষা পেয়েছে। কারণ এ সুপ্রীমকোর্ট দেশের জনগণের স্বার্থে ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠায় সব সময় পদক্ষেপ নিয়েছে। শুনানির একপর্যায়ে প্রধান বিচারপতি বলেন, এখানে যারা আছেন, বিচারকরা সবাই স্বাধীন, আমি ছাড়া। প্রধান বিচারপতি কতটা পরাধীন? এ সময় এ্যাটর্নি জেনারেল বলেন, ‘আপনি পরাধীন না, প্রতিদিন কাগজ খুললে আপনার অনেক বক্তব্য পাওয়া যায়।’ প্রধান বিচারপতি বলেন, ‘আমি তো প্রেস কনফারেন্স করে কথা বলি না, আমি আমার প্রসিডিংসয়ের মধ্যে থেকে কথা বলি।’ এরপর শুনানি শুরু করেন অপর এ্যামিকাস কিউরি এ জে মোহাম্মদ আলী। তিনি বলেন, সংবিধান অনুসারে বিচার বিভাগের স্বাধীনতা ও গণতন্ত্র রক্ষা করতে হলে বিচারকদের অপসারণ পদ্ধতি সুপ্রীম জুডিশিয়াল কাউন্সিলের মাধ্যমেই হতে হবে। এ জন্য সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনী অবৈধ ও অসাংবিধানিক উল্লেখ করে হাইকোর্টের রায় যথার্থ বলেও উল্লেখ করেন তিনি। এরপর বেলা ১১টায় বিরতিতে যায় আপীল বিভাগ। বিরতির পর এজে মোহাম্মদ আলী বক্তব্য উপস্থাপন করলে আদালত তার লিখিত বক্তব্য গ্রহণ করে জ্যেষ্ঠ আইনজীবী ফিদা এম কামালকে বক্তব্য উপস্থাপন করতে বলেন। শুনানিতে ফিদা এম কামাল বলেন, ‘বিচারক অপসারণে সুপ্রীম জুডিশিয়াল কাউন্সিল পদ্ধতি একটি সেটেল্ড ইস্যু। ইতোমধ্যে উচ্চ আদালতের দুটি রায়েও এ বিষয়টি উল্লেখ করা হয়েছে। ওই রায়ে আলোকেই সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনীর মাধ্যমে সুপ্রীম জুডিশিয়াল কাউন্সিল পদ্ধতি বহাল রাখা হয়েছিল। বিচারক অপসারণে এ বিধান না থাকলে অরাজকতা দেখা দেবে। তিনি আরও বলেন, আপনারা চাইলে এখন সুপ্রীম জুডিশিয়াল কাউন্সিলকে কিভাবে আরও কার্যকর ও গঠনমূলক করা যায়, সে বিষয়ে দিকনির্দেশনা দিতে পারেন।’ এ পর্যায়ে প্রধান বিচারপতি বলেন, ‘এটি পুরোটা সুপ্রীম জুডিশিয়াল সার্ভিস কমিশনের দেখা উচিত। কিন্তু সেটা তো হচ্ছে না। তিনি বলেন, জুডিশিয়াল সার্ভিস কমিশনের চেয়ারম্যানও একজন বিচারক। তিনি চেয়ারম্যান হিসেবে বিদেশ যেতে চাইলেও তাকে সরকারের অনুমতি নিতে হয়; দুদকসহ অন্যান্য কমিশনের মতো। ওখানে (কমিশনে) অধস্তন আদালতের বিচারক নিয়োগে পরীক্ষা নেয়া হয়, কিন্তু কমিশন সরকারের সিলেবাসের বাইরে যেতে পারেন না। ওটাকে (কমিশন) হাত-পা বেঁধে এমনভাবে রেখে দেয়া হয়েছে, যে প্রশ্ন করতে হলেও সিলেবাসের বাইরে যাওয়া যাবে না।’ এ সময় ফিদা এম কামাল বলেন, ‘হাত-পা বেঁধে রেখে তো সাঁতার কাটা যায় না। রাষ্ট্রের তিন অঙ্গের (আইন, শাসন ও বিচার) মধ্যে সমন্বয় থাকতে হবে। নয়তো কেউ কাজ করতে পারবে না।’ এরপর শুনানি শুরু করেন আবদুল মতিন খসরু। তিনি বলেন, ‘সংসদই সার্বভৌম ক্ষমতার অধিকারী। জনগণ সংবিধানের মাধ্যমেই সংসদকে আইন প্রণয়নের ক্ষমতা দিয়েছে। ষোড়শ সংশোধনীর মাধ্যমে বিচারক অপসারণে বাহাত্তরের মূল সংবিধানে উল্লিখিত সংসদের ক্ষমতা ফেরত এসেছে।’ এ সময় প্রধান বিচারপতি বলেন, ‘ধরেন এখানে আপনিসহ আরও দুইজনের নেতৃত্বে তিনটি প্লাটফর্ম হলো। তারা ক্ষমতায় গিয়ে বিচারক অপসারণে বিভক্ত হয়ে পড়ল তখন আপনার পলিসি কি হবে?’ এ পর্যায়ে ভারতের পালামেন্টের উদাহারণ দিয়ে প্রধান বিচারপতি বলেন, ‘ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি যদি সোনিয়া গান্ধিকে রাষ্ট্রীয় কোন অনুষ্ঠানে দাওয়াত দেন তিনি চলে আসেন। আমাদের এখানে তো ঐক্য নেই। আমরা একজন আরেক জনের দাওয়াতেও যাই না। সব ব্যাপারেই বিভক্তি।’ এ সময় এ্যাটর্নি জেনারেল বলেন, ‘এখানে কিভাবে ঐক্য হবে? একটা পার্টি জাতির জনক বঙ্গবন্ধুর নামও উচ্চারণ করে না। মহাত্মা গান্ধীকে সব দলই সমানভাবে শ্রদ্ধা করে। আপনারা পার্টি হবেন না। এভাবে বললে একটি দল মনে করবে এ রায় তাদের পক্ষে গেছে। যেখানে একটা দল বঙ্গবন্ধুর নামও উচ্চরণ করে না, তাদের সঙ্গে ঐক্য কিভাবে?’ এ পর্যায়ে প্রধান বিচারপতি বলেন, ‘এটাই তো চিন্তুা। ঝুলন্ত পালামেন্ট হলে বিচারক অপসারণ কীভাবে হবে? পরিস্থিতি যদি এই হয়, কি করবেন, আপনারা সবাই ইগো নিয়ে থাকেন।’ এ সময় মতিন খসরু বলেন, ‘সেটা পরবর্তী প্রজন্ম দেখবে।’ তখন প্রধান বিচারপতি বলেন, ‘স্বাধীনতার ৪৫ বছর পার হয়ে গেছে। আমরা তো এগুলোই দেখছি।’ জবাবে মতিন খসরু বলেন, ‘বঙ্গবন্ধু ও জাতীয় চার নেতা হত্যাকারীদের সঙ্গে বসার কোন সুযোগ নেই।’ তখন প্রধান বিচারপতি বলেন, ‘এটাই তো আমাদের বিভক্তি। সারাদেশের মানুষ দেখছে। পরে শুনানি মুলতবি করে আগামীকাল বৃহস্পতিবার ফের দিন ধার্য করা হয়।’ বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর ১৯৭২ সালে প্রণীত সংবিধানে উচ্চ আদালতের বিচারকদের অপসারণের ক্ষমতা সংসদের হাতেই ছিল। বঙ্গবন্ধুর সময় চতুর্থ সংশোধনী হলে তা রাষ্ট্রপতির হাতে ন্যস্ত হয়। জিয়াউর রহমানের শাসনামলে সংবিধানের পঞ্চম সংশোধনীর মাধ্যমে বিচারকদের অপসারণের ক্ষমতা সুপ্রীম জুডিশিয়াল কাউন্সিলের কাছে ন্যস্ত হয়। সংবিধানের পঞ্চম সংশোধনী পরে সর্বোচ্চ আদালতের রায়ে বাতিল হয়। ২০১৪ সালের ১৭ সেপ্টেম্বর সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনীর মাধ্যমে উচ্চ আদালতের বিচারক অপসারণের ক্ষমতা সংসদের কাছে ফিরিয়ে আনা হয়। এর বিরুদ্ধে কয়েকজন আইনজীবী আদালতে গেলে গত বছরের ৫ মে হাইকোর্টের দেয়া রায়ে ষোড়শ সংশোধনী অবৈধ ঘোষণা করা হয়। সংখ্যাগরিষ্ঠ্য মতের ভিত্তিতে হাইকোর্টে ওই রায় আসে। হাইকোর্টের ওই রায়ের বিরুদ্ধে আপীল করে রাষ্ট্রপক্ষ। গত ৮ মে পেপার বুক থেকে রায় পড়ার মাধ্যমে এ মামলার আপীল শুনানি শুরু হয়। এরপর ৯ মে দ্বিতীয় দিনের মতো শুনানি হয়। এ দুদিন রাষ্ট্রপক্ষে অতিরিক্ত এ্যাটর্নি জেনারেল মুরাদ রেজা হাইকোর্টের রায়ের ওপর আদালতে শুনানি করেন। এরপর ওইদিনই আদালতে চারজন এ্যামিকাস কিউরি তাদের লিখিত মতামত জমা দেন। তারা হলেন, সংবিধানের অন্যতম প্রণেতা ড. কামাল হোসেন, ব্যারিস্টার এম আমীর-উল ইসলাম, এম আই ফারুকী ও আবদুল ওয়াদুদ ভূঁইয়া। সে দিন আদালত ২১ মে শুনানির পরবর্তী দিন নির্ধারণ করেন। এর আগে গত ৮ ফেব্রুয়ারি এ মামলায় আপীল শুনানিতে সহায়তার জন্য ১২ জন জ্যেষ্ঠ আইনজীবীকে এ্যামিকাস কিউরি হিসেবে নিয়োগ দেন আপীল বিভাগ। তারা হলেনÑ সাবেক বিচারপতি টি এইচ খান, ড. কামাল হোসেন, ব্যারিস্টার রফিক-উল হক, ব্যারিস্টার এম আমীর-উল ইসলাম, ব্যারিস্টার আজমালুল হোসেন কিউসি, ব্যারিস্টার রোকন উদ্দিন মাহমুদ, ব্যারিস্টার শফিক আহমেদ, এ এফ হাসান আরিফ, এম আই ফরুকী, ব্যারিস্টার ফিদা এম কামাল, এ জে মোহাম্মদ আলী ও আবদুল ওয়াদুদ ভূঁইয়া।
×